আদম মালেক | ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:১৪ অপরাহ্ণ
গুগল বা ই-পেপারে নির্ভরতায় বই বিক্রি কমে গেছে। তার ওপর করোনার প্রভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় সেখানে বই বা ছাপার কাজের চাহিদা নেই। ফলে পাঠ্যপুস্তকসহ সব ধরনের বই ছাপা ও বিক্রি তলানিতে। বই বিক্রি কমেছে ৯০ শতাংশ। বহু কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই চলে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য কোনো শ্রমিক বাড়ি চলে যায়, কেউ অন্য পেশায় ঢুকে পড়ে। সব মিলিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত একশ বছরেও এমন দুরবস্থা হয়েছে বলে তারা শোনেননি। এমন অবস্থায় হতাশা ভর করেছে এ শিল্পে জড়িত হাজার হাজার মানুষের মনে।
সরজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক প্রিন্টিং-প্যাকেজিং কারখানার শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। আগের মতো অর্ডার না থাকায় মালিকপক্ষ অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা টিকে আছেন, তারা ঢিমেতালে কাজ করে সময় পার করছেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ছাপাখানাগুলোতে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও নোটপ্যাডের আশানুরূপ অর্ডার না থাকায় প্রেস ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকটা ‘বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার’ আশায় প্রতিদিন দোকান খুলছেন ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হলেও প্রেসে আসছে না কাক্সিক্ষত কাজ।
বাংলাবাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বইয়ের দোকান বন্ধ। যেগুলো খোলা হয়েছে সেগুলোতে বেচা-বিক্রি কম। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, করোনার ৯ মাসে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই বই ছাপার কাজ বন্ধ রয়েছে। যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তারাও অনেকটা বিনামূল্যে বই ছাপাচ্ছে। তাছাড়া করোনার কারণে দেশের মোট ৩০ হাজার লাইব্রেরিতে বই বিক্রি ব্যাপকভাবে কমেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি করোনার প্রাদুর্ভাব না হলে এ ৯ মাসে বই বিক্রি হতো প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার। সেখানে করোনার ৯ মাসে মাত্র ৭২০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর বাংলাবাজার ছাড়াও শাহবাগ ও নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি বইয়ের দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই দিনের বেশিরভাগ সময়। দু’একটি দোকানে হঠাৎ ক্রেতা দেখা যায়, বেশিরভাগ সময় দোকানদাররা অবসর কাটান। নীলক্ষেত এলাকার ফুটপাথের বইয়ের দোকানিদেরও মোবাইল ফোনে সময় কাটাতে দেখা গেছে। পল্টনের সিপিবি অফিসের সামনের বইয়ের দোকানগুলোতে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। দীর্ঘদিন থেকে বইয়ের ব্যবসা করা উত্তম কুমার বই বিক্রি বাদ দিয়ে এখন চাইনিজ আকুপাংচারের সরঞ্জাম বিক্রি করছেন। বললেন, ই-বইয়ের কারণে অনেক আগেই ছাপানো বই বিক্রি কমে গেছে। করোনা আসায় আগে যেটুকু ছিল তা নেই। বাধ্য হয়েই চাইনিজ সরঞ্জামাদি বিক্রি করছি।
লাইব্রেরি ও মুদ্রণ সংস্থার মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার সময় লকডাউনে বইয়ের দোকানও বন্ধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব ধরনের বই বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তবে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর সামান্য হলেও বেচাকেনা শুরু হয়েছে। শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় সেই সামান্য বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির তথ্যে দেখা গেছে, সারাদেশের লাইব্রেরিতে বই বিক্রির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ছিল। এদের প্রায় ৮০ শতাংশই আর্থিক সংকটে দুরবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কাগজ, কালি, প্রেস, প্লেট, বাইন্ডিংসহ সব খাত বন্ধ। ফলে ৮০ শতাংশ লোক বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি এমএ মোমেন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যান্য খাতগুলোর মধ্যে মুদ্রণ ও প্রকাশনা খাতটি খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ। প্রতিবছর এ খাতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার টার্নওভার হয়ে থাকে, তবে করোনার কারণে এ খাতের উদ্যোক্তা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে বর্তমানে উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনাই অনেকটা হুমকির মুখে পড়েছে।
পেপার ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুল ইসলাম ভরসা বলেন, করোনা মহামারীর কারণে এ খাতের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি ৭০ শতাংশ কমে গেছে এবং বর্তমান অবস্থা উত্তরণে প্রণোদনা প্যাকেজের সুষম বণ্টনের প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে দেশের ৩০ হাজার লাইব্রেরিতে প্রতিদিন গড়ে বই বিক্রি হতো ৩০ কোটি টাকার। এ হিসাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে এ সময়ে বই বিক্রি হতো ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার। কিন্তু এ সময়ে বিক্রি হয়েছে ৭২০ কোটি টাকার বই। অর্থাৎ স্বাভাবিকের তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ বই বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:১৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed