| বুধবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | প্রিন্ট | 432 বার পঠিত
লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব বাংলাদেশ (এলআইসি) যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র জীবন বীমা কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রধান উদ্যোক্তা ভারতের লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া। এলআইসি একটি আন্তর্জাতিক বীমা কোম্পানি। ভারতের এই রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫টি দেশে ভারতভিত্তিক এই কোম্পানির বীমা ব্যবসায়িক কার্যক্রম রয়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে এলআইসির গ্রাহক সংখ্যা ৪০ কোটি। লাইফ ফান্ড ৩৬ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশে এলআইসি যাত্রা শুরু করে ২০১৬ সালের অক্টোবরে। এলআইসি বাংলাদেশের স্থানীয় দুই স্পন্সর হচ্ছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্ট্রাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড।
বাংলাদেশের বীমা খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সম্প্রতি ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এলআইসি বাংলাদেশ লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরুপ কুমার দাস। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আহমাদ রাসেল।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : আপনার দৃষ্টিতে বীমা কী এবং গ্রাহকদের কেন বীমা করা উচিত বলে মনে করেন?
অরুপ কুমার দাস : জীবন ও সম্পদকে ঘিরে যে ঝুঁকি বিদ্যমান তার ক্ষতির বিপক্ষে বীমা হলো এক ধরনের আর্থিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা, মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ড এসব কারণে সম্পত্তি বা জীবনের কোনো ক্ষতি হলে বীমাকারী বীমাগ্রহীতাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিপূরণ করে তার নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। উপার্জনকারীর মৃত্যু হলে পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা প্রদান জীবন বীমার প্রধান উদ্দেশ্য। মানুষের যাবতীয় কাজ কর্মের উদ্দেশ্য থাকে নিজের মনের শান্তি অর্জন করা। ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে মানুষের পক্ষে কখনোই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বীমাগ্রহীতা বীমার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি পায়। তাছাড়া বীমা মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করে। বীমা একজন মানুষের বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন হয়ে থাকে। বীমা একজন গ্রাহকের পারিবারিক প্রয়োজন মেটায় এবং ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিসহ ঝুঁকি বণ্টনে সহায়তা করে। এসব কারণেই গ্রাহকদের বীমা করা উচিত বলে আমি করি।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের বীমাখাতের সম্ভাবনা কতটা?
অরুপ কুমার দাস : বাংলাদেশের বীমা খাতের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পরও এদেশে বীমাশিল্প এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই অপার সম্ভাবনার অন্যতম কারণ হলো দেশের অর্থনীতি ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক সুউচ্চ ভবন, বড় প্রকল্প এখনো বীমার বাইরে রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বীমার বিস্তারে এসব খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষা ও প্রবাসীদের বীমা নিশ্চিত করেও এ খাতের সম্প্রসারণ সম্ভব। বীমার পেনিট্রেশন বা জিডিপিতে বীমার অবদান, মাথা পিছু বীমার প্রিমিয়াম আয় ইত্যাদি সূচকে পরিষ্কার যে বাংলাদেশে বীমা সম্ভাবনা প্রবল।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : বীমাখাতের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অন্তরায় ইমেজ সংকট। বীমাশিল্পে এই ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে আপনার কোম্পানি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
অরুপ কুমার দাস : বর্তমানে বাংলাদেশের বীমাশিল্পের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হলো ইমেজ সংকট। বীমার ইমেজ সংকট কাটিয়ে তোলার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা চলমান রয়েছে। তবে ইতিমধ্যে আমরা এই পদক্ষেপের সুফল ভোগ করতে শুরু করেছি। বীমাশিল্পের ইমেজ পুনরুদ্ধার করা কোনো একক কাজ নয়। আমরা মনে করি, দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে এই শিল্পে। তাই কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে আমরা নিয়মিত দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের আয়োজন করছি। কর্মীদের প্রাপ্য কমিশন তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাসে দু’বার নিয়ম অনুযায়ী প্রদান করছি। এতে কোনো কর্মী গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকা সরাসরি কমিশন হিসেবে গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া গ্রাহক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে নিজেই তার প্রিমিয়াম জমা দিতে পারছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও প্রিমিয়াম জমার সুযোগ রয়েছে আমাদের কোম্পানিতে। নিয়মিত গ্রাহকের এসবি ও মৃত্যুদাবি পরিশোধের মাধ্যমে এই শিল্পের ইমেজ সংকট উত্তরণে আমাদের কোম্পানি ভূমিকা রাখছে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : বাংলাদেশের বীমা খাতের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী এবং উত্তরণের উপায় কী?
অরুপ কুমার দাস : বাংলাদেশের বীমাখাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ানোসহ বীমার প্রয়োজনীয়তা মানুষের মাঝে তুলে ধরা। এ জন্য সবার আগে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। সময়োপযোগী বীমা পণ্য গ্রাহকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। সময়মতো বীমা দাবি নিষ্পত্তি করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এ ব্যাপারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও বিআইএ’র অবদান অনস্বীকার্য। স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য বীমা পণ্য চালু করাও জরুরি। প্রিমিয়ামের বিপরীতে ভুয়া রশিদ দেয়া বন্ধ করা এবং ই-রিসিট চালু করতে হবে। এ জন্যে বীমায় প্রযুক্তির ব্যবহার আরো বাড়ানোর দরকার। তাছাড়া কমিশন প্রদানে অনৈতিক চর্চা সম্পূর্ণ বন্ধ করা জরুরি। এ জন্য ই-ইন্স্যুরেন্স চালু করা হলে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের আস্থাও বাড়বে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : দেশে ৩৫টি জীবন বীমা কোম্পানি রয়েছে। এতোগুলো কোম্পানির মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য বা সুবিধার কারণে গ্রাহকদের আপনার কোম্পানিকে পলিসির জন্য বেছে নেয়া উচিত?
অরুপ কুমার দাস : এলআইসির বিশ্বে ৪০ কোটি গ্রাহক রয়েছে। এই গ্রাহকদের সব ধরনের সেবা দিতে এলআইসি সদা প্রস্তুত থাকে। তাছাড়া গ্রাহকসেবায় প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এলআইসির অগ্রগতি দৃশ্যমান। বাজারে প্রচলিত বীমা পণ্য থেকে এলআইসির বীমাপণ্যের ভিন্নতা রয়েছে। নবজীবন আনন্দ নামে আমাদের একটি প্রকল্প রয়েছে, যা গ্রাহককে মেয়াদপূর্তি প্রদানের পরও পলিসিটি বিনা প্রিমিয়ামে চালু থাকে, যাতে তার মৃত্যুর পর নমিনি আরেকবার বীমা অংক পেয়ে থাকে।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : অনেক বীমা কোম্পানির গ্রাহকই প্রিমিয়াম জমা দিয়ে অনলাইন ও মোবাইলের মাধ্যমে সব তথ্য জানতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কতটা গ্রাহকবান্ধব?
অরুপ কুমার দাস : আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সম্পূর্ণ গ্রাহকবান্ধব। বাংলাদেশে এলআইসি কার্যক্রম শুরু করেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। গ্রাহক অনলাইনে পলিসি ক্রয় করা থেকে শুরু করে নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদানসহ গ্রাহক তার পলিসির সমস্ত তথ্য এলআইসি বাংলাদেশের ওয়েবসাইট থেকে পেতে পারে। তাছাড়া গ্রাহক ব্যাংকিং চ্যানেল ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রিমিয়াম প্রদান করতে পারছে। গ্রাহক যে কোনো চ্যানেলে প্রিমিয়াম জমা দেয়ার পর আমরা মোবাইলে এসএমএস করে গ্রাহককে কনফার্ম করছি।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : আপনাদের কী কী পলিসি রয়েছে?
অরুপ কুমার দাস : বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক কাঠামো বিবেচনা করে আমরা পলিসি ডিজাইন করেছি। আমাদের প্রতিটা পলিসির আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা বাজারে দৃশ্যমান। শিক্ষাবীমা থেকে শুরু করে পেনশন বীমা রয়েছে আমাদের কাছে। নারীদের জন্য রয়েছে জীবন তিলোত্তমা নামক পলিসি। জীবন রক্ষক, নবজীবন আনন্দ এবং এসবি সুবিধা নিয়ে রয়েছে বীমা ডায়মন্ড। তাছাড়া রয়েছে সিঙ্গেল প্রিমিয়াম, গ্রো ফাস্ট ও মানি ব্যাক প্ল্যান। গ্রাহকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জটিল সাতটি রোগের কভারেজ নিয়ে রয়েছে আমাদের হেল্থ প্লাস পলিসি। বাজারে সবচেয়ে আর্কষণীয় আমাদের পলিসি হলো নবজীবন আনন্দ যা গ্রাহককে মেয়াদপূর্তির দাবি পরিশোধের পরও বিনা প্রিমিয়ামে পলিসিটি চালু থাকে এবং তার নমিনিকে আরেকবার বীমা অংক পরিশোধ করা হয়।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : এলআইসি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।
অরুপ কুমার দাস : বাংলাদেশের সব জেলায় আমাদের গ্রাহকসেবা রয়েছে। আমাদের পূর্ণাঙ্গ সার্ভিস সেন্টার রয়েছে ১২টি। তাছাড়া বিভিন্ন জেলায় রয়েছে আমাদের সাংগঠনিক ও এজেন্সি অফিস। এলআইসি বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৫০০ কর্মী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে। প্রতি বছরই যথা সময়ে আমাদের অ্যাকচুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন সম্পন্ন হয়েছে। ২০২১ সালের কাজ চলছে যা আমরা শিগগিরই পেয়ে যাবো। ২০২১ এর অ্যাকচ্যুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশনের পর বর্তমান লাইফ ফান্ডের সঠিক তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে। আলফা ক্রেডিট রেটিং কর্তৃক আমরা এ প্লাস রেটিং পেয়েছি। বিগত বছরে আমাদের নেট প্রিমিয়াম ছিল ১৫ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিয়ম মেনে এলআইসি সন্তোষজনক বিনিয়োগ করছে। গত বছরে সব মিলে আমরা ২৯,৫৪৯ জন মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করেছি।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : আইডিআরএ অনুমোদনের ৩ বছরের মধ্যে একটি বীমা কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসতে হয়, আপনারা কেন এখনো আসতে পারছেন না?
অরুপ কুমার দাস : পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তির জন্য আনুষ্ঠানিক কার্যকলাপ যথানিয়মে সম্পন্ন করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি স্বল্পসময়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্র্ভুক্ত হবো।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অরুপ কুমার দাস : ধন্যবাদ আপনাকেও।
Posted ১:৪৯ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy