| রবিবার, ৩১ জুলাই ২০২২ | প্রিন্ট | 237 বার পঠিত
নিজস্ব প্রতিবেদন
বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে স্ফীত রিজার্ভ সংরক্ষণ করছে। এটা অর্থনীতির জন্য একটি ভালো লক্ষণ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রকৃত স্থিতি কত তা নিয়ে সংময় এবং সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এমন কি রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মোতাবেক, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে রিজার্ভ হিসাব করে তাহলে প্রকৃত রিজার্ভ স্থিতি দাঁড়াবে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংস্থাটি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়নে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে।
একটি দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্থিতি দেখে একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যখন কোনো দেশকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে বা ঋণদান করে তখন সংশ্লিষ্ট দেশটির আর্থিক অবস্থা বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, দেশটির ক্রেডিট রেটিং ইত্যাদির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। এর উদ্দেশ্য হলো, দেশটিকে ঋণ দান করা হলে সেই ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে পরিশোধ করার সক্ষমতা আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এ জন্যই একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে ‘এক্সটার্নাল অ্যাসেট’ বলা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলেন, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকলে তাকে সন্তোষজনক বলে মনে করা যেতে পারে। এর চেয়ে কম রিজার্ভ থাকলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা যেতে পারে। একটি দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীত স্থিতি কাম্য হলেও রিজার্ভ অর্থ অলসভাবে বসিয়ে রাখাটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। কোনো দেশের অর্থনীতিতে উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগ এবং স্ফীত রিজার্ভ সবচেয়ে ভালো অবস্থার নির্দেশক। এমনকি তুলনামূলক স্বল্প রিজার্ভ এবং ব্যাপক বিনিয়োগও কাম্য হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন স্ফীত রিজার্ভ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এটা একটি দেশের অর্থনীতির স্থবিরতার নির্দেশক। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দিন ধরেই স্ফীত রিজার্ভ সংরক্ষণ করে চলেছে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও রিজার্ভের স্ফীতি ক্রমশ বাড়ছিল। ২০২১ সালে এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্থিতি ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সেটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ স্থিতি। এরপর নানা কারণেই রিজার্ভ কমতে শুরু করে। গত মে মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে। জুন মাসে তা আরো কিছুটা কমে ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, রিজার্ভ থেকে দেয়া বিভিন্ন ধরনের ঋণকে রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত করে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে সৃষ্ট এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) বিভিন্ন ধরনের ঋণ তহবিল গঠন করেছে। এই অর্থকে এখনো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টান্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী এসব দায় কোনোভাবেই রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ অর্থ থেকে ইডিএফে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার, গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে ২০ কোটি মার্কিন ডলার। লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটিজে ৩ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার, পায়রা সমুদ্র বন্দরের জন্য সোনালি ব্যাংকের মাধ্যমে ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার, বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। এগুলোকেও বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত করে প্রদর্শন করছে। আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণের পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই পরামর্শ মানতে নারাজ। ফলে আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কিছুটা হলেও মতান্তর সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সংস্থাটি ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ আদায়ের মাধ্যমে সুস্থ অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যও বলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর পরিবর্তে নানাভাবে ঋণখেলাপিদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে কৃত্রিমভাবে ব্যাংকগুলোকে ঋণখেলাপি মুক্ত দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমার ঘটনা কোনো নতুন কিছু নয় বা এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হ্রাসজনিত সমস্যা মোকাবিলা করছে। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৭০০ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে ৫৭২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। এটা দেশটির ২০ মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম রিজার্ভ। রিজার্ভ কমে যাবার কারণে দেশটির স্থানীয় মুদ্রা রুপির ব্যাপক দরপতন ঘটছে। এখন এক মার্কিন ডলার ক্রয় করতে ৮০ রুপি ব্যয় করতে হচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশ পাকিস্তানের অবস্থা এখন খুবই সঙ্গীণ। তারা রিজার্ভ বাড়ানো জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির কথা ভাবছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৬৪০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। পাকিস্তানে ভয়াবহ আকার ধারনা করেছে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির হার। মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশটির স্থানীয় মুদ্রা রুপির ব্যাপক দর পতন ঘটেছে। প্রতি মার্কিন ডলার বিক্রি হচ্ছে ২২৩ দশমিক ৮৮ পাকিস্তানি রুপিতে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা তো আরো খারাপ। দেশটি বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে আবশ্যিক পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিকট থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রীলঙ্কা ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হয়েছে। এটা একটি দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। মায়ানমারের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। তারাও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকটে পতিত হয়েছে। ডিসেম্বর ২০২১-এর ভুটানের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৪৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। গত ফেব্রুয়অেিত মালদ্বীপের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৭৫ দশমিক ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। গত মে মাসে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ১৯২ কোটি মার্কিন ডলার। রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ চীনের অবস্থা বেশ ভালো। গত জুন মাসে তাদের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ৭ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পারিমাণ এক সময় ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে শুরু করে। বিশেষ করে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই রিজার্ভ বেশি পরিমাণে কমতে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক ধরনের মিশ্র প্রবণতা শুরু হয়েছে। রফতানি আয় বৃদ্ধি পেলেও আমদানি ব্যয় বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিকূলে বাণিজ্য ঘাাটতির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের একটি বড় উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। কিন্তু করোনার পর রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে গেছে। যদিও জনশক্তি রফতানির পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু তারা দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। প্রবাসীদের এই প্রবণতা রেমিট্যান্স কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামীতে এভাবে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে নিশ্চিতভাবেই টান পড়বে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাব করে তা নিয়ে আইএমএফ আপত্তি জানিয়েছে। আইএমএফের বক্তব্য হচ্ছে যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট নেই তাকে রিজার্ভে অন্তর্ভুক্তকরণ কেনো? তারা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) থেকে দেয়া বিভিন্ন ঋণকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দেবার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ’র এই পরামর্শ মানতে নারাজ। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, আইএমএফ বলছে, ইডিএফ থেকে যে ঋণ দেয়া হয় তা ফেরত আসতে বিলম্ব হয়। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে নেই এমন অর্থ রিজার্ভ হিসাবে দেখানোর ক্ষেত্রে আইএমএফের আপত্তি আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধি পরিপালন করবে এটাই কাক্সিক্ষত। কারণ যে ঋণ দেয়া হয়েছে তা ফেরত না আসা পর্যন্ত রিজার্ভে যোগ করা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আমদানি ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে আমদানি ব্যয় আগামীতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আমদানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উপর চাপ কমবে। রিজার্ভ স্ফীত রাখার জন্য আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন নতুন খাত খুঁজে বের করতে হবে।
Posted ১২:২০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ৩১ জুলাই ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy