
বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ০২ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট | 1460 বার পঠিত
নামে-বেনামে মালিকদের বিভিন্ন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লুটপাট, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়োগ-পদোন্নতি প্রদান, পিআর জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ আর ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অসততায় লাইফ সাপোর্টে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। চলছে বীমা আইন ভঙ্গের মহোৎসব। মালিকদের ক্ষমতার দাপটে নীরব দর্শকের ভ‚মিকায় দেশের বীমা সেক্টরের সর্বোচ্চ অভিভাবক ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ (আইডিআরএ)।
ব্যাংকবীমা অর্থনীতি পত্রিকার গত সংখ্যায় মানিকগঞ্জপ্রীতি আর গ্রæপিংয়ের ছোবলে সানলাইফ-সংস্কারের নামে গণছাঁটাই, মেয়াদপূর্তির টাকা পেতে শত শত গ্রাহকের লিগ্যাল নোটিশ ইত্যাদি বিষয়ে ‘‘পারিবারিক বলয়ে বন্দি প্রতিষ্ঠানটি’’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সানলাইফ কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। যেহেতু এটা একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন সেহেতু পত্রিকার পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। সানলাইফের মালিকপক্ষ ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে টেলিফোনিক আলাপের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। প্রয়াত কর্নেল (অব.) মালেক পরিবারের বাইরে দুইজন পরিচালকের একজন হচ্ছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ মফিজুর রহমান। সানলাইফের বর্তমান দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন কোম্পানিতো তারাই (মালেক পরিবার) চালায়, আমাদের মতামতের কোনো মূল্য আছে নাকি? পত্রিকায় কি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তা আমি জানি না, তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।’’
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের চামড়া মোটা, এ ধরনের রিপোর্টে আমাদের কিছু হয় না। এধরনের পত্রিকা কেউ পড়ে নাকি? প্রথম আলোর মতো পত্রিকায় ছাপা হলে তা ভিন্ন কথা।’’ তবে গত সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শুধুমাত্র একটি বিষয়ে টেলিফোনে তিনি আপত্তি করেছেন। তার বর্তমান পিএস নারী কর্মকর্তার গোল্ডেন লাইফে চাকরিকালীন গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘ইয়াসমিনকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি, গ্রাহক ও উন্নয়ন কর্মীদের রোষানল থেকে বাঁচাতে পুলিশ সেফ কাস্টোডিতে নিয়েছিল’’।
কোম্পানির সিএফও এবং এডিশনাল এমডি ড. কল্যাণ কৃষ্ণ চক্রবর্তী অভিযোগের সুরে বলেন, ‘‘প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোম্পানি সেক্রেটারি রবিউল আলমকে একজন স্বীকৃত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয়। সে কবে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়েছে?’’ ড. কল্যাণ আরো বলেন, ‘‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরকম একটি রিপোর্ট করলেন?’’ এছাড়া প্রকাশিত প্রতিবেদনে লোকমুখী বীমা প্রকল্পের পিডি সবুজ তালুকদারকে মানিকগঞ্জের জামাই উল্লেখ করায় সানলাইফ কর্তৃপক্ষ আপত্তি করেছেন। সবুজ তালুকদারের শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জে নয়, ময়মনসিংহ হবে। এছাড়া আর কোনো বিষয়ে সানলাইফ কর্তৃপক্ষ আপত্তি বা প্রতিবাদ না করায় গত সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযোগসমূহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বলে ধরে নেয়া যায়।
মালিকদের বিভিন্ন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট
সানলাইফের গ্রাহকদের টাকা লুটপাটের জন্য মালিকরা নামসর্বস্ব বিভিন্ন পারিবারিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান খুলেছে। এর মধ্যে বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজ ও বিডি থাই ফুড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখযোগ্য। ২০১৩ সালে বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজ লিমিটেডকে স্টক ব্রোকার রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রেশন সনদ নং-আরইজি-৩.১/ডিএসই-২৪৮/২০১৩/৫০৬ এবং তিন সংখ্যার আইডি হলো ‘বিডিএস’, ডিএসইতে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য নং হলো-২৪৮। অভিযোগ রয়েছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকদের ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সানলাইফের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই ব্রোকার হাউজটি অনুমোদন নেন সানলাইফের পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান আলহাজ জাহিদ মালেক স্বপন। অনুমোদনের পর কিছুদিন ভালই চলছিল ব্রোকার হাউজটি। কিন্তু মালিকদের অদক্ষতা ও কতিপয় অসৎ কর্মকর্তাদের কারনে ধীরে ধীরে এটা একটি লস প্রজেক্টে রূপ নেয়। এছাড়া ২০১৫ সালে অবৈধ শর্ট সেলের সাথে জড়িয়ে শেয়ারবাজার কারসাজিতে নাম লেখায় বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজ। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ আ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একটি সূত্র জানায়, ঈদের ছুটি শুরু হবার দিন অর্থাৎ ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজ সিঙ্গার বিডি’র ২২টি শেয়ার শর্ট সেল দেয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ঈদের ছুটি শেষ হবার পর ঘটনা বিএসইসি’র নজরে আসে। দেশের পুঁজিবাজারে কারসাজিতে শর্ট সেল অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আর এ কারণেই সকল ধরনের শর্ট সেল থেকে ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে নিষেধ করা হয়। আইনানুযায়ি শর্ট সেল করার শাস্তি হিসেবে বিএসইসি সংশ্লিষ্ট ব্রোকার হাউজের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। বিএসইসি’র কারণ দর্শানোর জবাবে পুরো ঘটনার জন্য প্রতিষ্ঠানটি সফটওয়্যারের ভুল বলে ব্যাখ্যা দেয়। কোম্পানির শর্ট সেল করার কোনো ইচ্ছা ছিল না এবং পরবর্তী সময়ে কখনো এমন ঘটনা ঘটবে না বলে প্রতিশ্রæতি দিয়ে এ যাত্রায় রক্ষা পায় ব্রোকার হাউজটি। এরপর এই ব্রোকার হাউজের মালিকানা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে নামমাত্র মূল্য ২২ কোটি টাকায় কিনে নেয় মালেক পরিবার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক রাহাত মালেকের, যিনি সানলাইফের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ জাহিদ মালেক স্বপনের পূত্র। অভিযোগ রয়েছে, বিডি সানলাইফ সিকিউরিটিজ বিক্রির সম্পূর্ণ টাকা সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সকে এখনো পরিশোধ করেনি নতুন মালিকরা (মালেক পরিবার)।
মালেক পরিবারের আরেকটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বিডি থাই ফুড লিমিটেড। অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের অনেক অফিস স্টাফের নিয়োগ সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে হলেও তারা কাজ করে বিডি থাই ফুডে, অর্থাৎ কাজ না করেও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে তারা বেতন ভাতা গ্রহণ করে। এছাড়া বিডি থাই ফুডের বিভিন্ন প্রচার প্রচারণায় সানলাইফের কর্মকর্তা ও কর্মীরা অগ্রগামী ভ‚মিকা পালন করে। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মেলা/উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বিডি থাই ফুডের প্রচারণা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সানলাইফের অফিস স্টাফরা করে এবং যাবতীয় ব্যয় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স বহন করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের এমডি একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘‘ব্রোকার হাউজ বিক্রির বিষয়টি আমি সঠিক জানি না, আপনি কোম্পানি সেক্রেটারির সাথে কথা বলুন। আর আমি বোর্ড মিটিংয়ে প্রস্তাব করেছি, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সানলাইফের বিনিয়োগ লাভজনক নয়, সেসমস্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করা যেতে পারে।’’ পরে এবিষয়ে জানতে কোম্পানি সেক্রেটারি মো. রবিউল আলমের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন কাওরান বাজারে কেনাকাটা করছি; পরে কথা বলব।’ এরপর এই প্রতিবেদক তাকে অনেকবার ফোন দিলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
পিআর জালিয়াতির সাথে অডিট ইনচার্জের সম্পৃক্ততা
গত সংখ্যায় সানলাইফের অডিট ইনচার্জ সুনাম উদ্দিনের অবৈধ কাজের সহযোগী ও ইসলামিক আ’সান বীমা প্রকল্পের ঢাকা এরিয়ার সংগঠন প্রধান মো. সাইফুল ইসলামের ঘুষ-বাণিজ্যের কিছু চিত্র তুলে ধরেছিলাম। রিপোর্টে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করার পরও সানলাইফ কর্তৃপক্ষ সুনাম উদ্দিন ও সাইফুলের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তারই ফলশ্রুতিতে এবার পিআর বই জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সাইফুলের বিরুদ্ধে। ইতিপূর্বে কোম্পানি থেকে বরখাস্তকৃত সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে করা কোম্পানির একটি মামলা এখনো বিচারাধীন থাকা সত্তে¡ও সুনামউদ্দিনের সহযোগিতায় সাইফুল পুনরায় সানলাইফে প্রবেশের সুযোগ পায়। সাইফুল যখন বুঝতে পারে ঘুষ গ্রহণ-দুর্নীতি-আত্মসাৎ যাই করি না কেন সকল বিপদে আমার পাশে থাকবে সুনামউদ্দিন, তখন সাইফুল পিআর বই জালিয়াতির মতো জঘন্য অপরাধ করার সাহস পায়। পিআর বই জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হলে কর্তৃপক্ষ সাইফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে। কিন্তু এক মাসের মাথায় অডিট ইনচার্জ সুনামউদ্দিনের সহায়তায় সাইফুল ইসলামের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করে তাকে সসম্মানে স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়। এবিষয়ে মতামত জানতে সানলাইফের অডিট ইনচার্জ মো. সুনাম উদ্দিন সাহেবকে কয়েকদিন যাবৎ ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সানলাইফের একজন ঊর্ধ্বতন হিসাব কর্মকর্তা বলেন, ‘‘সুনামউদ্দিন নিজেই পিআর জালিয়াতির সাথে জড়িত তাই সে ফোন রিসিভ করে না। ২০১৬ সালে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনের খরচ বাবদ সুনামউদ্দিন ১০ লাখ টাকার ভুয়া ভাউচারসহ বিল দাখিল করেছিল, বিষয়টি কোম্পানি সেক্রেটারি রবিউল আলম স্যারের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু মালিকদের হস্তক্ষেপে ঘটনা ধামাচাপা পরে যায়। এছাড়া সম্প্রতি সবুজ তালুকদার ও সাকিন আহাম্মেদকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে দুজনের কাছ থেকে সুনামউদ্দিনের ৪ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি কোম্পানির সবাই জানে।’’
একাধিক মামলার আসামি মামুনকে পুনর্বাসন
পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক কর্মকর্তা ও একাধিক মামলার আসামি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনকে সানলাইফের গণমুখী বীমা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগের পিছনের কাহিনী ব্যাংকবীমা অর্থনীতি পত্রিকার গত সংখ্যায় প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল। এরপর গত ৩ অক্টোবর কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে পপুলার লাইফের পক্ষ থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুনের যাবতীয় মামলার তথ্যাদিসহ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর আব্দুল্লাহ আল মামুন গত ১০ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় পপুলার লাইফের সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে চলমান সমস্যাটি একাধিক মামলার কারনে বিচারাধীন আছে। বিষয়টির সমাধান না হওয়া সত্তে¡ও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে আব্দুল্লাহ আল মামুন চাকরি করছেন, যা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ইং তারিখের সূত্র নং-বীঃউঃনিঃকঃ/জিএডি/১০০৩(৩)/২০১১-২১৬ সার্কুলারের পরিপন্থী।
অনুমোদন ছাড়াই আদর্শ বীমা প্রকল্পের নামে ব্যবসা করছেন সুমনা পারভীন
কোনরকম অনুমোদন ছাড়াই ‘আদর্শ বীমা’ নামে একটি নতুন প্রকল্পের নামে মাঠপর্যায় থেকে বীমা ব্যবসা সংগ্রহ করছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স। সানলাইফের-২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০১৭) বইয়ের কভার পেজের ভিতরের পাতায় ‘আমাদের প্রকল্পসমূহঃ’ শিরোনামে উল্লেখ আছেঃ একক বীমা, ইসলামী একক বীমা (তাকাফুল), গণমুখী বীমা, লোকমুখী বীমা, ইসলামী আ’সান বীমা আদর্শ বীমা ও গ্রুপ বীমা’র নাম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবেক বীমা অধিদফতর থেকে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ‘আদর্শ বীমা’ ব্যতীত অন্যান্য প্রকল্পের আলাদা আলাদা নামে ব্যবসা করার অনুমোদন নিয়েছিলেন। আইডিআরএ গঠিত হওয়ার পর কোনো কোম্পানিতে আলাদা নতুন প্রকল্পের নাম অনুমোদন দেয়া হয় না, তবে পূর্বের অনুমোদিত প্রকল্পসমূহ সব কোম্পানিতেই বহাল আছে। সে হিসেবে সানলাইফের ‘আদর্শ বীমা’ নামে কোন আলাদা প্রকল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে সানলাইফের এমডি একেএম শরীফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আসলে বীমা কোম্পানিতে এখনতো প্রজেক্ট কনসেপ্ট নেই। আমরাতো কোম্পানির বীমা প্রোডাক্ট বা পরিকল্পসমূহের নাম উল্লেখ করেছি, এখানে কোনো সমস্যাতো দেখছি না। কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০১৭) বইয়ের কভার পেজের ভিতরের পাতায় ‘আমাদের প্রকল্পসমূহ’ এরপর ’আমাদের পরিকল্পসমূহ’ নামে বীমা প্রোডাক্ট বা পরিকল্পসমূহের নাম আলাদা উল্লেখ আছে এবং ‘আদর্শ বীমা’ নামটি পরিকল্পসমূহের মধ্যে উল্লেখ না করে প্রকল্পসমূহের মাঝে কেন উল্লেখ আছে, এমডি তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
বীমা আইন ভঙ্গ করে লাইসেন্সবিহীন অফিসের মাধ্যমে ব্যবসা সংগ্রহ
সানলাইফের বার্ষিক প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০১৭) বইয়ের ১০৯ ও ১১০ পৃষ্ঠায় একক বীমার-১৩টি, ইসলামী একক বীমার-১৬টি, ইসলামী আদর্শ বীমার-৬টি, গণমুখী বীমার-১৩টি, ইসলামী আ’সান বীমার-১১টি এবং লোকমুখী বীমার-১১টিসহ মোট ৭০টি উল্লেখযোগ্য প্রধান অফিসের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর বাইরেও সারাদেশে সানলাইফের ছোট বড় আরো প্রায় ১৫০টি অফিস রয়েছে। কিন্তু আইডিআরএ’র কাছ থেকে এসব অফিসের কোনটিরই লাইসেন্স গ্রহণ করা হয়নি, যা বীমা আইন-২০১০(২০১০ সনের ১৩ নম্বর আইন) এর ধারা ১৪৬, ধারা১৪(২) এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২ তারিখ প্রকাশিত এস.আর.ও নং ৩৭৭-আইন/২০১২ প্রজ্ঞাপন ভঙ্গের শামিল। এবিষয়ে আইডিআরএ’র একজন সদস্যের কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “লাইসেন্সবিহীন অফিসের মাধ্যমে ব্যবসা সংগ্রহ করা অবৈধ এবং বীমা আইন পরিপন্থী। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিব।’’
লাইসেন্স-সার্টিফিকেট লাগে না ক্ষুদ্র বীমা এজেন্টদের
অভিযোগ রয়েছে লাইসেন্স-সার্টিফিকেট গ্রহণ না করেই এজেন্টদের মাধ্যমে বীমা ব্যবসা সংগ্রহ করছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স। সূত্র জানায়, সানলাইফের বীমা ব্যবসার বড় অংশই গণমুখী, লোকমুখী ও ইসলামী আ’সান বীমা প্রকল্পের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। আর এই তিনটি প্রকল্পই মূলত ক্ষুদ্র বীমা পলিসি বিক্রি করে। তাই সানলাইফ কর্তৃপক্ষ একক বীমা ও ইসলামী একক বীমা (তাকাফুল) প্রকল্পের এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্টদের জন্য আইডিআরএ’র কাছ থেকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে লাইসেন্স-সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলেও তিনটি ক্ষুদ্র বীমার জন্য তা সংগ্রহ করে না। কিন্তু বীমা আইন-২০১০ এর ধারা ১২৪ অনুযায়ী সকল বীমা এজেন্টদের লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক এবং এসংক্রান্ত সরকারি প্রবিধানে একক বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এজেন্টদেরকে আলাদা করা হয়নি। এবিষয়ে আইডিআরএ’র লাইসেন্স-সার্টিফিকেট ইস্যু ও বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, “লাইসেন্স-সার্টিফিকেটবিহীন এজেন্ট বা এমপ্লয়ার অব এজেন্টদের মাধ্যমে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা অবৈধ এবং বীমা আইন পরিপন্থী। বীমা আইনে এজেন্ট বা এমপ্লয়ার অব এজেন্টের সংজ্ঞায় একক বীমা বা ক্ষুদ্র বীমা বলতে আলাদা কিছু নেই, প্রিমিয়াম সংগ্রহকারী সকল এজেন্ট বা এমপ্লয়ার অব এজেন্টের লাইসেন্স সার্টিফিকেট গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।’’
সাধারণ কর্মীদের মাঝে গ্রেফতার আতঙ্ক
এদিকে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধে দীর্ঘসূত্রতা ও তালবাহানার অভিযোগে গত ৬ নভেম্বর, ২০১৮ তারিখ বগুড়ায় সানলাইফের এএমডি-শহিদুল ইসলাম শান্তকে আটক করেছে পুলিশ। ওইদিন শত শত গ্রাহক বগুড়ার সানলাইফের বিভাগীয় কার্যালয়ে জড়ো হয়ে দাবি পরিশোধের জন্য বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ শান্তকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। বগুড়া সদর থানার ওসি এসএম বদিউজ্জামান জানান, ‘‘শান্তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে সবকিছু খতিয়ে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে’’। বিক্ষোভকারীরা বলেন, বগুড়ায় ৫ হাজার গ্রাহকের প্রায় ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করতে দীর্ঘদিন যাবৎ গড়িমসি করছে সানলাইফ কর্তৃপক্ষ। আটক হওয়ার আগে এএমডি শহিদুল ইসলাম শান্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘হেড অফিসে সমস্যার কারণে গ্রাহকদের দাবির চেক রেডি না হওয়ায় বগুড়ার এই সমস্ত গ্রাহকদের টাকা তারা পরিশোধ করতে পারেননি’’। এদিকে বগুড়ায় শহিদুল ইসলাম শান্ত গ্রেফতার হওয়ায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশের সানলাইফের কর্মকর্তা-কর্মীদের মাঝে।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় গ্রাহকরা বীমার টাকা পেতে সানলাইফের স্থানীয় অফিসে বিক্ষোভ করছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে, যে কোনো সময় গ্রাহকরা হামলা করতে পারে অফিসে বা স্থানীয় কর্মকর্তাদের উপর। পরিস্থিতি খারাপ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হতে পারেন স্থানীয় কর্মকর্তারা এই আতংক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে।
লাইফ সাপোর্টে সানলাইফ
মালিকদের বিভিন্ন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট, ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অসততা, বাড়তি ব্যবস্থাপনা ব্যয় আর গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের চাপে লাইফ সাপোর্টে সানলাইফ। ২০১৩ সালে শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানিটি ২০১৭ অর্থবছরে ১০৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করেছে। অথচ দুই বছর আগে ২০১৫ সালে এই কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় ছিল ১৬৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের শেষে সানলাইফের লাইফ ফান্ডের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০৩ কোটি ৬০ লাখ টাকায়, যা ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৩৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। লুটপাট এর নামে বাড়তি ব্যবস্থাপনা ব্যয় আর বীমাদাবির চাপ সালাতেই লাইফ ফান্ডের অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যে কারণে গত ৫ বছরে কোম্পানিটির বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এদিকে বীমা দাবি পরিশোধের চাপও সানলাইফের পথচলায় প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে। ২০১৩ সালে প্রায় ৪২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বীমাদাবি পরিশোধ করেছিল সানলাইফ, যা সর্বশেষ ২০১৭ সাল শেষে প্রায় ৭৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ হিসাবে গত ৫ বছরে কোম্পানিটির বীমাদাবি পরিশোধের পরিমাণ ৭৪.৫৮ শতাংশ বেড়েছে।
পরবর্তী সংখ্যায় সানলাইফের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এক্সক্লুসিভ ও শেষপর্বে থাকবেঃ মানিকগঞ্জ-খুলনা ও ঢাকাস্থ মহাখালীতে জমিক্রয়ে দুর্নীতি, বিটিএ টাওয়ারে ফ্লোর ক্রয় দুর্নীতি, আসলাম রেজা ও সুনামউদ্দিনের অবৈধ সম্পদ আহরণের বিস্তারিত তথ্য, এমডি-শরীফুল ইসলামের সাথে পিএস ইয়াসমিনের গোল্ডেন লাইফ থেকে ডায়মন্ড লাইফ হয়ে সানলাইফে যোগদানের অজানা কাহিনী, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করে সানলাইফের গাড়ি ও কর্মকর্তাদের শোডাউনের পিছনের ইতিহাসসহ আরো অনেক তথ্যবহুল চিত্র। (চলবে…)
Posted ৩:৫৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০২ এপ্রিল ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed