বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট | 787 বার পঠিত
অনিয়ম, অব্যস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। মূলধনও খেয়ে ফেলেছে অনেক ব্যাংক। উচ্চ সুদহার আর তারল্য সঙ্কটে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি তলানিতে। ফলে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় গলার কাটা এখন ব্যাংক খাত। চলমান এ সমস্যা উত্তরণে নানা ফাঁক ফোঁকর খুঁজছে সরকার।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নতুন সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। মন্ত্রী হওয়ার পরই ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা দূর করতে কঠোর হুঁশিয়ারির পাশাপাশি সংস্কারের ঘোষণা দেন তিনি।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখোমুখি। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ব্যাংক খাতই এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ খাতের সমস্যা দূর করতে ব্যাংক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
সর্বশেষ ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে বসন্তকালীন সভার প্রথম দিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। এ দুর্বলতা কাটাতে আমরা আইএমএফের সহযোগিতা চেয়েছি। তারা আমাদের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
নতুন অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে খেলাপির বিষয়ে শর্ত জুড়ে দেন। তিনি বলেন, বৈঠকে বসার আগেই আমার শর্ত ছিল একটা। কোনো কিছু আলাপ করার আগে আমার এক দফা। আজকের পর থেকে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়তে পারবে না। এর পর তৎপরতা শুরু করে বেসরকরি ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা। কীভাবে খেলাপি ঋণ কমানো যায়, তার কৌশল নির্ণয়ে ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন পরিচালকরা। এদিকে সরকারের চাপে নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। এছাড়া বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কারের নানা উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাত-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশে ঋণ খেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী বলছেন, ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধের অর্থাৎ ঋণখেলাপি থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ করে দিচ্ছি। তবে এ সুযোগ অবশ্যই ‘ভালো’ ঋণখেলাপিদের জন্য।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে দুই ধরনের ঋণগ্রহীতা আছে; ভালো এবং অসাধু ঋণগ্রহীতা। ভালো ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য আমরা বিশেষ সুবিধা দিচ্ছি।
নানা সমালোচনার মধ্যেও ঋণখেলাপিদের সুযোগ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসতে যাচ্ছে পুনর্গঠিত ঋণসহ যে কোনো ঋণ পুনঃতফসিল এবং খেলাপি ঋণ হিসাবায়নে। এছাড়া ডাউন পেমেন্টের বর্তমান হারও কমানো হবে।
বর্তমানে কোনো ঋণ তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ৬ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সন্দেহজনক এবং ৯ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে মন্দ (খেলাপি) হিসেবে শ্রেণীকরণ করে। এসব ঋণ মান নির্ধারণে প্রতি পর্যায়ে সময় বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ তিন মাসের পরিবর্তে ৬ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ১২ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ সন্দেহজনক এবং দেড় বছর মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা মন্দমান (খেলাপি) হিসেবে শ্রেণীকরণ করবে। শ্রেণীকরণের এ প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি। এটি কার্যকর হলে খেলাপিরা বাড়তি সুবিধা পাবে। ব্যাংকগুলো নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে বাড়তি সময় পাবে।
অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কারের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকার ব্যাংক খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে বিভিন্ন ফাঁক ফোঁকর খুঁজছে। এসব সংস্কার করে কাগজে-কলমে ব্যাংক খাত ভালো করতে পারলেও বাস্তবে নেতিবাচক ছাড়া এর ইতিবাচক কোনো ফল আসবে না।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাত সংস্কারে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক কথাবার্তা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।
তিনি বলেন, খেলাপিদের জন্য সরকার যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, তা করলে ব্যাংকিং খাতে আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি হবে। মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরে বকেয়া টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়া হবে। তাদের ঋণের সুদ হবে ৯ শতাংশ। এটিই যদি হয় তাহলে যারা ঋণ খেলাপি নয়, নিয়মিত গ্রাহক তাদের ক্ষেত্রে অবিচার করা হবে। তারা ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে। পরবর্তীতে এ ঋণ আর পরিশোধ করবে না। কারণ তারা বলবে, খেলাপি হলে কম সুদে ঋণ পাওয়া যাবে।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খারাপ ভালো ব্যাংক যুক্ত করার কথা বলা। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় করা হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের বিষয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। এটির ফল আসলে কী হবে তা এখন দেখার বিষয়।
বর্তমান ব্যাংক খাতে সুশৃঙ্খলা ফেরাতে কী করা উচিত, জানতে চাইলে প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংক খাতের জরুরি কয়েকটি কাজ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমত সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। একই পরিবারের পরিচালকদের পর্ষদে দীর্ঘ মেয়াদি রেখে এটি নিশ্চিত করা সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে। এছাড়া আইনি যেসব দুর্বলতা আছে তা দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি জানান।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপনের (রাইট অফ) নীতিমালা পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এখন থেকে মামলা ছাড়াই ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এতোদিন মামলা ছাড়া সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ঋণ অবলোপন করার সুযোগ ছিল। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশ এবং প্রভাবশালী খেলাপির কারণে পুরো অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে। এতে আগামীতে খেলাপি কমে আসছে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
নানা সমালোচনার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় আরও তিনটি ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নতুন সরকার। এর মধ্যে কার্যক্রম শুরু করতে দু’টি ব্যাংককে লাইসেন্সের জন্য প্রাথমিক সম্মতিপত্র (এলওআই বা লেটার অব ইনটেন্ট) দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক দুটি হলো- বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সিটিজেন ব্যাংক। এ ছাড়া এলওআই পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে পিপলস ব্যাংক।
খেলাপি ঋণ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর ২০১৭ শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।
মূলধন ঘাটতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এসব ব্যাংকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। তিন মাস আগে ৯টি ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। নতুন করে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক। মূলধন ঘাটতির তালিকায় বেশিরভাগই রয়েছে সরকারি ব্যাংক। অন্যদিকে, ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে আলোচিত জনতা ব্যাংকের ঘাটতি বেড়ে পাঁচ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা হয়েছে। মূলধন ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
রিজার্ভ চুরি
ব্যাংক খাতের আলোচিত একটি ঘটনা রিজার্ভ চুরি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটে রিজার্ভ চুরির ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৮০০ কোটি টাকা) চুরি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, ‘হ্যাক’ করে এ অর্থ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। অব্যাহতি দেয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকে। ওএসডি করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তিন বছর পর রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরিয়ে আনতে ও ক্ষতিপূরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে শেষ পর্যন্ত মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ মামলা নিষ্পত্তিতে তিন বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Posted ১:২৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed