এম এ খালেক | রবিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 279 বার পঠিত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্ব করোনার কারণে নানাভাবে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি হচ্ছে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ,পারিবারিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রেই। করোনার কারণে মানসিক ক্ষতিজনিত হতাশা বৃদ্ধি বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। মানসিক হতাশা বর্তমানে উদ্বেগজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মেন্টাল ডিপ্রেশন ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে মানসিক উৎকণ্ঠা বাড়ছে। মানসিক উৎকণ্ঠা বা উদ্বেগ দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা ক্ষতিকর বা আদৌ কোনো ক্ষতি করছে কিনা তা নিয়ে এর আগে তেমন কোনো জরিপ হয় নি। তাই বিষয়টি এক অর্থে নতুনই বলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, মেন্টাল টেনশনের কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। বর্তমানে মেন্টাল টেনশনের কারণে প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
এটি বিস্ময়কর একটি পরিসংখ্যান। আগে কখনোই এমন পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় নি। বিশ্বব্যাপী নানা কারণেই মানসিক হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক ছাড়াও পেশাগত কারণে অনেকের মাঝে হতাশা বা ডিপেশনের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই হতাশা নিয়ে অনেকের মাঝেই কোনো ধরনের উদ্বেগ বা সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না। যারা মেন্টাল ডিপ্রেশনে ভোগেন তারা একে কোনো সমস্যা বলেই মনে করেন না। বিশ্বব্যাপী পারিবারিক কারণেই সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে এই করোনাকালে পৃথিবীর সব দেশেই মেন্টাল ডিপ্রেশনের মাত্রা এবং আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। ঘরে বন্দি থাকা এবং ইচ্ছে মতো বাইরে বেরুতে না পারার কারণে অনেকেই এক ধরনের হতাশায় ভুগছে।
এছাড়া করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন অথবা কর্র্মস্থলে প্রত্যাশিত আর্থিক সুবিধা হারিয়েছেন। এমন ক্ষেত্রে পরিবারের ব্যয় নির্বাহের বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মেন্টাল ডিপ্রেশন। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেন্টাল ডিপ্রেশন সৃষ্টি হলে একজন মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তার কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা সাংঘতিকভাবে কমে যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কাজের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়তে পারেন। এটা তার কর্মদক্ষতা বিপন্ন করার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ডিপ্রেশনকে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা বলেই মনে করা হয় না। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে ডিপ্রেশনকে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে মনে করা হয়। বাংলাদেশে কত সংখ্যক মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট। তাই সমস্যাটি কতটা জটিল তা অনুধাবন করা যায় না। ডিপ্রেশনকে কোনো জটিল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। তাই পরিবারে কেউ একজন মেন্টাল ডিপ্রেশনে ভুগলেও পরিবারের অন্য সদস্যারা তাকে কোনো সমস্যা বলে মনে করেন না।
তারা মনে করেন, ডিপ্রেশন সাময়িক সমস্যা এবং এক সময় এমনিতেই তা সমাধান হয়ে যাবে। এ জন্য কোনো ডাক্তার বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের নিকট যাবার প্রয়োজন বোধ কতরেন না। কিন্তু এই ধারনা মোটেও ঠিক নয়। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করালে মেন্টাল ডিপ্রেশন অনেকটাই নিরসন করা সম্ভব। কিন্তু এটাকে কোনো সমস্যা মনে না করে অবহেলা করা হলে জটিল সমস্যায় পরিণত হতে পারে। আমরা প্রায়শই প্রেমে ব্যর্থ কিশোর-কিশোরিদের আত্মহত্যার খবর পাই। অনেক সময় পরিণত বয়সের মানুষও প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে।
মানুষের মনের ওপর ডিপ্রেশন মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। যারা এই চাপ সহ্য করার মতো ক্ষমতা রাখেন না মূলত তারাই আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আত্মহত্যাকারি একজন মানুষ মনে করেন পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তার বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন। এই মানুষটিই যদি সময় মতো মানসিক চিকিৎসা পেতেন তাহলে তার পক্ষে আত্মহত্যা করার প্রয়োজন হতো না। তাকে শুধু বুঝানো দরকার ছিল, তার মতো এমন সমস্যা অনেকেরই হচ্ছে। তাই আত্মহত্যা করার কোনো মানে হয় না। মেন্টাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত একজন মানুষের কর্মদক্ষতা অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। কারণ তিনি ডিপ্রেশনকালিন সময় তিনি নির্দিষ্ট সমস্যা ব্যতীত অন্য কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, কোনো মানুষ তার উদ্দিষ্ট কাজে একান্ত মনোযোগি হতে না পারলে সর্বোত্তমভাবে সেই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
দেখা যায়, একই গ্রেডের একজন কর্মী যখন তার কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করছেন ঠিক তখনই মেন্টাল ডিপ্রেশন আক্রান্ত মানুষটি সেই সাধারণ কাজটিও সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারছেন না। বার বার জানা কাজটিও করতে তিনি ভুল করছেন। মেন্টাল ডিপ্রেশন একজন মানুষের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তারা চাইলেও সাধারণ-স্বাভাবিক মানুষের মতো কাজ করতে পারেন না। তারা পদে পদে লাঞ্ছিত হতে থাকেন। স্মর্তব্য, কোনো অনিচ্ছুক ঘোড়াকে জোর করে পানিতে নামানো যায় কিন্তু তাকে তাকে জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পানি পান করানো যায় না। তেমনি একজন মেন্টাল ডিপ্রেশন আক্রান্ত মানুষকে কোনো কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে কিন্তু তাকে দিয়ে উদ্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করানো সম্ভব নয়। তার ইচ্ছে হবে না কাজটি সম্পন্ন করার জন্য।
এছাড়া তার কর্মক্ষমতাও হ্রাস পাবে। ফলে চাইলেও কাজটি তাকে দিয়ে করানো সম্ভব হবে না। নানা কারণেই একজন কর্র্মীর মাঝে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। কেউ যদি অফিসে তার যোগ্য সম্মান না পান অথবা আর্থিক সুবিধা থেকে কঞ্চিত হন তাহলে তার মাঝে হতাশা জন্ম নিতে পারে। যারা চাকরি করেন তাদের জন্য অফিসের কর্ম পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। কোনো অফিসের কর্মপরিবেশ যদি ভালো এবং কাজ করার মতো অনুকূল হয় তাহলে সেই অফিসের কর্মীদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কম থাকে।
এ ক্ষেত্রে এমপ্লয়ারের আচরণও একটি অফিসের কর্ম পরিবেশ উন্নত এবং গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একজন এমপ্লয়ার যদি তার অফিসের কর্মীদের সঙ্গে বন্ধু সুলভ আচরণ করেন তাহলে সেই অফিসের কর্ম পারিবেশ নষ্ট হবার আশঙ্কা থাকে না। একই সঙ্গে এ ধরনের অফিস পরিবেশে একজন কর্মী তার সর্বোচ্চ দক্ষতা দিয়ে কর্ম সম্পাদন করতে পারবেন। কথায় বলে, কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্টি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু অনেকেই এই বিষয়টি অনুধাবন করতে চান না।
দেশের তৈরি পোশাক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কাজ করেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিকদের তুলনামূলক কম বেতন-ভাতায় কাজ করানো যায়। কিন্তু এই সব নারী শ্রমিক কিভাবে বা কোন পরিবেশে কাজ করেন তা কি আমরা ভেবে দেখি? অনেকেই তাদের ছোট বাচ্চাকে বাসায় রেখে কারখানায় কাজ করতে আসেন। এদের পক্ষে কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথচ অফিসে যদি ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে তাদের নিকট থেকে সর্বোত্তম কাজ আদায় করা সম্ভব। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের নারী কর্মীদের বাচ্চা রাখার জন্য ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অনেকেই এটাকে অপচয় মনে করতে পারেন। কিন্তু আসলে এটা কোনোভাবেই অপচয় নয়। বরং এটা কারখানার কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পক্ষে একটি কার্যকর কৌশল।
একটি ডে-কেয়ার তৈরি করা হলে যে ব্যয় হবে তার চেয়ে অনেক বেশি বর্ণিত কর্মীদের নিকট থেকে উৎপাদনশীলতা আদায় করে নেয়া সম্ভব। এটা কোনোভাবেই অপচয় নয়। তাই যেসব কারখানায় নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন তাদের সবারই উচিৎ হবে ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরি করা। অনুকূল কর্মপরিবেশ তৈরি করা একজন কারখানা মালিকের অন্যতম দায়িত্ব। আর যারা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন অথবা অন্য কোনো কর্মে নিয়োজিত আছেন তাদের হতাশা অতিক্রম করার কৌশল জানতে হবে।
কোনো কারণে হতাশার সৃষ্টি হলে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। হতাশামুক্ত ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে, হতাশার পরই কোনো ভালো সংবাদ আসতে পারে যা তাকে উদ্বুদ্ধ করবে। কথায় বলে, ‘রাত যত গভীর হয়, ভোরের সূর্য ততই নিকটবর্তী হয়।’ অর্থাৎ রাতের পর দিন আসে। আর হতাশার পর আশার সংবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেউ যদি হতাশার পর কোনো আশার সংবাদ পায় তাহলে তার হতাশা মুহূর্তে উবে যেতে পারে।
হয়তো কোনো একজন চাকরি না পেয়ে হতাশ। তিনি যদি অপ্রত্যাশিত বা প্রত্যাশিতভাবে চাকরি পাবার সংবাদ পান তাহলে মুহূর্তের মধ্যে তার মন ভালো হয়ে যাবে। তিনি আগের চেয়েও বেশি উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারবেন। এটাই বাস্তবতা। তাই কোনো কারণে হতাশার সৃষ্টি হলেও ভেঙ্গে পড়তে নেই। কারণ যিনি হতাশ হন পরক্ষণেই তিনি আবারো উদীপ্ত হবার মতো খবর পেতে পারেন। একজন মানুষ হতাশ হলে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাই কোনোভাবেই হতাশা কাম্য হতে পারে না। মানুষ যখন আর্থিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তার মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে।
এই অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের উচিৎ হবে তাকে মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধ রাখা, সাপোর্ট দেয়া। হতাশ মানুষ মনে করে, তার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। অর্থাৎ তহার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। তার মাঝে স্বাভাবিক বোধশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। তাকে বুঝাতে হবে, একজন মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, কাজেই তা কখনোই অর্থহীন হতে পারে না। উত্থান-পতন হতেই পারে কিন্তু জীবন কখনোই অর্থহীন হয় না। জীবনকে জীবনের মতোই চলতে দিতে হবে। তাহলেই জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। কোনোভাবেই হতাশ হলেই আত্মহত্যার চিন্তা করা ঠিক হবে না।
এম এ খালেক
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক
Posted ৫:২৮ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy