নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ২৮ মার্চ ২০২২ | প্রিন্ট | 323 বার পঠিত
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে সীমাহীন দুর্নীতি, জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। শুধু তাই নয়, কোম্পানির বর্তমান কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আসামীদের তালিকা আইডিআরএ’র নিকট পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, গত ২৩ মার্চ আইডিআরএ’র পরিচালক (আইন) মোহাম্মদ শফিউদ্দীন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে নির্দেশনাসহ এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম এ করিমসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে কোম্পানির ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, গাড়ি ক্রয় বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার, প্লট ক্রয়ে ১৬ কোটি ৭০ লাখ ৪০ হাজার ও চট্টগ্রামস্থ আসকারবাদ মৌজার ফ্লোর স্পেস ক্রয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
ওইসব অভিযোগ প্রমাণের পক্ষে ঐ সময়ের প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশক্রমে গত ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মেসার্স হুদাভাসি চৌধুরী এন্ড কোং চার্টার্ড একাউন্টস ফার্ম কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া অনুমোদনহীন এজেন্টকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোটি কোটি টাকা প্রদান, আবাসিক প্রকল্পে প্লট ক্রয়, চট্টগ্রাম ও সিলেটে জমি ক্রয়, গাড়ি কেনা, ইসলামী (তাকাফুল) বীমার সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের তথ্য। আত্মসাতের সঙ্গে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম.এ করিম, এনায়েত আলী খান ছাড়াও তৎকালীন সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (সুজন বীমা বিভাগ) মো. মনিরুজ্জামান খান এবং সিনিয়র ব্যবস্থাপক (ইসলামী বীমা তাকাফুল বিভাগ) মো. রফিকুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট ১৯ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
এ সব অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরবর্তীতে দুদকের আইনের সংশোধনীর ফলে এটি কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিসমাপ্ত করার এবং একই সাথে এই অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে পাঠানো হয়। আইডিআরএ প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা প্রদান করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জুন ২০১৯ তারিখে আইডিআরএ সদস্য বোরহান উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে তদন্ত কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মোর্শেদুল মুসলিম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাছাই করে ৩৮টি অনিয়মের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। প্রগ্রেসিভ লাইফ দুটি চিঠির মাধ্যমে তাদের অনিয়মের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিকট প্রেরণ করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ, ২০১৩ সালে আর্থিক বিবরণীতে অনাদায়কৃত প্রিমিয়ামের যে সমন্বয় করা হয়েছে তা আইন সম্মত ছিল না। দ্বিতীয় অভিযোগে দেখা যায়, কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে কালেকশন এন হ্যান্ড দেখানো হয়েছে ৩০ কোটি ১৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯৪ টাকা। কিন্তু পলিসি নম্বর ও টাকার অন্যান্য ব্রেকআপসহ ২৭ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার টাকার বিবরণ পাওয়া যায় বাকী ৩ কোটি ১৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের আর্থিক বিবরণীতে সেটা সমন্বয় করা হয়েছে, যা আইন সম্মত নয়।
তৃতীয় অভিযোগে দেখা যায়, কোম্পানির ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন বন্ধ সার্ভিস সেলের ব্রাঞ্চ পেটি ক্যাশের আউটস্ট্যান্ডিং ব্যালেন্স এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সার্ভিস সেলগুলোর ইন-চার্জের নামে উক্ত টাকা আগাম দেয়া হয়েছিল কিন্তু টাকাগুলো আদায় করা হয়নি। তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বিপরীতে কোন কাগজপত্রও দলিলাদি দেখাতে পারেনি।
এছাড়া পলিসি লোনের উপর জমা সুদ ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং লোন ও অগ্রিমের উপর জমা সুদ ৩১ লাখ ২৮ হাজার ক্যারিড ফরোয়ার্ড থেকে দেখানো হয়েছে। যার উৎস খুজে পাওয়া যায়নি। এই টাকা ২০১৩ সালের আর্থিক বিবরণীতে বেআইনিভাবে সমন্বয় করা হয়েছে। তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দীপেন কুমার সাহাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নতুুন ব্যবস্থাপনার দোহাই দিয়ে পূর্বের কাগজপত্র ও দলিলাদি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে অর্থআত্মসাৎ মামলায় যাদের ক্রিমিনাল হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে তাদেরকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য বলা হলে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন অনিয়মকৃত অর্থ আদায়ের জন্য মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, ঢাকায় সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সি আর মামলা দেয়া হয়েছে যা বিচারাধীন রয়েছে। বেআইনি সমন্বয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন বিভিন্নভাবে কোম্পানির ব্যালেন্সশীটে অতিরিক্ত হারে দেখানো হয়েছে এবং ইন্টারেস্ট রেট ডবল দেখানো হয়েছে যা ক্যারি ফরোয়ার্ড করলে কোম্পানির দায় আরো বেড়ে যাবে। এতো দুর্নীতি ও অনিয়মের পরও বহাল তবিয়তে রয়েছে কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম এ করিম। যিনি বর্তমানে কোম্পানির পরিচালক পদে রয়েছেন।
আইডিআরএ’র নির্দেশনা ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেটি জানতে কোম্পানির চেয়ারম্যান নাসির আলী শাহ এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি অবহিত নই। আপনি কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর সাথে যোগাযোগ করুন। এ বিষয়ে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচ এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আইডিআরএ’র কাছ থেকে এরকম একটি নির্দেশনা পেয়েছি। কোম্পানির বোর্ডের সাথে আলোচনা করবো এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে আইডিআরএ কে অবহিত করা হবে।
Posted ১২:২৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৮ মার্চ ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy