• অপরিশোধিত জ্বালানি তেল

    বিশ্বের সর্বোচ্চ মজুদ বিপদ বাড়িয়েছে ভেনিজুয়েলার

    সিএনএন, এএফপি ও অয়েলপ্রাইসডটকম অবলম্বনে | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১২:০৫ অপরাহ্ণ

    বিশ্বের সর্বোচ্চ মজুদ বিপদ বাড়িয়েছে ভেনিজুয়েলার
    apps

    ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর জন্য। ভেনিজুয়েলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাদুরো ও তার সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। দেশটির সেনাবাহিনী এখনো তার পক্ষে থাকলেও ক্রমেই বাড়ছে পদত্যাগের পরিমাণ। এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পক্ষও কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে হটাতে উঠেপড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। দেশটির জ্বালানি তেল খাতের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ওয়াশিংটন। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকট দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলা ও মাদুরোকে জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, জন্ম দিয়েছে সংকটের। যত দিন যাচ্ছে, সংকট আরো জোরালো হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন মাদুরো।

    তবে প্রশ্ন হলো, একসময়ের সমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলা কেন এত বড় সংকটের মুখে পড়ল? খনিজসমৃদ্ধ দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের নেপথ্যে কী? কেনইবা কিংবদন্তি নেতা উগো চাভেজের উত্তরসূরি হিসেবে দেশ সামলাতে মাদুরোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে? বিভিন্ন বিশ্লেষক এ সংকটের পেছনে বিভিন্ন কারণ সামনে এনেছেন। কেউ বলছেন দেশ পরিচালনায় চাভেজের মতো ক্যারিশমা নেই মাদুরোর। কেউবা দেশটির জ্বালানি তেল উত্তোলন ও রফতানি খাতে বিদ্যমান মন্দাভাবের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। অনেকেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনার বিষয়টি সামনে এনেছেন। তবে মোটা দাগে প্রায় সবাই একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তা হলো ভেনিজুয়েলায় অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রেকর্ড মজুদ। বিশ্বের বুকে জ্বালানি পণ্যটির সর্বোচ্চ এ মজুদ দেশটির অগ্রগতির পথে সহায়ক না হয়ে উল্টো বিপদের কারণ হয়েছে।

    Progoti-Insurance-AAA.jpg

    দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনে ভেনিজুয়েলার অবস্থান দ্বিতীয়। অন্যদিকে ভেনিজুয়েলা দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষ জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশ। দেশটির রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি জোগান দেয় জ্বালানি তেল। দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ওপেকভুক্ত ভেনিজুয়েলায় জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে ওপেকের চুক্তির আওতায় জ্বালানি তেলের উত্তোলন সীমিত রাখার বাধ্যবাধকতা থাকায় দেশটি চাইলেও জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন বাড়াতে পারেনি। ফলে ভেনিজুয়েলা থেকে কমে গেছে জ্বালানি তেল রফতানিও। প্রধান রফতানি পণ্যটি থেকে আয় কমায় বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে পারছে না দেশটি। এ পরিস্থিতিতে দেশটির জনগণের মধ্যে প্রেসিডেন্ট মাদুরোর প্রতি অসন্তোষ বেড়েছে, সময়ের ব্যবধানে যা রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে।

    তবে উত্তোলন ও রফতানি ছাপিয়ে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ভেনিজুয়েলা সবসময় জ্বালানি তেল মজুদের কারণে আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। বিশ্বের বুকে ভেনিজুয়েলায়ই সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের পরীক্ষিত মজুদ রয়েছে। মার্কিন এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ভেনিজুয়েলায় জ্বালানি তেলের মজুদ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৮৭ কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল। তালিকায় এরপর বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশ সৌদি আরবের অবস্থান। সৌদি আরবে জ্বালানি পণ্যটির মজুদ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৬৪৫ কোটি ৫০ লাখ ব্যারেল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সাকল্যে ৩ হাজার ৬৪০ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের পরীক্ষিত মজুদ রয়েছে। জ্বালানি পণ্যটির রেকর্ড পরিমাণ মজুদ ভেনিজুয়েলা সংকটের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


    তাদের মতে, উগো চাভেজের আমলে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি জ্বালানি তেলনির্ভর হয়ে পড়ে। পণ্যটির উত্তোলন ও রফতানি বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেন চাভেজ। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন পরিস্থিতি বদলে দেয়। দরপতনের জের ধরে জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে দেয় ভেনিজুয়েলা সরকার। উত্তোলন ও রফতানি হওয়া জ্বালানি তেলের দাম না পাওয়ায় ভেঙে পড়ে দেশটির অর্থনীতি। পরিস্থিতি ক্রমেই মাদুরোর নাগালের বাইরে চলে যায়। দেশটিতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। কমে আসে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ। এ পরিস্থিতি দেশটির সাধারণ মানুষকে মাদুরোর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে।

    অন্যদিকে ভেনিজুয়েলায় অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রেকর্ড মজুদে চোখ পড়ে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর। ভেনিজুয়েলার বামপন্থী শাসকদের বিরুদ্ধে আদর্শগত কারণে আগে থেকেই খড়্গহস্ত ছিল ওয়াশিংটন। নতুন করে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন বলয়ের দেশগুলো। এ কারণে ২০১৯ সালের শুরুতে মার্কিন মদদে মাদুরোর শাসন অস্বীকার করে নিজেকে ভেনিজুয়েলার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দেন ভেনিজুয়েলার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নেতা হুয়ান গুয়াইদো। দ্রুতই তাকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। অন্যদিকে মাদুরোর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা করে রাশিয়া, চীন, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পিডিভিএসএর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তবে হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে পিডিভিএসএর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান সিটগোর কার্যক্রম চলমান রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে চলতি বছর ভেনিজুয়েলা সংকটকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা।

    এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্লিপারডাটার বিশ্লেষক ম্যাট স্মিথ জানান, ভেনিজুয়েলার সাম্প্রতিক সংকট শুধু রাজনৈতিক কিংবা আদর্শগত নয়। এতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। দেশটিতে মজুদ থাকা জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে তত্পর ওয়াশিংটন ও মার্কিন বলয়ের দেশগুলো। এজন্য পিডিভিএসএর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। চাপ বাড়ানো হয়েছে মাদুরোর ওপরও। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মাদুরো ভেনিজুয়েলার জ্বালানি খাত পশ্চিমা বিনিয়োগের জন্য আরো উন্মুক্ত করবেন, এমনটাই আশা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। আর কোনোভাবে মাদুরোর পতন ঘটে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট গুয়াইদো ক্ষমতায় এলে দেশটির জ্বালানি খাত পশ্চিমাদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনার কারণেই চীন-রাশিয়া সাম্প্রতিক সংকটে মাদুরোকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

    আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটের বিশ্লেষক হেলিমা ক্রফট বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিনিয়োগকারীরা ভেনিজুয়েলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর জের ধরে চলতি বছর দেশটিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দৈনিক উত্তোলন তিন-পাঁচ লাখ ব্যারেল কমতে পারে। তার ওপর নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন আরো কমাতে পারে। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে।

    আর এতেই ভয় বামপন্থী মাদুরোর। তিনি মনে করছেন, দেশজুড়ে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভ মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফল। আর পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছে ভেনিজুয়েলার শাসন কাঠামো দুর্বল করে তেল শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়া। এ ‘ষড়যন্ত্র রুখতে’ আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে আপাতত পরিস্থিতি শান্ত করার কৌশল নিয়েছেন তিনি। তবে এতে বিক্ষোভ কমেনি। এখন আগাম নির্বাচনে মাদুরোর পাশাপাশি পুরো ভেনিজুয়েলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে মনে করছেন হেলিমা ক্রফট। তার ভাষায়, আগাম নির্বাচনের ফলাফলই বলে দেবে, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রেকর্ড মজুদের ব্যবহার কেমন হবে, কে করবে।

     

    Facebook Comments Box

    বাংলাদেশ সময়: ১২:০৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

    bankbimaarthonity.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    রডের দাম বাড়ছে

    ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

    Archive Calendar

    শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
     
    ১০১১১২১৩১৪১৫১৬
    ১৭১৮১৯২০২১২২২৩
    ২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
  • ফেসবুকে ব্যাংক বীমা অর্থনীতি