বুধবার ৯ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও তার নেতিবাচক প্রভাব

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   361 বার পঠিত

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও তার নেতিবাচক প্রভাব

চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সামঞ্জস্য না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৭ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাধারণত দেখা যায়, বাজারে যখন সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকে, তখন জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পায়। জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে অনেকে মজুদ করে রাখে। তখন বাজারে একটা কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি হয় এবং যখন এই মূল্যস্ফীতি চাপ মানুষের উপর পড়ে তখন সামগ্রিকভাবে মানুষের আয়ের উপর চাপ বাড়ে। তাই জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ সহ ভোক্তারা। আর যারা সাধারণ মধ্যবিত্ত তাদের সমস্যাও প্রকট।

গত ৪ নভেম্বর ২০২১ ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটারে ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে সময় মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের মূল্য ক্রমবর্ধমান। বিশ^বাজারে উর্ধ্বগতির কারণে প্রতিবেশি দেশসহ বিশে^র অন্যান্য দেশ জ¦ালানি তেলের মূল্য নিয়মিত সমন্বয় করছে। গত ১ নভেম্বর ভারতে ডিজেলের মূল্য ছিল প্রতি লিটার ১২৪.৪১ টাকা বা ১০১ দশমিক ৫৬ রুপি। অথচ বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ৬৫ টাকা অর্র্থাৎ লিটার প্রতি ৫৯ টাকা ৪১ পয়সা কম। বর্তমান ক্রয়মূল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ডিজেল লিটার প্রতি ১৩ টাকা ০১ পয়সা এবং ফার্নেস অয়েলে লিটার প্রতি ৬ টাকা ২১ পয়সা কমে বিক্রি করায় প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। অক্টোবর ২০২১ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিভিন্ন গ্রেডের পেট্রোলিয়াম পণ্য বর্তমান মূল্যে সরবরাহ করায় মোট ৭২৬ দশমিক ৭১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার শুধু ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটার প্রতি ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করেছে। এই অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেয় জ¦ালানি মন্ত্রণালয়। আইন অনুযায়ী, এই দুটো পণ্যের দাম বৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে গণশুনানির আয়োজন করতে হয়। ওই শুনানিতে ভোক্তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে করপোরেশনের প্রতিনিধিদের যুক্তি তর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে একটি জাতীয় প্রস্তাবনা পাশ হয় এখানে তা অনুপস্থিত। জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রত্যক্ষ অভিঘাত এবার সরাসরি জনসাধারণের ওপর পড়লো। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে কৃষিখাতে। কৃষিখাতের ডিজেলের চাহিদা মোট ডিজেল আমদানির ১৮ শতাংশ। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল এই সময়টাই ডিজেলের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশের ধান উৎপাদনে বড় আবাদ হয় এই বোরো মৌসুমে। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বোরো চাষে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশে প্রতি বিঘা জমিতে সেচ ও চাষ দিতে দরকার ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকদের বিঘা প্রতি ৩০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। এতে মুনাফা ও আয় ৩ শতাংশ কমে যাবে। এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকের সেচ বাবদ খরচ হবে ৭৫৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। দেশে মোট উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। কৃষককে এর জন্য জমিতে ভূগর্ভস্থ সেচের পানি দিতে হয় শ্যালো এবং ডিপটিউবওয়েল ব্যবহার করে। দেশে ধান উৎপাদনে মোট সেচের ৯৩ ভাগ সেচই প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। সেচযন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেল চালিত। ফলে এবার বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে অনেক। ফলে বাড়বে চালের দাম। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ একটি জরিপে জানা যায়, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে দেয়া করোনা বিধি-নিষেধের কারণে গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমন একটি করুণ পরিস্থিতিতে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধাপকে অবনমন করবে। জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপরও প্রভাব পড়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতেও প্রভাব পড়বে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ¦ালানি তেল ব্যবহার করা হয়। করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে অর্থনীতি সংকুচিত অবস্থায়। সেখানে জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে আমি মনে করি। দেশে রেণ্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের অনেকগুলোই জ¦ালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি খেটে খাওয়া গরিব মানুষের জীবন মানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। কারণ দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষরাই মূলত কেরোসিন ব্যবহার করে থাকে। এই মূল্যবৃদ্ধি তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দিবে। এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহন মালিকদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ তারা তো ঠিকই দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ সমন্বয় করে নিচ্ছেন। বাস এবং লঞ্চে রেকর্ড পরিমাণ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত জ¦ালানির এই মূল্যবৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা ভোক্তাকেই দিতে হচ্ছে। জ¦ালানি তেলের দামবৃদ্ধি না হলে দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনা স্থিতিশীল থাকত। কেননা শিল্পের উৎপাদন খরচ কমলে বাজারে তার প্রভাব পরে এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ও হ্রাস পায়। অপরদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি হবে এবং এর প্রভাব বাজারে পড়বে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।

দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশে তেল পাচার হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট তথ্য সূত্র মোতাবেক, প্রতিটি ১০ চাকার ট্রাকের ট্র্যাংকে ৪৫০ লিটার তেল ধরে। প্রতিদিন এমন চারশো ট্রাক পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে আসে। ওপারের ট্রাকগুলো ট্র্যাংক প্রায় খালি করে ঢোকে আর যাওয়ার সময় তারা ট্র্যাংক পুরোটাই ভর্তি করে নিয়ে যায়। তারপরেও ভারত বাংলাদেশের মধ্যেকার চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে যেখান দিয়ে ছোট ছোট জ্যারিকেন বা কন্টেনারে করে ডিজেল পাচারের ঘটনা হতে পারে। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি হতে পারে না। কারণ পণ্য পাচার ঠেকানোর দায়িত্ব সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। তাই তাদের ব্যর্থতা যদি থাকে ও তার জন্য দেশের পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে দেয়া ঠিক নয়।

জ¦ালানি বিভাগের তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ মোট তেল আমদানির ৭৩ শতাংশই ডিজেল। এ ছাড়া প্রতি লিটার ডিজেল আমদানিতে সরকার ভ্যাট বাবদ ১৯ টাকা আদায় করে। শুল্ক হ্রাস করেও লোকসান কমানো যেত। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী বছরে ২০১৯ সালে বিশে^ জ¦ালানি তেলের দাম ছিল গড়ে ৫৬ দশমিক ৯৯ ডলার। তবে ওই বছর কোন একটি সময়ে সর্বোচ্চ ৬৬ ডলারে জ¦ালানি তেল বিক্রি হয়েছে। আবার ২০১৮ সালে গড় দাম ছিল ৬৫ দশমিক ২৩ ডলার। ওই বছর সর্বোচ্চ দাম ছিল ৭৭ দশমিক ৪১ ডলার একইভাবে ২০১৭ সালে গড় দাম ছিল ৫০ দশমিক ৮০ ডলার। ওই বছর সর্বোচ্চ ৬০ দশমিক ৪৫ ডলারেও তেল বিক্রি হয়েছে। আবার করোনা ভাইরাসের মহামারী শুরু হওয়ার পর যখন গত ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে কমতে প্রতি ব্যারেল ৩৭ মার্কিন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে তিন মাস সময় লেগে যায়। প্রতি দিনের তেল তো আর (বিপিসি) প্রতিদিন কিনে আনে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে তখন তারা দাম কমান না। গত ২৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের মূল্য ছিলো ৭২ দশমিক ৭২ ডলার, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ৮ শতাংশ কম। করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রনের কারণে আরো কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দরপতন বিশ^ অর্থনীতির সবচেয়ে ইতিবাচক খবর। আর তাই জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে কমিয়ে করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের গতিশীল অর্থনীতি বড় ধরনের পরিবর্তন আনয়ন করতে পারে।

 

 

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:২৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।