পান্না কুমার রায় রজত | মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট | 229 বার পঠিত
গত ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে মুদ্রানীতিতে সুদহার আরো বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করে নতুন ফরমুলা চালুর পর থেকে সুদহার বাড়তে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন ফরমুলা অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকঋণের সুদহার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে। আগামীতে এই সুদহার ১২ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশ। যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে তার সুদ হার বাড়বে। তারপর রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নিম্ন সীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। যার ফলে বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নিয়ে যাবে। আবার নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফের (স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। যার ফলে তারল্য সংকটে পড়া দুর্বল ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে।
মুদ্রানীতিতে একইসাথে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। ক্রলিং পেগ হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা যা জাতীয় মুদ্রা বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে (ব্যান্ড) ওঠানামা করতে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যান্ডের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিনিময় হার রাখতে চেষ্টা করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে ক্রলিং পেগ কাজ করে? মুদ্রার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুদ্রা কর্তৃপক্ষ ক্রলিং পেগ গ্রহণ করে, প্রধানত যখন মুুদ্রাস্ফীতি বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অবমূল্যায়নের হুমকি দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমন্বিত পদ্ধতিতে মুদ্রা বিক্রি ও ক্রয় করে হস্তক্ষেপ করে, সমমূল্যকে ব্যান্ডে থাকার অনুমতি দেয়। নির্দিষ্ট বিনিময় হার ব্যবস্থার মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়াতে কিছু দেশ এই বিনিময় হার গ্রহণ করে। একই সময়ে, এটি বিনিময় হারের ওঠানামাও কম করে, কারণ এটি বিনিময় হারকে ব্যান্ডের মধ্যে থাকার নির্দেশ দেয়। নিম্ন ওঠানামা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রচার করে।
চীন, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া এবং বতসোয়ানা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন কয়েকটি দেশ। পেমেন্টের ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা প্রচারের জন্য তারা এই সিস্টেমটি বেছে নেয় এবং কখনো কখনো তারা রপ্তানি বাজারে দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বাড়াতে পর্যায়ক্রমে বিনিময় হার সামঞ্জস্য করে। মূল্যস্ফীতি হলো স্বতন্ত্র পণ্য ও পরিষেবার দাম বৃদ্ধি। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। যেমন ক্রমবর্ধমান ্উৎপাদন খরচ, বর্ধিত চাহিদা বা সরকারি নীতি। বাজারে যদি কোনো পণ্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে যায় এবং সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে, তখন দাম বেড়ে যায়। আবার কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রী প্রয়োজন তার দাম বাড়লেও মূল পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে একটি দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পণ্য ও সেবা সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকলেও দামে এর প্রভাব পড়ে।
মূলত কী কারণে মূল্যস্ফীতি হয়? উত্তরটা খুঁজে নিতে হবে একই সঙ্গে ভাবতে হবে। আবার এটাও ঠিক মূল্যস্ফীতি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বাজারেও যেন এর প্রভাব পড়ে, এটা নিশ্চিত করা। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী অক্টোবর ও নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
কর্মহীন জনসংখ্যা ও মূল্যস্ফীতি, এই দুটি শব্দ ব্যক্তিজীবনে যেমন, রাষ্ট্রের কাছেও তেমনই গভীর উদ্বেগের কারণ। অর্থনীতির তত্ত্বে এই দুুটি সমস্যাকে আক্ষরিক অর্থেই একটি রেখায় বেঁেধছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক উইলিয়াম ফিলিপস। ১৯৫৮ সালে তিনি দেখান যে, কর্মহীন মানুষ ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক বর্তমান, অন্তত স্বল্পমেয়াদে। ব্যাপারটা কেমন? ধরা যাক, সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে চায়। তা হলে এমন মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে ব্যবসায় ঋণ পাওয়ার সুবিধা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যাতে নতুন নতুন কাজের জন্য কর্মী নিয়োগ করতে পারে। এতে কর্মহীন লোকের সংখ্যা কমবে, কমবে বেকারত্ব কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আবার যদি সরকারের মনে হয় যে, মূল্যস্ফীতি খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে ঋণের সংস্থান কমানো দরকার, তাহলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট বাড়াবে-অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদে যে সুদের হারে টাকা ধার দেয়, তা বাড়বে। এতে সব ব্যাংকের হাতেই নগদের পরিমাণ কমবে, অতএব তারা ব্যবসায়িক সংস্থাগুলিকে কম ঋণ দিতে পারবে। এতে মূল্যস্ফীতি কমবে, কিন্তু অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে।
সুদ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কতটা সফল? তা মূলত উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিলক্ষিত হয়। কারণ সেখানে ভোক্তার চাহিদা থাকে ঊর্ধ্বমূখী ফলে সুদের হার বাড়ানোর উদ্দেশ্য হয় ভোগ কমিয়ে আনা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তেমন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোপুরি এমপ্লয়েড অর্থনীতিনির্ভর না। আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে উৎপাদনশীল খাত এসএমই।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ ও সরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ । সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। বেসরকারি উৎপাদনশীল খাতে ঋণ কমে গেলে উৎপাদন কার্য কমে যাবে, ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারি খাতে তো ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদে যে ঋণ নেবে সেই ঋণের টাকা তো সরকারই পাবে। কারণ সরকার নিজের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজেকেই বেশি সুদ দিচ্ছে। ২০২২ সালের জুনে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২২ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে অতিরিক্ত তারল্য কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকায়। সর্বোপরি মুদ্রানীতির সাথে রাজস্বনীতির সমন্বয় থাকতে হবে।
অর্থনৈতিক সুশাসন যা সরকারের আর্থিক সুশাসনের উপর নির্ভরশীল। যদি যথেষ্ট সংখ্যক সংস্থা বিশ^াস করে যে ব্যাংক তাদের ঋণ দিতে পারবে, তবে তারা নতুন কাজের পরিকল্পনা করতে সাহস পাবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি করবে। যদি ব্যাংক বিশ^াস করে যে তাদের প্রদেয় ঋণ থেকে সত্যিই অর্থকর কাজের সংস্থান হবে। তাহলে তারা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে ও স্বপ্রণোদিতভাবে রিজার্ভ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবে। রপ্তানি আয় বাড়ানো ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণে জোর দিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। নজিরবিহীন তারল্য সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক ধার করে চলে।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির আরেকটি কারণ, অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিকমতো কাজ না করা। বাজারে প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নেই। কৃত্রিম ভাবে দাম বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। তাই সুদের হার বৃদ্ধি করে এ ধরনের মূল্যস্ফীতি রোধ করা যায় না। তাই প্রতিযোগিতা কমিশন ভোক্তা অধিদপ্তরকে আরো কার্যকর করতে হবে। তাহলে কি বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ডলার সংকটের কারণে আমদানি স্বল্পতা, দ্রব্যমূল্যে কারসাজি, বাজার সিন্ডিকেট প্রভৃতি কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না? উত্তরটা আমার জানা নেই। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি সংকুচিত হচ্ছে। তাই মুদ্রানীতিই যে সব সংকট সমাধান করতে পারবে এমন ভরসা কি করা যায়!
Posted ২:২৯ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy