বুধবার ৯ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জামাল এমএ নাসেরের অসময়ে চলে যাওয়া

কামারুন নাহার মুকুল :   |   শনিবার, ০৮ আগস্ট ২০২০   |   প্রিন্ট   |   786 বার পঠিত

জামাল এমএ নাসেরের অসময়ে চলে যাওয়া

অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকার সংগঠন ইকনোমিক মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বীমাশিল্পে অবদান রাখায় প্রয়াত বীমাবিদ মরহুম সাফাত আহমেদের পক্ষে প্রধান অতিথি ড. মোহাম্মদ সোহরাব উদ্দিনের কাছ থেকে ক্রেস্ট গ্রহণ করছেন সদ্য প্রয়াত জামাল এমএ নাসের। পাশে সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান ও ব্রি. জে. (অব.) কামরুল ইসলাম

আমাদের জাতীয় জীবনে যে সকল অগ্রণী ব্যক্তি তাদের মেধা, শ্রম, দিকনির্দেশনা, আত্মনিবেদন ও তিতিক্ষা দ্বারা উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছেন তাদেরই একজন বাংলাদেশের বীমাশিল্পের অন্যতম ব্যক্তিত্ব জামাল এমএ নাসের।

২০২০ সালেরই কথা। খুলনায় চতুর্থ বীমামেলা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জামাল এমএ নাসের। তিনি বলেন, প্রচারে প্রসার। বাংলাদেশে বীমাশিল্পে যে প্রয়োজন ছিল তা অনুধাবন করতে অনেকটা সময় লেগেছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনেক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বীমামেলা অন্যতম। যা জনগণের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করছে। সম্মানিত গ্রাহকদের মধ্যে যারা বীমা সম্পর্কে জানতেন না, তারা বীমামেলায় এসে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। পলিসি বিক্রেতাদের মুখ্য উদ্দেশ্য গ্রাহককে উদ্বুদ্ধ করা। তাই এ মেলায় বেসিক টার্গেট করে এসেছি। একটা পলিসির বিপরীতে বীমাদাবি হিসেবে এক কোটি ২১ লাখ টাকা দিয়েছি। এ গ্রাহক ৭৯ লাখ টাকা প্রিমিয়াম জমা দিয়ে এই টাকা পেয়েছেন। সাড়ে ৭ কোটি টাকা বীমাদাবির গ্রাহকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি চেক নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারা এসে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এই বলে যে, তাদের ঘরের কাছে এসে দাবি পূরণ করে দিয়েছি।

বীমার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে গেলে পুরো বীমাশিল্পকে কোম্পানির মাধ্যমে স্ব-স্ব গ্রাহককে বোঝাতে হবে- গ্রাহক নিজেও আসবেন এবং সাথে করে আরো কয়েকজনকে নিয়ে আসবেন। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হবে। তার মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আমরা সক্ষম হয়েছি।

জামাল এমএ নাসের আরো বলেন, আজ চতুর্থ বীমামেলা। আগামী বছরের বীমামেলার চিত্র হয়তো পরিবর্তন হয়ে যাবে। গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং সফল হবে। বিগত বছরে আমরা ভালো করেছি। কোম্পানির ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১০ শতাংশের মতো এবং বাংলাদেশের বীমাবাজারে যে মার্কেট শেয়ার আছে, সে শেয়ারে ১১ শতাংশ দখল করেছি। এ বছর ব্যবসা বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বেড়ে যাচ্ছে। গ্রোথ হয়ে যাবে ১১ শতাংশ। বীমার টার্গেট ক্রস করা আশ্চর্যের বিষয় ও প্রশংসনীয়। এ বছর আমরা টার্গেট শতভাগ অতিক্রম করেছি। রিনিউয়াল প্রিমিয়াম প্রায় ৮০০ কোটি টাকার কাছা কাছি যাবে। এ বছর লাইফ ফান্ড ৩ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। টার্গেট ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।

তিনি বলেন, বীমার টাকা গ্রাহকের টাকা। আমরা বিনিয়োগকারী। গ্রাহকের টাকা খাটিয়ে লাভ করবো। গ্রাহক ও মালিকদের লাভ দেব। আমরা কর্মচারী। জীবনমান নিয়ন্ত্রণ করবো এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। বিগত বছরে অর্থাৎ ২০১৯ সালে যে ব্যবসা করেছি এবং প্রফিট এসেছে, তাতে গ্রাহকদের ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছি। এ বছরও একইভাবে লভ্যাংশ এবং বোনাস ঘোষণা করেছি, যা সর্বোচ্চ। শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ইউনাইটেড ফোরস করপোরেশনের কনসেপ্ট নিয়ে আমরা কাজ করছি। অফিস ও মাঠপর্যায়ে একত্রে একই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এমআরএস ও ম্যানেজমেন্ট এতোই উন্নত, যা দিয়ে ব্যবসার তথ্য জানার ক্ষমতা আছে। আমরা এমন সফটওয়্যার করেছি, যার মাধ্যমে এক ঘণ্টায় গ্রাহকদের বীমার চেক দেয়া সম্ভব। এ সাফল্যের জন্য আমাদের বোর্ডের কর্মকাণ্ডই প্রাধান্য পায়। তদুপরি, আমাদের চেয়ারম্যানের গতিশীল নেতৃত্বে সক্ষম হয়েছি।

খুলনায় অনুষ্ঠিত বীমামেলায় ঢাকা থেকে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, উপস্থাপকসহ একটি টিম গিয়েছিলেন। হঠাৎ একসময়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জনসংযোগ কর্মকর্তা আমির হোসেন এ টিমকে খুঁজে বের করে জানালেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল এমএ নাসের তাদের স্মরণ করেছেন। এ টিমে ছিলেন ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামানসহ ৮-১০ জন। গোটা টিমই কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে তার সাথে দেখা করায় তিনি খুব খুশি হন। যথেষ্ট হৃদ্যতার সাথে তাদের সম্মানে একটি হোটেলে ভোজের আয়োজন করেন। এর মধ্যে ছিল খুলনাঞ্চলের সুস্বাদু মাছের সমারোহসহ নানারকম আয়োজনে। এভাবেই তিনি মানুষকে বিশেষ করে সাংবাদিক এবং তাদের কর্মকৌশলীদের আন্তরিকতার চোখে দেখতেন, ভালোবাসতেন।

আরেকটি ঘটনা। তার মৃত্যুর মাত্র ১০/১২ দিন আগের কথা। ব্যাংক বীমা অর্থনীতির সম্পাদক মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামানকে স্মরণ করেছিলেন তিনি। করোনা দুর্যোগকালে সবাই একসাথে যেন কাজ করে যেতে পারেন।

ক্ষুদ্রবীমা প্রবর্তক প্রয়াত সাফাত আহমেদ চৌধুরীর হাত ধরে বীমা অঙ্গনে প্রবেশ করেন জামাল এমএ নাসের। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৮৬ সালে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে অ্যাকচুয়ারিয়াল সহকারী হিসেবে। বীমা অঙ্গনে তার যাত্রা শুরু এভাবেই। এরপর তিনি একে একে ৬টি বীমা কোম্পানিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সন্ধানী লাইফ, প্রোগ্রেসিভ লাইফ এবং গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এর মাধ্যমেই তিনি জীবনবীমা শিল্পে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সততা ও নিষ্ঠার সাথে বীমা সেবা প্রদানের জন্য কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাতেন।ইকনোমিক মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত গুণীজন সম্মাননা (মরণোত্তর) ও স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখছেন সদ্য প্রয়াত জামাল এমএ নাসের

সর্বশেষ বীমাশিল্পে দক্ষ এই ব্যক্তিত্ব ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় বীমাপ্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দায়িত্বকালে তিনি ন্যাশনাল লাইফের সার্বিক উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি ক্ষুদ্রবীমাকে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে আনার কথা বলেছেন। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ইমেজ সংকটের কথাও বলেছেন এবং তা দূরীকরণে নানা পরামর্শও দিয়েছেন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রবিধানের কাজ করছে, তা দ্রুত শেষ করাসহ বাস্তবায়নের কথাও তিনি বলে গেছেন।

তিনি বিগত ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালনকালে বীমাশিল্পের সার্বিক উন্নতিসহ একে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যা ইন্স্যুরেন্স পরিবার কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। তিনি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি এবং ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির ভিজিটিং ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা অর্থ সম্পাদক ছিলেন। বীমা পেশা ছিল তার হৃদয়ের বাতিঘর, তাকে কিংবদন্তি বললে ভুল হবে না।
জামাল এমএ নাসের ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে এমএসসি এবং ১৯৯২ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি বোর্ড (ইউকে) থেকে জিসিই (কম্পিউটিং) ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেছেন।

সদা হাস্যোজ্জ্বল এ ব্যক্তিটি আর কখনো কোনো সেমিনারে চমৎকারভাবে পেপার প্রেজেন্টেশন করবেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা আর কেউ শুনবেন না। নিজ বাড়িতে সাজানো সংসারের প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না তিনি। হতভাগ এবং বিস্মিত হবার কিছু নেই, তিনি যেন এক স্মৃতি হয়ে গেলেন।
৬১ বছর বয়সে অদৃশ্য নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে ১২ জুন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুন ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে জানাজা শেষে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের তপোবন গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। তাকওয়া ফাউন্ডেশন চৌদ্দগ্রাম টিমের উদ্যোগে লাশ দাফন সম্পন্ন হয়। তিনি রেখে গেছেন এক ছেলে ও এক মেয়েসহ সহধর্মিণীকে আর অসংখ্য গুণগ্রাহী।ইকনোমিক মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত গুণীজন সম্মাননা (মরণোত্তর) ও স্মরণ সভায় অতিথি ও প্রয়াতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্মাননা ক্রেস্ট হাতে সদ্য প্রয়াত জামাল এমএ নাসের (ছবি বাম থেকে ৬)

একজন বীমা গবেষক হিসেবে দীর্ঘ ৩ যুগ সেক্টরটিকে প্রকৃত শিল্প আকারে গড়ে তুলতে নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি। তার এ চলে যাওয়ায় তার স্থান কখনো পূরণ হবার নয়।

তাঁর মৃত্যুতে বীমাশিল্প একজন নিষ্ঠাবান বীমাকর্মী হারিয়েছে, যা বীমাশিল্পের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বীমাশিল্পের উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছেন তিনি। যা বীমা জগতে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে বীমাশিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতিতে তিনি অনন্য ও অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। যা জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে।

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:৫০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৮ আগস্ট ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।