বিবিএনিউজ.নেট | সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট | 519 বার পঠিত
অবৈধভাবে পরিচালিত ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান চলছে। এই অভিযান সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে; একই সঙ্গে অভিযানের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধারের দুদিন পর পাশের ক্লাবে অভিযানে নামলে কি অপরাধীরা ধরা দেয়ার জন্য বসে থাকবে?
ক্যাসিনোর রাঘব বোয়ালরা ইতোমধ্যেই গা-ঢাকা দিয়েছে। অভিযানে দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজ-টেন্ডার, দখলদার এবং মাদক ব্যবসায়ীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এর বাইরে অন্যান্য সেক্টরের রথি-মহারথি ও বিতর্কিতরা গর্তে লুকিয়েছে। ক্যাসিনো বন্ধে দেশব্যাপী অভিযানে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা সাধুবাদ জানিয়েছে। তবে কোথাও কোথাও বিলম্বে অভিযান শুরু করায় নিয়ে বিশিষ্টজনেরা প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, পুলিশের নাকের ডগায় ক্যাসিনোগুলো চলছিল। অথচ তারা এতদিন এসব খুঁজে পায়নি। দেশের প্রতিটি সেক্টরে যেখানে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অন্যায়-অবিচারে ভরে গেছে, সেখানে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এসব বন্ধ করা যাবে না। এ ধরনের অভিযান সাময়িক। সব সেক্টরে অভিযান চালানো আবশ্যক। আরেক অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, মতিঝিলে কয়েকশ’ গজের মধ্যে কিছু ক্লাবে অভিযানের দুই দিন পর অন্য ক্লাবে অভিযান চালালে কি কিছু পাওয়া সম্ভব? নাকি অপরাধীদের সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে বিলম্বে অভিযান?
প্রথমে রাজধানীর ক্লাবপাড়া হিসেবে পরিচিত ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যাসিনোর সরঞ্জাম উদ্ধারের পর ক্লাবের সভাপতি যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। অতঃপর যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার টেন্ডার শামীম (জি কে শামীম) এবং কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ক্যাসিনো চক্রের হোতা কৃষক লীগের শফিকুল আলম ফিরোজকে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর র্যার ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স, ওয়ান্ডারার্স, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাবসহ কয়েকটি ক্লাবে ‘ক্যাসিনো বন্ধে’ অভিযান পরিচালনা করে। এতে উঠে আসে ভয়াবহ চিত্র। দেশব্যাপী শুরু হয় তোলপাড়। মুসলিম দেশে মসজিদের শহর ঢাকায় ক্রীড়া সংগঠনের নামে গড়ে ওঠা ক্লাবগুলোতে বিদেশি জুয়া ক্যাসিনো খেলার রমরমা ব্যবসায় কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। ক্যাসিনোর সঙ্গে মদ, ইয়াবা, নৃত্য সবকিছুই চলে।
ঢাকার মতিঝিল ক্লাবপাড়ার পাশাপাশি ক্যাসিনো ও জুয়ার ব্যবসা চলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের অনেক জেলা শহরে। ঢাকায় প্রায় ৬০ ক্লাব ও আস্তানায় ক্যাসিনো খেলার রমরমা ব্যবসা চলছে বলে পুলিশ জানায়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে প্রায় শতাধিক জুয়া এবং কয়েকটি ক্যাসিনোর আসরে রাত-দিন লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয়। একই চিত্র অন্যান্য বিভাগীয় এবং জেলা শহরে। রোববারও ঢাকা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পুলিশ ক্যাসিনো বন্ধে ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে।
১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম অভিযানের পরের দিন নিকেতনের অভিযানে টেন্ডার শামীম ও কলাবাগান ক্রীড়া চক্রে অভিযানে শফিকুল আলম ফিরোজকে গ্রেফতার করা হয়। এই অভিযানে যখন ক্লাবের ক্যাসিনোর হোতারা পর্দার আড়ালে চলে গেছে তখন গতকাল রাজধানীর আরামবাগের চারটি ক্লাবে এক যোগে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। এ সময় কিছু নগদ টাকা, মদ, সিসা, কলকি, তাস, ছুরি, ওয়াকিটকি ও ক্যাসিনোর কিছু সামগ্রী পাওয়া যায়। সেগুলো জব্দ করা হয়। ক্লাবগুলো হচ্ছে- মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া চক্র ও দিলকুশা ক্লাব। পুলিশ ক্লাব চারটি সিলগালা করে দিয়েছে। মতিঝিল থানার পেছনে থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ সীমানার মধ্যে এসব ক্লাবে বছরের পর বছর ধরে ক্যাসিনো বোর্ড ও নানা ধরনের জুয়া খেলা চলতো দিনরাত। ছিল ক্যাসিনোর আসনের বিপুল মানুষের হৈ-হুল্লোড়। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে এসব ক্লাব চালানো হচ্ছিল।
পুলিশের নাকের ডগায় কিভাবে এসব ক্যাসিনো এতদিন চলে আসছে, সেই প্রশ্নের জবাবে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, যখনই আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, তখনই আমরা অভিযান চালিয়েছি। এর আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে।
গত বুধবার র্যাব যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর তার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়ংমেন্স ক্লাবে প্রথম অভিযান চালায়। এরপর অভিযান চালানো ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ক্লাবে। ওই দিনই তিনটি ক্লাব সিলগালা করে দেয়া হয়। একই দিন বনানীর আহমেদ টাওয়ারে গোল্ডেন ঢাকা ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। শুক্রবার অভিযান চালানো হয় ধানমন্ডি ক্লাব ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের ক্যাসিনোতে। রাবের এই অভিযানের পর কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ। এ অবস্থায় তারা নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরাতে চারটি বন্ধ ক্লাবে অভিযান চালায়।
লোক দেখানো এই অভিযান নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, চার দিন পরে পুলিশ অভিযানের নামে ওই ক্লাবগুলোকে অপরাধীদের পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
মতিঝিল বিভাগের ডিসি আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দুপুর আড়াইটায় চারটি ক্লাবে এক যোগে অভিযান শুরু হয়। চেয়ার-টেবিল, নানা ধরনের ক্যাসিনো বোর্ডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সেখানেই ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিছু জব্দ তালিকা করা হয়েছে। এ ছাড়া আইডি কার্ড মেশিন, ওয়াকিটকি, পাঞ্চ মেশিনসহ বেশ কিছু জিনিসের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে। তিনি আরও জানান, অভিযানের সময় ক্যাসিনোগুলোতে লোকজন ছিল না। তাই কাউকে আটক করা যায়নি। যারা খেলাধুলার আড়ালে জুয়ার জন্য এসব ক্লাব ব্যবহার করছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযানের সময় চারটি ক্লাব ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি ক্লাবেই ক্যাসিনোর বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম রয়েছে। দিলকুশা ক্লাবে দেখা গেছে সারি সারি ক্যাসিনো বোর্ড। বড় হলরুম জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জুয়া খেলার সরঞ্জাম। ওই হলরুমের চারপাশে ছোট ছোট কক্ষে ভিআইপিদের তাসসহ নানা ধরনের জুয়া খেলার টেবিল-চেয়ার। সেখান থেকে টাকা হিসেবের মেশিন, জুয়ার বোর্ড, তাস, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাব জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ।
মোহামেডান ক্লাবের পুরোটাই জুয়ার আখড়া। সেখানে স্পোর্সের তেমন কোনো সামগ্রী দেখা না গেলেও থরে থরে সাজানো ছিল ক্যাসিনো বোর্ড, ইলেক্ট্রিক জুয়ার বোর্ড, চরকি মেশিন। মোহামেডান ক্লাব থেকে ৩০টি ওয়াকিটকি ও অর্ধশত ছোট-বড় চাকু, টাকা গোনার কয়েকটি মেশিন, মদের বোতল, হাজার হাজার প্যাকেট প্লেয়িং তাসসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। এই ক্লাবে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভিআইপি প্লেয়িংজোন। যাতে তথা কথিত ভিআইপি লোকজন জুয়া খেলতো।
সূত্র জানায়, মোহামেডান ক্লাবের হলরুমটিতে বছরখানেক আগেও হলরুম হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেয়া হতো। এ ছাড়া সেখানে ইনডোর গেমস হিসেবে দাবা খেলা হতো। বছরখানেক আগে ওই হলরুম বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ক্যাসিনো সরঞ্জাম বসানো হয়। প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিপুলসংখ্যক ধনাঢ্য ব্যক্তি জুয়া খেলার জন্য মোহামেডান ক্লাবে ভিড় জমান। কেউ পরিচয় না দিতে চাইলে তার জন্য মাস্ক ব্যবহার করে পরিচয় আড়াল করার সুযোগ ছিল। সেখানে জুয়া খেলার সময় উপাসনার ব্যবস্থাও ছিল।
মতিঝিলের ১৪/এ, ক্লাব পেভিলয়ে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। এর ভেতর থেকেও অন্যান্য ক্লাবের মতো একই ধরনের জুয়া খেলার সামগ্রী, টাকা গণনার মেশিনসহ বিভিন্ন সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। এ ক্লাব থেকে নগদ এক লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের মতো আরামবাগ ক্লাবেও একই ধরনের জুয়া খেলার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট এসব ক্লাবের নিয়ন্ত্রক বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
Posted ২:৪৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed