| শুক্রবার, ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 1079 বার পঠিত
নির্বাচনের আগে আগে সারা দেশে চালের দাম বাড়তে থাকে। পরিবহন সংকটের কথা বলে সে সময় চালের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। মূল্যবৃদ্ধির এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। মিল মালিকরাও চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। ১০ দিনের ব্যবধানে মিল পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে বস্তায় (৫০ কেজি) ২১০-২৫০ টাকা বা মণপ্রতি ১৫৮-১৮৭ টাকা। মিল পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পাইকারিতে পুরোপুরি পড়তে আরো কিছুটা সময় লাগবে। তার পরও এরই মধ্যে পাইকারিতে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ১২০-১৪৫ বা মণপ্রতি ৯০-১১০ টাকা বেড়েছে। আর খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে কেজিতে ৪ টাকা পর্যন্ত।
মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে এতদিন লোকসানে চাল বিক্রির কথা বলছেন মিল মালিকরা। মিল পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সরকারিভাবে চাল সংগ্রহকে আরেকটি কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিন দশেক আগে হাসকিং মিলে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা মিনিকেট চালের দাম ছিল ১ হাজার ৭৮০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। একই চাল গতকাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ২৩ টাকায়। এ হিসাবে মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৪০ টাকা।
এছাড়া অটো রাইস মিলে ১০ দিন আগে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চালের দাম ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা। বর্তমানে তা সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে অটো রাইস মিল পর্যায়ে মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে বস্তায় ২১০ টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মোটা চালের, প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ২৫০ টাকা। দিন দশেক আগে মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা মোটা চাল ৯৩৩ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়।
মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক কমে গিয়েছিল। এতে লোকসানে চাল বিক্রি করছিলেন তারা। লোকসান যাতে না হয়, সেজন্য দাম কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে।
নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরদ বরণ সাহা বলেন, বাজারে কিংবা মোকামে ধান-চালের সংকট নেই। তবে ভারত থেকে চাহিদার অতিরিক্ত ১৫-১৭ লাখ টন চাল আমদানি হওয়ায় বাজারে চালের দাম কেজিপ্রতি ১৩-১৮ টাকা পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। বর্তমানে দাম বাড়ানো না হলে মিলারদের উৎপাদন খরচ তোলা সম্ভব নয়। এ কারণে তারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই চালের দাম বাড়িয়েছেন।
মিল পর্যায়ে চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সেভাবে না পড়লেও পাইকারি ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়াতে শুরু করেছেন। রাজধানীর বাবুবাজার ও বাদামতলী এলাকার আড়তগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিন দশেকের ব্যবধানে এসব বাজারে চালের দাম বেড়েছে বস্তায় (৫০ কেজি) ১২০-১৪৫ টাকা। ১০ দিন আগেও রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা মিনিকেট চালের দাম ছিল ২ হাজার ১৪৩ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা। একই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৯৫ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়।
এ বাজারের মেসার্স মতিন রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আবদুর রশিদ জানান, ১০ দিন আগেও কুষ্টিয়ার মেসার্স রশিদ এগ্রোফুডের ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম ছিল ২ হাজার ৩৫০ টাকা। বর্তমানে তা ২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। মিল থেকে দাম বাড়িয়ে দেয়ায় আমরাও বাড়তি দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।
মিল ও পাইকারিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোয় মানভেদে প্রতি কেজি উন্নত মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬২, সাধারণ মানের ৫৪-৫৮, মাঝারি মানের ৪৪-৫২ ও মোটা চাল প্রতি কেজি ৩৮-৪২ টাকায়। ১০ দিন আগেও এসব চাল কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল।
খুচরা পর্যায়ে চালের মূল্যবৃদ্ধির তথ্য রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানেও। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে বোরো সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ টাকা। আর কেজিপ্রতি ২ টাকা বেড়েছে বোরো মাঝারি চালের দাম। গত সপ্তাহে বোরো সরু চাল প্রতি কেজি ৫২ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে কিনতে হচ্ছে ৫৬ টাকায়। একইভাবে ৪০ টাকা কেজি দরের বোরো মাঝারি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়।
চট্টগ্রামেও দিন দশেকের ব্যবধানে পাইকারিতে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০-১৪৭ টাকা পর্যন্ত। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিন দশেক আগে পাইকারিতে প্রতি বস্তা জিরাশাইল চাল ২ হাজার ৩৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৯০ টাকায়। প্রায় একই হারে বেড়েছে মিনিকেট (সিদ্ধ), মিনিকেট (আতপ) ও পারি (সিদ্ধ) চালের দাম।
মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে চাক্তাইয়ের ছাত্তার অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী শান্তি দাশগুপ্ত বলেন, নির্বাচনের আগে প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া ১০-১২ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। এ কারণে চালের দাম বাড়তি ছিল। এছাড়া কয়েক মাস ধরে বস্তাপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা লোকসানে থাকায় ব্যবসায়ীরা এখন বাড়তি দামেই চাল বিক্রি করছেন। সরকারের চাল সংগ্রহ কর্মসূচি শেষ হলে বাজার আবার স্থিতিশীল হতে পারে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবে দিনাজপুর, রংপুর থেকে চট্টগ্রামে চালবাহী ট্রাকের ভাড়া ছিল গড়ে ২৫-২৬ হাজার টাকা। কিন্তু নির্বাচনকালে ট্রাক ভাড়া ১০-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৪০ হাজার টাকায় উঠে যায়। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী যানবাহন না থাকায় ভাড়াও বেড়ে যায়। এতে পণ্য পরিবহনে বেগ পেতে হয় ব্যবসায়ীদের, যা পণ্যের দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু নির্বাচন শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও সরকারের চাল সংগ্রহ কর্মসূচির পর মূল্যবৃদ্ধির আশায় অনেক প্রতিষ্ঠানেই মজুদপ্রবণতা বেড়ে গেছে। এ কারণে বাড়তি দামেই চাল বিক্রি করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স মজুমদার ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সাবের আহমদ বলেন, চালের দাম কম থাকায় ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনকালে দাম কিছুটা বেড়েছে। নির্বাচন শেষে এ দাম আপাতত কমছে না। তবে এবার ধানের ফলন ভালো হওয়ায় দাম বিগত বছরের মতো অস্বাভাবিক হবে না।
ঢাকা-চট্টগ্রামের মতোই চালের দাম বেড়েছে খুলনায়ও। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের তুলনায় এ মাসের প্রথম সপ্তাহে খুচরায় চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ টাকা পর্যন্ত। নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের চাল ব্যবসায়ী লাল মিয়া জানান, সরকারের আমন সংগ্রহের কারণে সিদ্ধ চালের ক্রয়মূল্য বেশি এবং শুক্র থেকে বুধবার পর্যন্ত পরিবহন বন্ধ থাকায় উত্তরাঞ্চল থেকে চাল আসতে না পেরে দাম বেড়েছে।
একই বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী করিম স্টোরের মালিক আব্দুল করিম জানান, ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের তুলনায় এ মাসের প্রথম সপ্তাহে চালের দাম গড়ে কেজিতে ৪ টাকা বেড়েছে। মোটা চাল ৩২ টাকার পরিবর্তে ৩৬, মাঝারি চাল ৪২ টাকার পরিবর্তে ৪৮ ও চিকন চাল ৫২ টাকার পরিবর্তে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মাদ তানভীর রহমান জানান, আমন সংগ্রহের মৌসুমে সরকারি ক্রয়মূল্য বেশি হওয়ায় বাজারে চালের দাম বেড়েছে। এবার কৃষকের লোকসানের আশঙ্কা নেই।
দেশে চালের বড় অংশ আমদানি হয় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। আমদানি বর্তমানে শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। তবে ধানের দাম খানিকটা বাড়ায় বেড়েছে চালের দাম। দিন দশেকের ব্যবধানে হিলিতে পাইকারিতে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ৭৫-১০০ টাকা।
হিলি বাজারের চাল বিক্রেতা অনুপ বসাক বলেন, বাজারে দেশী স্বর্ণা জাতের চাল দিন দশেক আগে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন তা ৩২ টাকায় উঠেছে। রত্না জাতের চাল (২৮) ৩২ থেকে বেড়ে ৩৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৪৬ থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়।
সূত্র : বণিক বার্তা।
Posted ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ জানুয়ারি ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed