আদম মালেক | ০২ জানুয়ারি ২০২১ | ৩:০৪ অপরাহ্ণ
বিদায়ী বছরে বেশি বিপাকে পড়েছে ব্যাংক খাত। বেড়েছে অলস টাকা, কমেছে বিনিয়োগ। এসেছে নতুন ব্যাংক। রেকর্ড ভেঙেছে রেমিটেন্স। করোনায় ভরসা বেড়েছে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে। নিয়ন্ত্রণহীন অর্থপাচার। ফেরত দিতে রাজি হয়নি সুইস ব্যাংক। আমলে এসেছে সিঙ্গেল ডিজিট। ভাটা পড়েছে মুনাফায়। করোনার অজুহাতে ঘটেছে কর্মী ছাঁটাই। প্রাণ হারায় অনেকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে ঘটেছে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। তাই ব্যাংকিং খাতে বেড়েছে অনিয়ম। অনিয়মে প্রশ্রয়ের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছে অডিট ফার্ম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞায় প্রদর্শন হয়নি বাড়তি খেলাপি। মেয়াদ অতিক্রান্ত হলেই বেরিয়ে পড়বে খেলাপি। সহসাই শোধ হবে না। তাই ব্যাংকগুলো বিদায়ী বছরের গøানি বহুদিন বইবে বলে শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, আগামী দুই-এক বছরে ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হবে। ছাড় দেয়ার কারণে যাদের খেলাপি হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, তাদের বিষয়টি তো আর বছরের পর বছর আটকে রাখা যাবে না। এক সময় এসব ঋণ খেলাপি ঋণে চলে আসবে। তখন খেলাপি ঋণগুলো ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অধিকাংশ সময় তাদের কাছে তথ্য চেয়েও সব পাওয়া যায়নি। মাত্র দুটি ইস্যুতে সুইস ব্যাংক কিছু তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশকে। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সমঝোতা
বিদায় বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। ওই দেশের প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে কারো নাম উল্লেখ নেই।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে সবার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর পদ্ধতিগতভাবে এগোতে হবে। তাহলে সুফল পাওয়া যাবে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়মে প্রশ্রয়ের দায়ে আঘাত এসেছে অডিট ফার্মগুলোর ওপর। বিগত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ৩৬টি প্রতিষ্ঠান। আগে ৭৫টি থাকলেও নতুন দুটিসহ এখন তালিকাভুক্ত অডিট ফার্ম রয়েছে ৩৭টি। বাদপড়া ৩৬টি ফার্মের মধ্যে রয়েছে, এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোং, মাহফেল হক অ্যান্ড কোং, শফিক বসাক অ্যান্ড কোং, আহমদ অ্যান্ড আখতার, আহমেদ মাসুক অ্যান্ড কোং, আতা খান অ্যান্ড কোং, পিনাকী অ্যান্ড কোং, আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোং, মালেক সিদ্দিকী ওয়ালী, সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং, এ মতিন অ্যান্ড কোং, কে এম আলম অ্যান্ড কোং, আর্টিসান, এ হক অ্যান্ড কোং, ফেমস অ্যান্ড আর, হুদা হোসাইন অ্যান্ড কোং, রহমান আনিছ অ্যান্ড কোং, এবি সাহা অ্যান্ড কোং, ইসলাম জাহিদ অ্যান্ড কোং, মিজান ইসলাম অ্যান্ড কোং, খান আইয়ুব, শফিক মিজান রহমান অগাস্টিন, হাবিব সরোয়ার ভূঁইয়া অ্যান্ড কোং, রহমান কাসেম অ্যান্ড কোং, জেআর চৌধুরী অ্যান্ড কোং, মোহাম্মাদ আতা করিম অ্যান্ড কোং, আখতার আমির অ্যান্ড কোং, নূরুল আজিম অ্যান্ড কোং, দেওয়ান নজরুল ইসলাম অ্যান্ড কোং, আহসান জাকির অ্যান্ড কোং, আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোং, তখতিয়ার হুমায়ন অ্যান্ড কোং, আশরাফ উল হক নবী অ্যান্ড কোং এবং রহমান মুস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোং। এ ছাড়া গত বছর নাম না থাকলেও এবার যোগ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে আহসান মঞ্জুর অ্যান্ড কোং এবং চৌধুরী ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং।
করোনা সংকটের মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের ইতিহাসে বারবার রেকর্ড ভেঙেছে। সংকটকালীন মুহূর্তে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই ছিল দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। মহামারীর মধ্যে গেল মাসগুলোর পাঠানো রেমিট্যান্স অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। যদিও বিদেশ থেকে হাজার হাজার কর্মীদের দেশে ফেরত আসা, চাকরি হারানোয় সামনের দিনগুলোতে খারাপ পরিস্থিতিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ বা ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন রেমিট্যান্স এসেছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স এসেছে ৮৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ৬১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
গত কয়েক বছর ধরেই রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দশ বছর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের ৩০ জুন সেই রিজার্ভ বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ৬ মাসের মধ্যে রিজার্ভ আরেকটি রেকর্ড ভেঙে ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করল। সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর এই মজুত ৪২ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ডে উন্নীত হয়েছিল।
অনেক আলোচনার মধ্যে ব্যাংকঋণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে বাস্তবায়ন হওয়ার খবরও বিদায়ী বছরের আলোচিত খবর। করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে এক অঙ্কে সুদহার ছিল অন্যতম সহায়ক সংযোজন। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
করোনা সংকটে ব্যাংক খাত ছিল মুনাফাবিমুখ। প্রতিবছর লাভের আশা করলেও সংকটকালীন মুহূর্তে লাভকে প্রাধান্য না দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গ্রাহকদের পাশে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার লড়াই করেছে ব্যাংকগুলো। বিদায়ী বছরে অর্থনীতির ক্ষতি মোকাবেলায় ঋণ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা, এক অঙ্কে সুদহার নির্দেশনাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নির্দেশনা জারিতে বিদায়ী বছরটা ছিল ব্যাংক ব্যবসার ভাটার বছর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো আদায় করেছে ৯৯৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কম। একই সময়ে নিয়মিত ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে আদায় থেকে কম হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এখনও বিষফোঁড়া। করোনা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দিকবিবেচানায় নানা সুবিধা প্রদান করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের উল্টো চিত্র দেখালো ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ (জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। জুন প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণের ৯ শতাংশ। অন্যদিকে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। প্রকৃতভাবে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। করোনায় অর্থনীতির ক্ষতি বিবেচনায় তিন দফায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাউকে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনা প্রত্যাহার করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আবার বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
করোনায় আর্থিক দুর্যোগে ব্যাংক খাতে কর্মী ছাঁটাই আতঙ্কও ছিল বিদায়ী বছরের সবচেয়ে অমানবিক খবর। করোনা দুর্যোগে বহু কর্মীকে ছাঁটাই করেছে কয়েকটি ব্যাংক। যদিও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়ে কেউ কেউ চাকরি ফিরে পেয়েছেন। ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি বেতন-ভাতাদিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা কমানোর ঘোষণাও দিয়েছে অনেক ব্যাংক। পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাংক বেতন না কমানোর ঘোষণাও দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে বিদায়ী বছরটি ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও হতাশার বছর ছিল।
করোনা মহামারীর শুরুর দিকে সরকারি সব অফিস আদালতে যখন ছুটি ঘোষণা করা হয়। তখন ব্যাংক কর্মকর্তা, ডাক্তার, স্বাস্থ্যসেবা-কর্মী, পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সম্মুখযোদ্ধাদের ন্যায় ব্যাংককর্মীদের কার্যক্রমও ছিল চোখে পড়ার মতো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকিংসেবা দিয়ে কতজন ব্যাংকার আক্রান্ত হয়েছেন তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব না থাকলেও এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪০ জন ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু এবং প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্ডার অনুযায়ী, ৬৫ বছরের বেশি হলে কেউ গভর্নর থাকতে পারবেন না। বর্তমান গভর্নরকে নিয়োগ দিতে সংশোধন করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। এখন থেকে যারাই গভর্নর হিসেবে থাকবেন সংসদে বিল পাস না হওয়া পর্যন্ত ৬৭ বছর পর্যন্ত চাকরি করতে পারবেন।
করোনাকালে সিটিজেন ব্যাংক লিমিটেড নামে আরো একটি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ৫শ’ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনসহ প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণসাপেক্ষ ব্যাংকটির কার্যক্রম পরিচালনা করার চ‚ড়ান্ত অনুমতি দেয়া হয়েছে। নতুন এ ব্যাংক নিয়ে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬১টি।
বাংলাদেশ সময়: ৩:০৪ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২১
bankbimaarthonity.com | Sajeed