পান্না কুমার রায় রজত | ১১ মে ২০২১ | ১:৩১ অপরাহ্ণ
‘যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাকো আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলেই এই উৎসব স্বার্থক’-রবি ঠাকুরের সেই তুলনাহীন আনন্দের আশাই যে এখন আমাদের বেঁচে থাকবার অনুষঙ্গ। আবার রবি ঠাকুর ‘বৈশাখ’ কবিতায় বলেছেন-হে ভৈরব, হৈ রুদ্র বৈশাখ। অর্থাৎ বহুরূপে বৈশাখ যেন আবির্ভূত হয় বাঙালির জীবনে। আমরা বৈশাখের তান্ডবলীলায় ভীত নই, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘দুর্মর’ কবিতায় বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন ‘সাবাস’ বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়: জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। এই ভুখন্ডের মানুষদের সংগ্রামমুখর জীবন মাথা উচুঁ করে বাঁচার দৃঢ় প্রত্যয়, বিশ্বকে সময়ে সময়ে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে। এ জাতি কখনও মাথা নত করেনি কোন অপশক্তির কাছে। মেনে নেয়নি কোন লুটেরা, বেনিয়া শাসক শোষক গোষ্ঠীর অবিচার, অত্যাচার, জুলুম। বর্গিরা এখানে হানা দিয়েছে সম্পদ লুন্ঠনের আশায়, পুর্তুগিজ জলদস্যুরা ও এসেছে লুটে নিতে বাংলাদেশের সম্পদ। বাণিজ্য করতে এসে ইংরেজরা বনে গিয়েছিল শাসক। বাংলাদেশের মানুষ সে শাসন-শোষণকে নীরবে মেনে নেয়নি। জ্বলে উঠেছে ক্ষণে ক্ষণে। ইংরেজ বিদায় নিল। নতুন এক শাসকগোষ্ঠী আবির্ভাব হলো বাংলার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াল। আর ১৯৭১ সালে বাঙালি কী দুরন্ত সাহসে রুখে দিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে। বাংলাদেশ আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমরা গর্বিত কারণ পৃথিবী অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বর্তমানে সারাবিশ্ব করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত। প্রতিটি দেশ আজ এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছেনা। কোভিড-১৯ বিশ্বের অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের দেশে ও দীর্ঘসময়ের জন্য লকডাউন চলছে। এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এরূপ পরিস্থিতিতে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়েছে। কিন্তু বর্ণে বর্ণিল ছিল না উৎসবে। প্রতিবছর যে রকম রঙে রঙিন হয়ে বাঙালি মুখরিত থাকত কোভিড তা আমাদের হতে দেয়নি। যার প্রভাব পড়েছে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অর্থনীতিতে। গত কয়েক বছর ধরে সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা কর্মচারীরা বৈশাখে মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে উৎসব ভাতা পাচ্ছেন এবং বৈশাখ কেন্দ্রিক এই উৎসবে কেনাকাটার মাধ্যমে বৃহৎ টাকা বাজারে চলে যায়, ফলে বৈশাখ কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যের আকার বড় হয়ে তা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করছিল। বর্তমানে করোনার জন্য তা ধস নেমেছে। তা ছাড়া বাংলা নববর্ষকে ঘিরে বিশাল যে আয়োজন তা আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি, শহরের অর্থনীতি দুই জায়গার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ীদের জন্য এ করোনা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়াল্ডোমিটারস ডট ইনফোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের সময় ০৮-০৫-২০২১ শনিবার পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৩ জন এবং বাংলাদেশে মৃত্যু ১১ হাজার ৮৭৮জন। ইতোমধ্যেই আসন্ন ঈদুল ফিতর। গত ঈদগুলোতে ও বেচাকেনা হয়নি, তাই এবার আশায় বুক বেঁধেছিল ব্যবসায়ীরা। সবার লক্ষ্য ঈদের নতুন পোশাকসামগ্রী কেনা। ঈদের পোশাকসহ চাহিদা মতো অন্যান্য পণ্যসামগ্রী কেনাকাটা শুরু করেছেন। এতে করে একটু চাঙ্গা হচ্ছে ঈদবাজার। ঈদকেন্দ্রিক উৎসবের বেচা বিক্রিতে অর্থনীতিকে নতুন গতি সঞ্চার হবে বলে আশা করা যায়। এ বছর করেনাভীতির মধ্যেই মানুষ বাজারমুখী হয়েছে। উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রতি বছর বাড়ছে। কিন্তু করোনার কারণে গত এক বছর অর্থনীতিতে কিছুটা সংকট তৈরি হয়। ফলে উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতির বিপর্যয় হয়।
কিন্তু, করোনা স্থবির করে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবন। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কেনায় আর উপহারে ছোট থেকে বড় অনেকেই একাধিক সেট পোশাক পেয়ে থাকে ঈদে। খাবারেও থাকে ঐশ্বর্য। ঈদ কেনাকাটার জন্য বিপুল সম্ভারে আরো আয়োজন থাকে শপিংমলগুলো। মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় নানারকম মার্কেট তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। এমন এক অগ্রগতির ধারায় করেনাকালে বড় রকম ছন্দপতন ঘটিয়েছে। নাড়ির টান অনুভব করা দুরন্ত মানুষ যাতে গ্রামের বাড়িতে না যেতে পারে তার জন্য লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সীমিতভাবে দোকানপাট আর শপিংমল খুলে দিলেও তেমন বেচাকেনা হচ্ছে না। এর ফলে এবার ঈদের রমরমা খাবারের আয়োজন ও অনেকটা ছেদ পড়বে। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় এবার ও আটকে থাকবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই। সামাজিক দুরত্ব মেনে ঈদের নামাজ পড়তে হবে। করোনাকাল বাঙালির ঈদুল ফিতর উদযাপনে একটি ভিন্নধারা তৈরি করবে।
আমরা জানি যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড়খাত হচ্ছে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাত। প্রতিটি খাতের কয়েকটি উপখাত আছে। যেমন কৃষির উপখাত হল শস্য উৎপাদন, প্রাণী সম্পদ এবং মৎস্য সম্পদ। স্বল্প মেয়াদে এই সকল উপখাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি বিদেশী অর্থনীতিসমূহ অবরুদ্ধ থাকার কারণে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শিল্প খাতে বিশেষ করে উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে সেবা খাতে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বেচাকেনা এবং জরুরী সেবা ব্যাতীত এই খাতসমূহ মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরণের যোগাযোগ সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথ, পর্যটন হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল ইস্টেটসহ সকল প্রকার সেবা একেবারেই বন্ধ। অবরুদ্ধকাল দীর্ঘস্থায়ী হলে বেশিরভাগ ছোট-খাটো ব্যবসা এবং উৎপাদন প্রতিষ্ঠান সহজেই ঘুরে দাড়াতে পারবে না। ফলে, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ (Backward Linkage) এবং ফরোয়ার্ড লিঙ্কেজ (Forward Linkage) চেইন মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যার ফলে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত করবে বলে আমি মনে করি।
এই মুহুর্তে কোভিড এর রূপে একটি দেশের অর্থনীতির চারদিক ঘিরে রেখেছে এবং বিরামহীন ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি চাহিদার উপরে নির্ভরশীল। মানুষের কেনার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে তবেই অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থনীতির দুটো চিত্র পরিলক্ষিত হয়। একটি যা আমরা সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি। আরেকটি বিষয় যা অনেক পজেটিভ খবরের মধ্যে চাপা পড়ে যায়। সেই চাপা পড়া দিকটা হচ্ছে কর্মসংস্থান। আমরা দেখতে পাচ্ছি নন-ফরম্যাল অর্থাৎ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবস্থা বেশি খারাপ অর্থাৎ সংগঠিত নয় প্রাতিষ্ঠানিক বা করপোরেট আকারে নয় যেসব কর্মকাণ্ড তা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, এর মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাওয়ালা, ছোট ছোট দোকানদার, নির্মাণকর্মী, সেলুনকর্মী, ফেরিওয়ালা চানাচুর-মুড়ি বিক্রেতা, ভ্যানচালক, সবজি বিক্রেতা, দৈনিক শ্রমবিক্রির শ্রমিক, স্ব-নিয়োজিত লোকজন ইত্যাদি পেশার লোক। এরাই সংখ্যায় কোটি কোটি। এরা কর্মহীন, চাকরীহীন, ব্যবসাহীন। এদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার না হলে অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় খরচ করার ক্ষেত্রে এখন মানুষ খুব সাবধান। অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া এখন মানুষ অন্য কিছু কিনতে চাচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হচ্ছে ভোক্তা ব্যয়। অর্থাৎ বিভিন্ন খাতে মানুষ যে টাকা খরচ করে সেটার উপর নির্ভর করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টিকে আছে। এই ব্যয়ের উপর নির্ভরশীল যারা আছেন, ছোট উৎপাদক থেকে শুরু করে শিল্পখাতে এবং সেবা খাতে সবাই বিক্রির সংকটে পড়বে। বাঙালি আমোদে এবং অতিথিপরায়ন জাতি। একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে বা বন্ধুত্ব হলে একটা হোটেল বা রে¯েঁÍারায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করা, রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো বা উৎসবে কাপড়-চোপড় কেনা, প্রসাধনী কেনা, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দয্য মন্ডিত স্থানগুলো ঘুরে বেড়ানো-এই রকম বিভিন্ন ধরনের ব্যয় যে মানুষ করে, সেই সকল ব্যয়গুলো করতে সাহস পাচ্ছে না।
বাজার চাঙ্গা হতে পারে চাহিদা থাকলে অর্থাৎ পণ্যের ‘ডিমান্ড’ থাকলে। পণ্যের চাহিদা সৃষ্টির জন্য দরকার ক্রয়ক্ষমতা। এটা নেই সিংহভাগ মানুষের। অর্থনীতির মূল স্তম্ভ কৃষি বরাবরের মত এই করোনার দুর্দিনেও বাম্পার ফলন হয়েছে। যদিও আশঙ্কা ছিল ‘বোরো’ ফলন পুরোপুরি ঘরে আনা যাবে না শ্রমিকের অভাবে। কিন্তু তা হয়নি। মানুষ বড় বড় বিপদ থেকে শিক্ষা নেয়, জীবনকে নতুন ভাবে গড়ে তোলে। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে করোনাকাল। আমরা করোনা পরবর্তী একটি উৎসবমুখর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি।
বাংলাদেশ সময়: ১:৩১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy