এস জেড ইসলাম | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১:১৩ অপরাহ্ণ
আইন ও নীতি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়া প্রতিষ্ঠান নিজেই যখন আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয় তখন কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা সহজেই অনুমেয়। দেশের অর্থনীতির অন্যতম খাত বীমাকে ঘিরে তেমনটাই ঘটার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি এক সভায় বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রায়ত্ব দুই বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সার্কুলার জারি করার সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। তবে এমনটি হলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নিজেই আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন বলে মনে করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট আইডিআরএ’র নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৮৩টি বীমা প্রতিষ্ঠানে আইডিআরএ’র প্রতিনিধি রাখা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত দুই বীমা প্রতিষ্ঠানের এমডি নিয়োগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা না থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো আইডিআরএ প্রতিনিধি ছাড়াই পরিচালনা পর্ষদ গঠন ও সভা হয়ে থাকে আবার দুটি করপোরেশনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়া হয় না। তাই সরকারি ও বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তদারকি, সচল রাখা, অনিয়ম প্রতিহত করা এবং বীমাগ্রাহকের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করতে কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বা পর্যবেক্ষক পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তাই বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দেয়াসহ প্রয়োজনে বীমা করপোরেশন আইন সংশোধন ও সার্কুলার জারির ব্যবস্থা নিতে সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে আইডিআরএর এমন পদক্ষেপকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আইডিআরএ’র বর্তমান কমিটিকে জড়িয়ে বিভিন্ন্ন গণমাধ্যমে যে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার হয়েছে তাতে ইতোমধ্যেই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। মূলত এসব বিষয় ধামাচাপা দিতে ও আর্থিকভাবে লাভবান হতে এট কৌশল হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। তাছাড়া এটি বীমা আইনেরও লঙ্ঘন বলে জানান তারা।
আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে জানাতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, যে দুটি বিষয় নিয়ে আইডিআরএ আইন সংশোধনী ও সার্কুলার জারি করতে চাচ্ছে সেসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ নেই। বিদ্যমান আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো এতোদিন পরিচালিত হয়েছে। উল্টো প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, বেসরকারি বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের আইডিআরএ’র প্রতিনিধি থাকতে হবে কেন? কোম্পানির সকল তথ্যই তো নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পাঠানো হয়। আবার সম্পদ ক্রয় বা বিক্রয়েও তো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানানো হয়। তাছাড়া বীমা আইনের ৭৬ ধারায় বীমাকারীর পরিচালনা পর্ষদ কেমন হবে তা বলে দেয়া আছে। পরিচালনা পর্ষদ একান্তই কোম্পানির নিজস্ব ব্যাপার। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাও এমন পদক্ষেপ ইতোপূর্বে নেয়নি। কেনইবা আইডিআরএ মনে করছে কোম্পানিগুলোতে তার প্রতিনিধি থাকা দরকার? এটা আসলে কোম্পানিগুলোকে চাপে ফেলে নিয়ন্ত্রণ করার একটা কৌশল এবং এর ফলে আরো অনেক অনিয়মের দ্বার খুলে যাবে, ফলে বীমা খাতকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই করপোরেশনে এমডি নিয়োগের বিষয়ে আইডিআরএ নেয়া পদক্ষেপের ব্যাপারে বীমাবিদরা জানান, বীমা করপোরেশনগুলো হলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। বীমা করপোরেশন আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী কারা এই করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের থাকবেন সেটা নির্ধারণ করা আছে। আবার ধারা ১৩ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে আসছে। এখানে আইডিআরএ’র কোনো ভূমিকা নেই। তাছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ এটা সুচারুভাবেই পরিপালন হয়ে আসছে। এই আইনটি যখন প্রস্তাবনা আকারে খসড়া ছিল তখন এ বিষয়ে কেউ আপত্তি তোলেনি। এতোদিন পর আইনের সংশোধনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে তা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে। কেননা ইতোমধ্যেই বীমা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা তাদের স্বচ্ছ মনোভাব ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এসব বিষয়ে আইডিআরএ মুখপাত্র ও নির্বাহ পরিচালক এস এম শাকিল আকতারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘মূলত পরিচালনা পর্ষদের সভায় আমরা প্রতিনিধি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে করে কোম্পানিগুলো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।’ কিন্তু বৈঠকের এজেন্ডাতে পর্ষদ সভার চেয়ে পর্ষদে প্রতিনিধি নিয়োগের বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে এমনটা জানলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এছাড়া লোকবল সংকটে কীভাবে এতোগুলো প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে খারাপ বা দুর্বল কোম্পানিগুলোতে নিয়োগ দেয়া হবে।’
কিন্তু খারাপ বা দুর্বল কোম্পানি চিহ্নিত করার বিষয়ে তিনি কোনো জবাব দেননি। কারণ ফারইস্ট ইসলামী লাইফও ভালো কোম্পানি এবং দেশের শীর্ষ জীবন বীমা কোম্পানি ছিল। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত দুই কোম্পানিতে এমডি নিয়োগের বিষয়ে জানান- ‘যেহেতু বীমা বিষয়ে আইডিআরএ’র ভালো জানা আছে। ফলে কারা এ পদের জন্য উপযুক্ত সেটা আমরাই ভালো বলতে পারবো। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া।’ কিন্তু আইডিআরএ কর্তৃক বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে সিইও নিয়োগের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এরা আসলে মামলা করে টিকে আছে।’
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদে আইডিআরএ’র প্রতিনিধি নিয়োগকে নিয়ম-বহির্ভূত ও সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ বীমা কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। তাই এসব কোম্পানিকে উভয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আইন মেনে চলতে হয়। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের সাথে আইডিআরএ কোনো আলোচনা করেনি।’
বাংলাদেশ সময়: ১:১৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy