সোমবার ২১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

Ad
x
আইডিআরএ’র কার্যকর উদ্যোগ চান সংশ্লিষ্টরা

অতিরিক্ত কমিশন, খাদের কিনারে নন লাইফ বীমা খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫   |   প্রিন্ট   |   1127 বার পঠিত

অতিরিক্ত কমিশন, খাদের কিনারে নন লাইফ বীমা খাত

দীর্ঘদিন ধরেই নন-লাইফ বীমা খাতে চলছে অবৈধ কমিশনের বিনিময়ে ব্যবসা হাতিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা। নানা অনিয়ম জেঁকে বসলেও অতিরিক্ত কমিশনের পাল্লায় পড়ে একেবারে খাদের কিনারে এই খাত।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা বলছেন, নির্ধারিত হারের বাইরে কমিশন দেয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখন পুরো খাতের স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ কোম্পানিই নির্ধারিত সীমার বাইরে অতিরিক্ত হারে কমিশন দিয়ে ব্যবসা সংগ্রহ করছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।

বিধি অনুযায়ী, নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ১৫শতাংশ এজেন্ট কমিশন দিতে পারে। তবে বাস্তবে অনেক কোম্পানি ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশনের নামে প্রিমিয়াম ছাড় দিয়ে ব্যবসা সংগ্রহ করছে। কিছু কোম্পানি আবার বিভিন্ন প্রকার “রিবেট”, “ছাড়”, কিংবা “বৈদেশিক প্রিমিয়াম রেট” নামে দুর্বল কোম্পানির রেট এনে কম প্রিমিয়াম নিয়ে এই কমিশনকে বৈধ করার চেষ্টাও করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশন নিয়ে এমন প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হয়েছে যে, এখন আর যোগ্যতা বা সেবার মান নয়-বীমা ব্যবসা নির্ধারিত হচ্ছে কে কত বেশি কমিশন দিতে পারছে তার ভিত্তিতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক শ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা এবং শাখা ব্যবস্থাপকরাও এই অতিরিক্ত কমিশন প্রথায় সরাসরি জড়িত। তারা বাজার যাচাই করে, একাধিক বীমা কোম্পানির মধ্যে কমিশন প্রতিযোগিতা করিয়ে সর্বোচ্চ কমিশনদাতার কাছেই ব্যবসা দিচ্ছেন। এতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নৈতিকতা ও নিয়মনীতি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। সেক্টরে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট ও দক্ষ কর্মী দুর্দশা।

এই বেআইনি কমিশনের কারণে বেশিরভাগ নন-লাইফ বীমা কোম্পানি মারাত্মক আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের দাবি পরিশোধে বিলম্ব করছে, পুনঃবীমা প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে পারছে না, এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা যথাসময়ে প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। নতুন কর্মীনিয়োগ ও মেধাবী মানবসম্পদ আকর্ষণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র বলছে, অতিরিক্ত কমিশনের বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে কিছু কোম্পানি নানা কৌশল অবলম্বন করছে। যেমন-ডাবল সার্ভার ব্যবহার করে লেনদেন আড়াল করা, ভুয়া ক্লেইম দেখিয়ে টাকা বের করা, অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেখিয়ে বেতন খাতে অর্থ উত্তোলন ইত্যাদি। এর ফলে কোম্পানির ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ প্রকৃত আয় বা প্রকৃত সেবার মান উন্নত হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগুজে এজেন্ট তৈরি করে, বেআইনি বিল বানিয়ে কোম্পানিগুলো থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কাজ না করা তথাকথিত “এজেন্ট”দের নামে কমিশন বিল করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতবদল হচ্ছে, ওই টাকা কোন বীমা কর্মী বা বীমা এজেন্টের হাতে যাচ্ছে না। এই টাকার সুবিধাভোগী হচ্ছে কিছু বীমা গ্রাহক এবং কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা। যা আইনি কাঠামোর চরম অপব্যবহার বলেই খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

অনেক সময় এজেন্টের নামে যাদের লাইসেন্স নেওয়া হয়, তারা হয় কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীর আত্মীয়, নিকটজন কিংবা নামমাত্র কেউ -যাদের বীমা ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ধারণাও নেই। এর ফলে এই কমিশন পরিণত হয়েছে কোম্পানির খরচ দেখানোর এক অপকৌশলে।

কমিশন প্রথা বাতিলের পক্ষে অধিকাংশ কোম্পানি: বর্তমানে বেশিরভাগ বীমা কোম্পানিই ১৫শতাংশ কমিশন প্রথা বাতিল করার পক্ষে। তাদের মতে, যতক্ষণ কমিশন আইনগতভাবে বিদ্যমান, ততক্ষণ ব্যাংক, গ্রাহক, বড় বড় গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ কমিশন দাবি করবে। কিন্তু যদি আইন পরিবর্তন করে ‘জিরো পার্সেন্ট কমিশন’ চালু করা হয়, তাহলে সোজাসাপ্টা বলা যাবে “এখন থেকে কোনো কমিশন নেই”। এতে করে বাজারে কমিশনের এই অপব্যবহার অনেকটাই বন্ধ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে কিছু কোম্পানি যারা একচেটিয়া মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ও বিদেশি প্রভাবাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করে থাকে তারা ১৫% কমিশন প্রথা রাখার পক্ষে মত দিচ্ছে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা কমিশন নেয় না, তাই বীমা কোম্পানিগুলো কমিশনের নামে বিল করে বিভিন্ন খরচ নির্বিঘ্নে চালিয়ে নিতে পারে। তাদের মতে, কমিশন থাকলে আইনি কাঠামো ব্যবহার করে তাদের নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করা সহজ হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নন লাইফ বীমা খাতের একাধিক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলছেন, ‘বাজারে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ব্যবসা করতে গেলে কমিশন দিতেই হয়। কারণ, কমিশন ছাড়া ব্যবসা আসে না। অথচ কমিশন দিয়েই কোম্পানিগুলো নিজেদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, কমিশনের নামে যে অপচয় হচ্ছে, তা কোম্পানিগুলোর মুনাফা প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে। ফলে কোম্পানির সলভেন্সি রেশিও দুর্বল হচ্ছে, রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে, আর দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার জন্য হুমকির মুখে পড়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের (বিআইএফ) ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উদ্যোগ।

এই তিনটি সংস্থা যদি একযোগে কঠোর মনিটরিং, জিরো টলারেন্স নীতি, লাইসেন্স বাতিল, জরিমানা আরোপসহ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বীমা প্রতিনিধিদের কমিশন বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ডিজিটাল রেজিস্ট্রি চালু করে, তাহলে এই অনিয়ম অনেকাংশে হ্রাস পাবে। তারা বলছেন, কমিশন প্রথা বন্ধে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে সরাসরি ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করতে হবে। পাশাপাশি, নকল এজেন্ট সনাক্ত করে তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং কোম্পানিগুলোর কমিশন খাতের অডিট করা জরুরি।

 

 

Facebook Comments Box

Posted ১০:০৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।