পান্না কুমার রায় রজত | বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২২ | প্রিন্ট | 222 বার পঠিত
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আকাঙ্খা অর্জনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক খাত সংস্কারের মাধ্যমে শক্তিশালী করার বিষয়ে সময় উপযোগী নীতি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে প্রকাশিত ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ নামের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের এ পর্যবেক্ষণ বিষয়গুলো উঠে আসে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কয়েক দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ ১০ টি শীর্ষ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। অর্থনীতির তেজিভাব কখনোই স্থায়ী প্রবণতা নয়। বিশ^ ব্যাংকের মতে, অর্থনৈতিক সংস্কার না হলে প্রবৃদ্ধি নামতে পারে ৪ শতাংশের নিচে। আর এটা ঘটতে পারে ২০৩৫ থেকে ২০৩৯ সালের মধ্যে। ওই প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে তিনটি বাধা চিহ্নিত করেছে। বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাত এবং ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত নগরায়ণ।
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় বাণিজ্য ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি আমাদের অর্জিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। তাই রাজস্ব শৃঙ্খলা পুন:স্থাপন এবং রাজস্ব ব্যয়ের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি রাজস্বনীতির প্রধান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কয়েকটি উপায়ে অর্জিত হতে পারে। একটি উপায় হল প্রদত্ত অর্থনীতিতে পুঁজিগত পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। অর্থনীতিতে পুঁজি যুক্ত হলে তা শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। নতুন, উন্নত এবং বর্ধিত সংখ্যক সামগ্রীসমূহকে বোঝায় যে কর্মীরা এখন প্রতিক্ষণে আরও বেশি আউটপুট উৎপাদন করতে সক্ষম। যাই হোক অর্থনীতিতে কেউ প্রথমত নতুন পুঁজি তৈরির জন্য সংস্থাগুলিকে মুক্ত করার জন্য কিছু ধরনের সঞ্চয় করতে প্রত্যাশিত। তদুপরি, নতুন মূলধনটি সঠিক ধরনের, সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায় শ্রমিকদের একই উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া উচিৎ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সৃষ্টির আরেকটি পদ্ধতি হল প্রযুক্তির উন্নতি। মূলধন বৃদ্ধির মতো প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তিগত বুদ্ধি এবং এর সামগ্রিক হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বিনিয়োগ এবং সঞ্চয়ের সামগ্রিক হারের উপর নির্ভরশীল।
বিশে^র বড় ব্যাংকগুলো যে কোনো দেশের ঋণপত্র খোলার আগে সে দেশের ‘কান্ট্রি রিস্ক’ ও ক্রেডিট রিস্ক আমলে নেয়। একই সঙ্গে আমলে নেয়া হয় ব্যাংক খাতের জেড-স্কোরকেও। প্রতিটি দেশের ব্যাংক খাতের সক্ষমতার ভিত্তিতে জেড-স্কোর তৈরি করে বিশ্বব্যাংক। যেসব দেশের ব্যাংক খাত শক্তিশালী, সেসব দেশ এ তালিকায় বেশি নম্বর পায়। জেড-স্কোর বিষয়ে বিশ^ব্যাংকের ভাষ্য হলো, কোনো দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা প্রকাশ পায় তার জেড-স্কোরের মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় একটি দেশের ব্যাংক খাতের বাফার (মূলধন ও রিটার্ন) এবং রিটার্নের অনিশ্চয়তাকে তুলনা করা হয়।এটি পরিমাপের সূত্র হলো (আরওএ+(মূলধন/সম্পদ) /এসডি(আরওএ)। এখানে রিটার্ন অন অ্যাসেট(আরওএ) বলতে বোঝায় কোনো আর্থিক বছরে কোম্পানির মোট মুনাফার সঙ্গে সম্পদের অনুপাত, যা শতাংশে প্রকাশ করা হয়। এসডি (আরওএ) বলতে বোঝায় আরওএ’র গড় থেকে বিচ্যুতিকে। কোনো দেশের ব্যাংকের জেড-স্কোর পরিমাপের ক্ষেত্রে ব্যাংকভিত্তিক আলাদা তথ্য যোগ করার মাধ্যমে আরওএ, মূলধন ও সম্পদের হিসাব করা হয়। এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ করা হয় বৈশ্বিক ব্যাংকখাতের ব্যাংকস্কোপ তথ্য ভান্ডার থেকে। জেড-স্কোরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের প্রাপ্ত নম্বর ৭ দশমিক ১। অথচ নেপাল ও ভূটানের মতো ছোট দেশগুলোর ব্যাংক খাতের নম্বর ২৭ এর বেশি। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
বর্তমানে বিশ্বে খুব কম ব্যাংকই আছে, যার মূলধন ১০ কোটি ডলারের নিচে। অথচ বাংলাদেশে রয়েছে অনেকগুলো ব্যাংক। দেশে ৪০টিরও বেশি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংকের মূলধন অপর্যাপ্ত । এত কম মূলধন দিয়ে বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা হয় না। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অডিট করার সময় দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ, পুনর্গঠন ও পুন:তফসিলকৃত ঋণ, অবলোপনকৃত ঋণ, ঠিকমতো পরিশোধ হয় না এমন ঋণগুলোকে বাদ দিয়ে মূলধনের হিসাব করে। তখন দেখা যায়, বেশিরভাগ ব্যাংকের মূলধনই থাকে না। জেড-স্কোরের ক্ষেত্রে বিশ^ব্যাংক এ বিষয়গুলোকেই আমলে নেয়। মূলত দু’টি কারণে বিশ্বের দেশে দেশে ব্যাংক খাত বিপদগ্রস্ত হয়। এর একটি খেলাপি ঋণের অনিয়ন্ত্রিত হার। অন্যটি স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন। মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে কয়েক বছর আগে বিপর্যয় দেখা গিয়েছিল গ্রিসের ব্যাংকগুলোতে। সাম্প্রতিক সময়ে একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে আর্জেন্টিনায়। জিডিপি’তে বৈদেশিক ঋণের অংশগ্রহণ বেশি হলে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয় সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংক খাত।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। আমাদের অর্থনীতিকে একটি টেকসই ও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হলে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সংস্কার সাধন করতে হবে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ জুন শেষে ঋণের পরিমাণ। দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাল নাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। কোভিড-১৯ সময়ে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালে ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করেই খেলাপি হওয়া থেকে নিস্কৃতি পেয়েছেন গ্রাহকরা। আবার ২০২১ সালজুড়ে ছিল নীতিছাড়ের ছড়াছড়ি। ঋণ গ্রহীতারা নীতি ছাড়ের সুফল উপভোগ করছেন চলতি বছরও। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ পুন:তফসিলের নীতিমালায় ও অনেক সহজ করে দিয়েছে কেন্দ্রিয় ব্যাংক। ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের হাতেই পুন:তফসিলের সব ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়েছে।
নজিরবিহীন নীতি ছাড়ের পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কেন্দ্রিয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা ছিল খেলাপি, যা দেশের ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার দেশের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য অব্যাহত রাখার আবশ্যকতা রয়েছে। একটি দুর্বল ব্যাংকিং খাত দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহায়তা করার প্রস্তাব ও দিয়েছে বিশ^ব্যাংক । তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ব্যাংক খাত সংস্কারে আপাতত সহায়তার প্রয়োজন নেই। ব্যাংক খাতের সংস্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব পন্থায় চলছে। বিশ্ব ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক অবহিত করে যে, আর্থিক খাতের উন্নতির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
Posted ১২:৫৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy