বিবিএনিউজ.নেট | ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ | ২:১৪ অপরাহ্ণ
স্বাধীনতার পর থেকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে এ পর্যন্ত ১০টি উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সফলতা দেখা যায়নি। ১১তম উদ্যোগ চলমান রয়েছে। অন্যদিকে কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও চীন খেলাপি ঋণের উচ্চহার কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে নিয়েছিল বিশেষ উদ্যোগ। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনসহ কয়েকটি কার্যকর উদ্যোগের বাস্তবায়ন সফলতা পেয়েছিল দেশগুলো। বর্তমানে তাদের খেলাপি ঋণের হার স্বাভাবিকের চেয়েও নিচে। তাই বাংলাদেশে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণের সুপারিশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।বাংলাদেশের উচ্চ খেলাপি কমিয়ে আনতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করে এডিবি। যদিও এর সাফল্য নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে জাতীয়ভাবে সঞ্চয় বৃদ্ধি, সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশের মতো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব আরও বেশি। কারণ হিসেবে এডিবি বলেছে, বাংলাদেশে পরিপক্ব পুঁজিবাজার না থাকায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জোগান বাংলাদেশ ব্যাংককেই দিতে হয়। এজন্য বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সমস্যা জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। আর খেলাপি ঋণের উচ্চহার উদ্বেগ তৈরি করেছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। খেলাপির হার ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর বাইরে খেলাপি হওয়া ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের পরিমাণ যোগ করলে দেশের ব্যাংক খাতের প্রকৃত খেলাপি দুই লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং চীনের অর্থনীতিও খেলাপি ঋণ নিয়ে একই সমস্যায় পড়েছিল। দেশগুলো এই হার কীভাবে কমিয়ে এনেছে, তা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে এডিবি।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার বিরূপ প্রভাব প্রকট আকারে পড়েছিল কোরিয়ার অর্থনীতিতে। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ উচ্চহারে বৃদ্ধি পায়, যা অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। পরিস্থিতি উত্তরণে দেশটি ব্যাংক খাতকে পুরো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। অনেকেই এই উদ্যোগকে আগ্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে। এর অংশ হিসেবে কোরিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন (কেএএমসিও বা ক্যামকো) গঠন করে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক খাতের সব খেলাপি ঋণ কিনে নেয় বিশেষ ছাড়ে।
ক্যামকোর মূলধন জোগাড় করেছিল পাবলিক বন্ড ছেড়ে। কোরিয়া ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন এই বন্ড ছেড়েছিল। এর গ্যারান্টার হিসেবে ছিল দেশটির সরকার। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে দেশটির ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমে স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে। সংস্কার শেষে দেশটির খেলাপি ঋণ ২০১৭ সাল শেষে শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে শূন্য দশমিক ছয় শতাংশে নামে।
খেলাপি ঋণ যেন ভবিষ্যতে ফের উচ্চহারে বৃদ্ধি না পায়-সে জন্য দেশটি ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত, সুশাসন জোরদার, বিচার বিভাগে সংস্কার, দেউলিয়া আইনে সংস্কার আনে।
যদিও বাংলাদেশে এ ধরনের কোম্পানি গঠনের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এই দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে রাষ্ট্র বা সরকারি উদ্যোগ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে তো সরকারি ব্যাংকগুলোতেই ঋণখেলাপির হার সবচেয়ে বেশি। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করতে তো মূলধন লাগবে। এই অর্থায়ন কে করবে? সরকারি উদ্যোগে হলে তো সরকারকে মূলধন জোগাতে হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো সাধারণত একেবারে আদায় অযোগ্য ঋণ নিয়ে কাজ করে না খুব একটা। কিছু মন্দ মানের ঋণ নিয়ে করে থাকে, যাতে টাকা আদায় হয়। তারা যদি দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পুশে রাখে তাহলেও সমস্যা।
কোরিয়ার প্রসঙ্গ টেনে সাবেক এই গভর্নর বলেন, দেশটিতে ঋণ আদায়ে খুবই শক্ত অবস্থানে গিয়েছিল বলে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি কার্যকর হবে বলে আমি আশাবাদী না।
এডিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বপ্রথম উদ্যোগটি নেওয়া হয় ১৯৮৬ সালে। এরপর ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০০, ২০০৫, ২০০৭, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে নেওয়া হয় বিভিন্ন উদ্যোগ। কিন্তু এসব নীতি সহায়তার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ হিসাবের খাতায় কমলেও বাস্তবে কমেনি।
সর্বশেষ ১১তম উদ্যোগ নেয় হয় চলতি বছরে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ সংস্কার, ব্যাংক কোম্পানি আইন, দেউলিয়া আইনসহ বিভিন্ন আইনের সংস্কার। ব্যাংকগুলোয় বিশেষ নিরীক্ষা, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্টের নতুন গাইডলাইন প্রণয়ন, খেলাপি ঋণের তথ্য ভাণ্ডার তৈরি, এএমসি গঠনের সুপারিশ তৈরি, খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালায় শিথিলতা আনা। এসব উদ্যোগের কয়েকটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর সুপারিশ তৈরির কাজ চলছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংস্থাটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে জামানতি সম্পদের মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনা, দেউলিয়া আইনে সংস্কার, ব্যাংকিং খাতের নীতিমালার শক্ত প্রয়োগ ও সরকারি ব্যাংকগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে সাফল্য পেতে হলে বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে বলে মনে করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, অপ্রিয় হলেও বাংলাদেশ ব্যাংককে অ্যাকশনে যেতে হবে। নিয়মনীতিগুলোর প্রয়োগ করতে হবে কোনো কম্প্রোমাইজ ছাড়াই। যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি সেসব ব্যাংক ও তার ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থায় যেতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এছাড়া এডিআর তথা বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তি করতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করলে কাজে লাগবে। অর্থঋণ আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়াকেও দ্রুত করতে সংস্কার আনা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এডিবির প্রতিবেদন মতে, ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়াতেও পড়েছিল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব। ব্যাংক খাতের এ সমস্যা সমাধানে আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেয় দেশটি। বহুমুখী উদ্যোগের মধ্যে ডলারের বিপরীতে মুদ্রা বিনিময় হার কমিয়ে এনেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে না। জনগণকে এই ঘোষণায় আশ্বস্ত করতে পেরেছিল দেশটির তৎকালীন সরকার।
সংস্কারের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় তহবিলে ১৯৯৮ সালে তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এর মধ্যে একটি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মূলধন জোগাতে, দ্বিতীয়টি করপোরেট বন্ড তৈরি ও পরিচালনা এবং তৃতীয় প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি ঋণ কিনে নেওয়ার কাজ করে। তিনটি প্রতিষ্ঠানটি আলাদা নামে কোম্পানি গঠন করে কাজ ভাগ করে নেয়।
আগ্রাসী এই উদ্যোগের কারণে দেশটিতে খেলাপি ঋণ স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যায়। দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার চার দশমিক আট শতাংশ থেকে এক দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে যায়। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে আর্থিক খাত ও জাতীয় অর্থনীতিতে। পরবর্তী সময়ে দেশটি উৎসাহিত করে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন বা পুনঃতফসিল না করতে। দেশটির ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাক্ট-১৯৮৯ অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।
অনেকটা একইভাবে থাই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ দুটি কোম্পানি গঠন করেছিল থাইল্যান্ড। এসবের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করেছিল। এছাড়া ৬০ লাখ ৭৩ হাজার খেলাপিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল দেশটি। এছাড়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে সফলতা পেয়েছে ইউরোপের ব্যাংকগুলো। এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হওয়ায় স্লোভানিয়া, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস ও গ্রিস কমিয়ে এনেছিল খেলাপি ঋণের উচ্চহার।
বাংলাদেশ সময়: ২:১৪ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed