| বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২ | প্রিন্ট | 573 বার পঠিত
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ইসলামি বীমার সমস্যা-সম্ভাবনা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামি বীমার ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি ইসলামি বীমা বিশেষজ্ঞ, বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, মুখপাত্র ও বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আহমাদ রাসেল। পাঠকদের জন্য এসব সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি।
প্রশ্ন: ইসলামি বীমা বিধিমালা প্রণয়নের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে আইডিআরএ। বিধিমালার খসড়া অংশীজনের মতামত গ্রহণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
এস এম নুরুজ্জামান: বাংলাদেশের ইসলামি বীমা কোম্পানিগুলো পরিচালিত হচ্ছে প্রচলিত বীমা আইনের অধীনে। কোম্পানির এখতিয়ারভুক্ত বিষয়গুলো শরীয়াহ কাউন্সিলের নির্দেশ মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে। অন্যান্য বিষয়গুলো শরীয়াহ মোতাবেক চালানোর জন্য শরীয়াহসম্মত বিধিমালা প্রয়োজন। ইসলামি বীমা বিধিমালা প্রণীত হলে ইসলামি বীমার লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণে কোনো বাঁধা থাকবে না।
প্রশ্ন: গ্রাহকদের কেন তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমা কোম্পানিতে পলিসি করা উচিত?
এস এম নুরুজ্জামান: প্রচলিত অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো সুদ। আর এই সুদকে আল্লাহ হারাম করেছেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। সুদ থেকে বাঁচার জন্য গ্রাহকদের ইসলামি জীবন বীমা কোম্পানিতে পলিসি করা উচিত। ইসলামি বীমা গ্রহণের মাধ্যমে সুদ, অস্বচ্ছতা ও জুয়ার উপাদানমুক্ত আর্থিক সঞ্চয়ের সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমার বৈশিষ্ট্য কী?
এস এম নুরুজ্জামান: ইসলামি বীমার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য কোনো অবস্থায় সুদের সাথে সম্পর্ক না থাকা। ইসলামি বীমা ব্যবস্থা ইসলামি অর্থনৈতিক বিধানের আওতাভুক্ত। ইসলামি বীমায় মুনাফা অর্জন করতে হবে হালাল ও শরীয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।
সুদ যেহেতু হারাম না নিষিদ্ধ, সেহেতু ইসলামি বীমা কোনো পরিস্থিতিতেই সুদ আয় করার জন্য বিনিয়োগ করতে পারে না। তারা সব বিনিয়োগ ইসলামি শরীয়াহ তথা মুদারাবা বা মুশারাকা পদ্ধতিতে করে থাকে। ইসলামি বীমা পলিসিতে কোনো রকম অস্বচ্ছতা বা ‘গারার’ এবং জুয়ার মতো নিষিদ্ধ জিনিসের উপাদান থাকতে পারে না। স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা হবে এ ধরনের বীমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ইসলামি বীমায় দুটি পৃথক ও সুস্পষ্ট হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়। একটি শেয়ারহোল্ডারদের হিসাব, আরেকটি পলিসিহোল্ডারদের হিসাব। এ দুটি হিসাব নির্ধারিত নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত খাতে নিষ্পন্ন হয়।
তাবাররু হলো ইসলামি বীমার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাবাররু বীমাকে ইসলামি চরিত্র দান করেছে। তাকাফুলে অংশগ্রহণকারীগণ তাদের প্রিমিয়ামের একটি নির্দিষ্ট অংশ তাবাররু পান্ডে দান করার অঙ্গীকার দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: প্রচলিত বীমা এবং ইসলামি বীমার মধ্যে পার্থক্য কী?
এস এম নুরুজ্জামান: লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মকাণ্ড ও কার্যপ্রণালীর দিক থেকে ইসলামি বীমা ও প্রচলিত বীমা ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামি বীমা পরিচালিত হয় ইসলামি শরীয়তের অনুশাসনের ভিত্তিতে। প্রচলিত বীমায় শরীয়াহ পালনের প্রতিশ্রুতি নেই। ইসলামি বীমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য পারস্পরিক কল্যাণ ও লাভ-লোকসানের সমান ভাগাভাগি।
ইসলামি বীমায় সকল প্রকার লেনদেন ও বিনিয়োগে সুদ পরিহার করতে হয়। প্রচলিত বীমায় সুদভিত্তিক লেনদেন করা হয়, যাতে কোনো বাধা নেই। ইসলামি বীমায় সবকিছুতে স্বচ্ছতা থাকতে হয় এবং এখানে অস্বচ্ছ ও সন্দেহজনক লেনদেন করা যাবে না।
ইসলামি বীমায় জুয়ার কোনো উপাদান থাকতে পারবে না। ইসলামি বীমায় মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে যাকাত ও সদকাহ তহবিল গঠন করা হয়। সর্বোপরি ইসলামি বীমায় শরীয়াহ পালন নিশ্চিতকরণে শরীয়াহ কাউন্সিল গঠন করা হয়।
প্রশ্ন: ইসলামি জীবন বীমার তহবিল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই।
এস এম নুরুজ্জামান: তাকাফুল কোম্পানিগুলো গ্রাহক থেকে সংগৃহীত প্রিমিয়ামের অর্থ সুদমুক্ত ব্যাংক ও হালাল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। সংগৃহীত প্রিমিয়ামের দুটি ভাগ ১. তাকাফুল তহবিল ২. মুদারাবা তহবিল। তাকাফুল তহবিল থেকে মৃত্যুদাবি, চউঅই/উওঅই প্রদান করা হয়। মুদারাবা তহবিলের টাকা বিনিয়োগ করা হয়। অর্জিত মুনাফা গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
প্রশ্ন: হযরত মুহাম্মদ (স.) এর যুগের অর্থনীতিতে বীমা ব্যবস্থার কী উপমা বা উদাহরণ রয়েছে?
এস এম নুরুজ্জামান: হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জন্মের আগ থেকেই আরব দেশে বীমার মতো আর্থিক ক্ষতিপূরণ দানের এক ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল। আরবে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস করত। তখন তাদের মধ্যে এরকম রীতি প্রচলিত ছিল যে, যদি কোনো গোত্র বা গোষ্ঠীর /জনপদের কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো গোত্রের কারো দ্বারা হত্যার শিকার হন; তাহলে হত্যাকারী হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির উত্তরাধিকারগণকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার মতো শাস্তি ভোগ করত। সেক্ষেত্রে হত্যাকারীর একার পক্ষে ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব না হওয়ায় আত্মীয়স্বজন মিলে রক্তমূল্য বাবদ কোনো মূল্যবান জিনিস দ্বারা ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। এই ঘটনার মধ্যে আধুনিক বীমা ব্যবস্থার ইঙ্গিত রয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.) মদিনায় হিজরত করার পর মুসলিম বিশ্বের প্রথম সংবিধান তৈরি করেন। যেখানে বীমা সম্পর্কিত এসব বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে সন্নিবেশিত হয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ইসলামি জীবন বীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নে আপনাদেরকে কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে?
এস এম নুরুজ্জামান: ১.বাংলাদেশে ইসলামি অর্থনীতি বা বীমা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ থাকলেও জানার অভাব রয়েছে।
২.ইসলামি বীমা ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষজনবল ও নির্বাহীর সংকট।
৩.অনুকূল পরিবেশ ও বিধিগত আনকূূল্যতার অভাব।
৪. বীমা সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা।
যদিও এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শরীয়াহ কাউন্সিলের সহযোগিতা গ্রহণ, দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ইসলামি জীবন বীমা বাস্তবায়নে পদ্ধতিগত জটিলতাগুলো কী?
এস এম নুরুজ্জামান: ১. ডিপোজিট: প্রচলিত বীমা আইন অনুযায়ী কোম্পানির জমা অর্থের নির্ধারিত অংশ সরকারি সঞ্চয়পত্র ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেখানে শরীয়াহ পরিপন্থী সুদ সম্পৃৃক্ত। ফলে সব ইসলামি জীবন বীমা তথা বীমা কোম্পানিকে সুদের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। ফলে পলিসি গ্রহীতাদের আয়ের সাথে সুদ যুক্ত হতে বাধ্য।
২.পলিসি ডকুমেন্ট: এখানে লাভ-লোকসান ইত্যাদি বণ্টনের এবং সুবিধাদি প্রদানের উৎস সমূহের পরিষ্কার উল্লেখ থাকা ইসলামি শরীয়াহর দাবি। অথচ আইনের কারণে তা সম্ভব হয় না।
৩. নমিনেশন: প্রচলিত জীবন বীমার ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে বীমার সুবিধা বণ্টন করার উল্লেখ ছাড়াই নমিনেশন বিধান রাখা হয়েছে, যা শরীয়াহ বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
৪. এজেন্সি কমিশন: ইসলামি জীবন বীমার এজেন্টকে স্বাভাবিকভাবে অংশগ্রহণকারী ফান্ড হতে পরিচালনাকারী কর্তৃক কমিশন পরিশোধ করার প্রচলিত বিধানসমূহ শরীয়াহ সম্মত নয়। অথচ অংশগ্রহণকারীদের প্রদত্ত প্রিমিয়ামের একটি বড় অংশ এখানে ব্যয় হয়ে যায়। ইসলামি জীবন বীমা কোম্পানিগুলোও তা অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
৫.লভ্যাংশ বিতরণ: ইসলামি বীমা কোম্পানি ও অংশগ্রহণকারীগণের মধ্যে কীভাবে লভ্যাংশ বিতরণ হবে তা আইনসিদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করার উপায় নেই। ফলে বিষয়টি প্রয়োগিকক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে এবং মুদারাবা চুক্তি বৈধ হচ্ছে না। লভ্যাংশের কত ভাগ অংশগ্রহণকারীদের প্রদান করা হবে তা স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।
৬. পলিসি বাজেয়াপ্তকরণ: প্রচলিত আইনে পলিসি বাজেয়াপ্তকরণের যে বিধান রয়েছে, তা শরীয়াহসম্মত নয়। ফলে এক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে তাকাফুল বা ইসলামি বীমার সম্ভাবনা কতটা?
এস এম নুরুজ্জামান: বাংলাদেশের জন্য ইসলামি বীমা একটি টেকসই পদ্ধতি। পূর্ণাঙ্গ আইন ও নিয়মের মধ্যে রেখে ইসলামী জীবন বীমাকে এখানে পরিচালিত করলে বেকারত্ব দূরীকরণ, বিনিয়োগ শিল্প স্থাপন, দারিদ্রতা দূরীকরণে এ খাত বিশাল ভূমিকা রাখতে পারবে।
Posted ১:৪৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy