বিবিএনিউজ.নেট | রবিবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট | 524 বার পঠিত
রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট শাখায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় জমা হয় আরেকটি ব্যাংকের একটি চেক। চেকের নম্বর ও স্বাক্ষরে মিল থাকায় ১৫ লাখ টাকার চেকটি মূল ব্যাংক অর্থছাড়ের অনুমতি দেয়। পরবর্তীকালে হিসাবধারী গ্রাহক তার ব্যাংকে গিয়ে জানান, ওই অর্থের চেক তিনি কাউকে দেননি। এতে সমস্যায় পড়ে দুটি ব্যাংক। শেষমেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গ্রাহক তার হারানো টাকা ফেরত পান। এরকম অভিযোগ এখন নিয়মিত জমা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমানে এমআইসিআর চেক ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পূর্বের চেকের চেয়ে বেশি নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি। কিন্তু প্রতারকচক্র প্রথমে একটি ব্যাংকের হিসাবে কত টাকা আছে, তার তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীকালে ওই হিসাব নম্বরের কাছাকাছি কোনো গ্রাহকের চেক সংগ্রহ করে। এরপর চেকের ১৩ ডিজিটের নম্বরের কয়েকটি বা পুরো নম্বর পরিবর্তন করে ফেলে। এই পরিবর্তনকাজ করা হয় খুবই সূক্ষ্ম কৌশল ও দক্ষতার সঙ্গে। খালি চোখে যা ধরা পড়ে না।
চেকটির মাধ্যমে নগদ বা আরেক ব্যাংক হিসাবে জমা করার মাধ্যমে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়। হিসাবে স্থানান্তরিত হওয়া অর্থ পরে নিজ চেকের মাধ্যমে তুলে নিচ্ছে প্রতারকচক্রটি।
অবশ্য জানা গেছে, এভাবে তুলে নেওয়া অর্থের পরিমাণ সাধারণত চার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি হচ্ছে এ প্রতারণা। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত এলকায়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের যাচাই করার সুযোগ না থাকায় প্রবাসীদের হিসাব থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়ার প্রবণতাই বেশি।
এ বিষয়ে বেসরকারি এক ব্যাংকের আইটি বিভাগের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমআইসিআর চেক যাচাই করার জন্য বেশ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এজন্য ব্যাংকারদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। এরপরও প্রতারণার হার যে শূন্যে নেমে এসেছে তা বলা যাবে না। অনেক সময় দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার এ বিষয়ে সতর্ক থাকছেন না; কিন্তু পূর্বের চেয়ে এমন ঘটনা কমে আসছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, অনেক প্রবাসীই দেশে থাকা অবস্থায় ব্যাংকে হিসাব খোলেন। এ সময় তার নমিনিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যান। প্রয়োজনীয় অনুপাতে একই সঙ্গে পুরো চেকবই সই করে চলে যান। পরবর্তীকালে প্রতি মাসে বা প্রয়োজনে তার স্বজনরা চেকে টাকার পরিমাণ বসিয়ে অর্থ তুলে নিয়ে যান। এ সুযোগটাই নিচ্ছে প্রতারকরা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংকার জানান, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে এখন থেকে ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উঠানো ও জমা হওয়ার পর হিসাবধারীর মোবাইল নম্বরে একটি এসএমএস যায়। এভাবে সব লেনদেনের তথ্য জানতে পারেন একজন গ্রাহক। কিন্তু প্রবাসীরা দেশের বাইরে থাকায় তার পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছে না হিসাব লেনদেনের তথ্য।
অপরদিকে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়া হিসাবের একটি অংশ নারীদের। বর্তমানে এরকম অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, পুরোনো চেক ব্যবস্থা থেকে নতুন এমআইসিআর পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হওয়ার সময় কিছু ঘটনা ঘটেছে। তখন ব্যাংকগুলোর সব শাখায় চেক যাচাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না। আবার হিসাবগুলোর তথ্য হালনাগাদ (কেওয়াইসি ফরম) করা হয়নি গ্রাহককে না পেয়ে। এজন্য ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফোন দেওয়া হলে দ্রুত সাড়া দিতে হবে গ্রাহককে।
প্রবাসী হিসাবধারীদের বিষয়ে জালিয়াতির বিষয়ে এই ব্যাংকার বলেন, প্রবাসীরা তাদের হিসাব ফরমের তথ্যে একটি দেশীয় মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যেতে পারেন। তার সব লেনদেনের তথ্য ওই মোবাইল ফোনে চলে যাবে। এটি বিদ্যমান পদ্ধতিতেই সম্ভব।
নিজ হিসাব থেকে চার লাখ টাকা অনুমোদন ছাড়াই তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন এক নারী। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্তে নামে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, সবখানেই একই জালিয়াতির কৌশল নেওয়া হয়েছে। অর্থ সরিয়ে নেওয়ার পর ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ধরনা দিয়েও সুরাহা পাননি অনেকে। একই সময় অভিযোগটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানান তারা। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলো নিজ তহবিল থেকে অর্থ ফেরত দিয়েছে প্রকৃত হিসাবধারীদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক কর্মকর্তার অসতর্কতা বা গাফিলতির কারণে কোনো হিসাবধারীর অর্থ তসরুপ বা খোয়া গেলে ব্যাংককেই তা পূরণ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিয়েছে। এখন ব্যাংক কোন খাত থেকে বা কীভাবে এ অর্থ আদায় করবে, তা তাদের বিষয়।
জানা গেছে, জালিয়াতির এসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জানানো হয়েছে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এসব বিষয় নিয়ে কাজও করছে।
অপরদিকে এরকম জালিয়াতির ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন ব্যাংকের ক্যাশ বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা জানান, চেকের ১৩ ডিজিটের নম্বরসব অন্যান্য নম্বরও খুবই কৌশলে সূক্ষ্মভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে, যা খালি চোখে ধরা মোটেই সম্ভব নয়। আমরা সাধারণত চেকে থাকা হিসাব নম্বর ও চেক নম্বর মিলিয়ে দেখি। এরপরই হিসাবধারীর স্বাক্ষর মেলাই। সন্দেহ না হলে অর্থ ছাড় করে দিই। প্রতিটি চেকের বিপরীতে অর্থ দেওয়ার সময়ে গ্রহীতার মোবাইল নম্বর চেকের উল্টো পাতায় লিখিয়ে রাখি। কিন্তু কখনই ওই নম্বর সঠিক কি না, এটি দেখা হয় না। এটি দেখাও সময়সাপেক্ষে। এটি করতে হলে লেনদেন সময় ও জটিলতা বৃদ্ধি পাবে।
Posted ৩:০১ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed