রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

স্ট্যাম্প সংকট চরমে, বিক্রি হচ্ছে বাড়তি মূল্যে

আমেনা খাতুন প্রণামি   |   বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   263 বার পঠিত

স্ট্যাম্প সংকট চরমে, বিক্রি হচ্ছে বাড়তি মূল্যে

প্রকট আকার দেখা দিয়েছে স্ট্যাম্প সংকট। ২০২২ সাল থেকে এ সংকট দেখা গেলেও গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের প্রায় সব আদালতে জুডিশিয়াল, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি, ফলিও’র সংকট চরমে। ফলে সব ধরনের স্ট্যাম্প বিক্রি হচ্ছে চড়ামূল্যে। স্বল্পতা রয়েছে কার্টিজ পেপারেরও। দলিল নিবন্ধন চুক্তিপত্রসহ প্রায় সকল আইনি পদক্ষেপে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা এ কাগজের সংকটে ভোগান্তিতে পড়েছেন বিচারপ্রার্থী এবং সাধারণ জনগণ।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এবং দেশের ৬৪টি জেলার অধস্তন আদালতে প্রতি কার্যদিবসে বিচারপ্রার্থী জনগণের পক্ষে মামলা দায়েরসহ অন্যান্য দরখাস্ত দাখিলের সময় জুডিসিয়াল ও নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হয়। কিন্তু মূল্যবান এই কাগজটির সংকট দেখা দেওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আদালতের কার্যক্রম।

ডাক অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, লোকবল সংকটের জন্য কাজের গতি অনেকটা কমে গেছে বিধায় বর্তমানে স্ট্যাম্পের সংকট দেখা দিয়েছে। আরো একটি কারণ হচ্ছে ডলারের স্বল্পতার জন্য নতুন করে কাঁচমাল আমদানি করা যাচ্ছে না।

জানা যায়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চাহিদাক্রমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সকল প্রকার স্ট্যাম্প মুদ্রণ করার কথা। ডাক বিভাগের নিজস্ব ছাপাখানা থাকলেও স্ট্যাম্প ছাপানো হচ্ছে সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান ‘সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস’র মাধ্যমে। মুদ্রণের পর স্ট্যাম্পগুলো ডাক বিভাগের হেফাজতেই থাকে। ডাক বিভাগের কাছ থেকে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি (এনডিসি) চাহিদা অনুযায়ী স্ট্যাম্পগুলো গ্রহণ করে। নিয়ে রাখা হয় ডিসি অফিসের ট্রেজারিতে। সেখান থেকে স্ট্যাম্প ভেন্ডারগণ খুচরা বিক্রির জন্য ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনে নেন। বিনিময়ে সরকারি নিবন্ধনপ্রাপ্ত স্ট্যাম্প ভেন্ডার জেলা ও উপজেলাভিত্তিক নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন পেয়ে থাকেন সরকারের কাছ থেকে।

এদিকে সংকটকালীন এই সুযোগে আদালত চত্বরে কিছু অসাধু স্ট্যাম্প ভেন্ডার এবং সিন্ডিকেট সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন এসব কোর্ট ফি, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পসহ সকল জরুরী কাগজপত্র। নির্ধারিত দামের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে।

পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জজ আদালত ভবনের নিচে এবং এর আশপাশে সরকারি নিবন্ধনপ্রাপ্ত স্ট্যাম্প ভেন্ডাররা টেবিল নিয়ে বসে, আবার কেউ কেউ কোর্ট মার্কেটে দোকান নিয়ে স্ট্যাম্প বিক্রি করছেন। বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষ নানা প্রয়োজনে আইনজীবীর সহকারীদের মাধ্যমে এসব স্ট্যাম্প কিনে থাকেন। স্ট্যাম্প ভেন্ডাররাই ডেমি, ফলিও এবং কোর্ট ফি বিক্রি করে থাকেন। সেখানে দেখা যায় ১০০ টাকার স্ট্যাম্প ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেক সময় ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। ১০ টাকার কোর্ট-ফি বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকায়, ৩০ টাকার কোর্ট ফি ৫০ টাকায়। কিছু ভেন্ডর ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প ৩৭০ টাকা দাম হাকাচ্ছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প তাদের কাছে ৫০০-৬০০ টাকা চেয়েছে। দাম কষাকষি করে ৪২০-৫০০ টাকায় গ্রাহক কিনতে বাধ্য হচ্ছে।

সরকারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া দামে লাইসেন্সধারী ভেন্ডারগণ নির্ধারিত হারে কমিশন লাভ করে থাকেন। এরপরেও এক প্রকার বাধ্য হয়ে বিচারপ্রার্থীদের কয়েক গুণ বেশি দামে ভেন্ডারদের কাছ থেকে এসব কিনতে হচ্ছে। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রকাশ্যে আদায়কৃত এ অতিরিক্ত অর্থ কে পাচ্ছে নেই তার কোন তথ্য। গুরুত্বপূর্ণ এ উপকরণ মুদ্রণ, কেনা-বেচায় নেই যথাযথ তদারকি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, স্ট্যাম্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে- রাজউকের প্লট ও ট্যাক্সের দলিলের জন্য মোট মূল্যের ওপর ২ শতাংশ টাকার সমমানের স্ট্যাম্প, ট্রাস্ট ডিড ক্যাপিটাল দলিলের মূল্যের ওপর ২ শতাংশ টাকার সমমানের স্ট্যাম্প, অছিয়তনামার কপির জন্য ৩০ টাকার স্ট্যাম্প, নকলের কবলা, বন্ড, বণ্টননামা, সার্টিফায়েড কপির দলিলের জন্য ৫০ টাকার স্ট্যাম্প, অনুলিপি, খাস- মোক্তারনামা দলিলের জন্য ১০০ টাকার স্ট্যাম্প, হলফনামা, বায়নার হলফনামা, হেবার ঘোষণাপত্র, না দাবি পত্র, বাতিলকরণ দলিলের জন্য ২০০ টাকার স্ট্যাম্প, চুক্তিনামা দলিল, অঙ্গীকারনামা, বায়নানামার দলিল, মেমোরেন্ডাম অব অ্যাগ্রিমেন্ট, রিডেম্পশন, সোলেনামা বা আপসনামার দলিলের জন্য ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প, আমমোক্তারনামা দলিল ও সাফকবলা দলিলের জন্য ৪০০ টাকার স্ট্যাম্প, তালাকের হলফনামার দলিলের জন্য ৫০০ টাকার স্ট্যাম্প, অংশীদারি দলিলের জন্য ২ হাজার টাকার স্ট্যাম্প, মর্টগেজ বা বন্ধকের দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে- ১ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২ হাজার টাকা, ২০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ৫ হাজার টাকা, ১ কোটি ১ টাকার ওপরের ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকার ও প্রতি লাখের জন্য ২ শতাংশ হারে মোট টাকার মূল্যমানের স্ট্যাম্প ব্যবহার হয়ে থাকে। মোট ৩৪টি কাজে নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প, জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি প্রয়োজন হয়।

এদিকে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালত অঙ্গনে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফিতে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রতিটি আদালত প্রাঙ্গণ ও বার সমিতিতে গড়ে উঠেছে জালিয়াত চক্রের সিন্ডিকেট। মুদ্রণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিতরণ এবং খুচরা বিক্রির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জাল স্ট্যাম্পের ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব নয়। আইনে স্ট্যাম্প সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায়, এই সুযোগে জাল বা নকল স্ট্যাম্প ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। কখনোবা মুদ্রণ থেকে ব্যবহারকারীর হাত পর্যন্ত পৌঁছানের ক্ষেত্রে যে চেইন রয়েছে সেটির যেকোনো পর্যায়ে রয়েছে কারসাজির সুযোগ। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক অর্থ লুটে নেয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান যে সংকট সেটি সিন্ডিকেটেরই সৃষ্ট সংকট বলে ধারণা করছেন তারা।

ভুক্তভোগী রেহমাতুল্লা আলী জানান, স্ট্যাম্প সংকটের কথা জানিনা তবে ব্যবসায়িক কাজে প্রায় সময় ১০০ টাকার স্ট্যাম্প আমি ১২০ টাকা দিয়ে কিনি। অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে জেনেও কিছু করার নাই। আদালতের সামনেই তারা মানুষকে ঠকাচ্ছে, কর্তৃপক্ষ কিছু বলেনা আমরা কী করবো।

সরকার নিবন্ধিত এক ভ্যান্ডারের কাছে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বেশি দাম নেই না, আমি কোথাও শুনিও নাই বেশি দাম নিতে। কিন্তু প্রতিবেদক প্রথমে যখন ৩০০ টাকা স্ট্যাম্পের দাম জানতে চাইলে তখন তিনি ৩৭০ টাকা চেয়েছেন।

বাংলাদেশ স্ট্যাম্প ভেন্ডর সমিতির মহাসচিব নজরুল ইসলাম স্ট্যাম্পের সংকট এবং অতিরিক্ত দাম নেওয়ার বিষয়ে ব্যাংক বীমা অর্থনীতিকে বলেন, স্ট্যাম্প সংকট বিষয়ে আমরা অবগত আছি। মূলত ডলার সংকটের কারণে কাগজের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় স্ট্যাম্প ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। ট্রেজারি বিভাগ আমাদেরকে চাহিদা অনুযায়ী কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারছে না বিধায় আমরাও ভোক্তা পর্যায় আনতে পারছিনা। দাম বাড়তির নেওয়ার অভিযোগ অনেকেই করছে, আমরা চেষ্টা করছি এটি নিয়ন্ত্রণে আনার।
এদিকে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র সংকটের কথা জানিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক চিঠি আসছে। গত রোববার জরুরীভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নেওয়ার অপরাধে শাস্তি কি হতে পারে এ বিষয়ে জানতে অ্যাডভোকেট এস. এম. তৈাকির আহামেদ জানান, সেকশন ৭৪ ধারায়, স্ট্যাম্প বিক্রির জন্য অনিবন্ধিত ব্যক্তি এবং বিক্রির জন্য নিবন্ধিত ব্যক্তি আইনের বহির্ভূতভাবে বিক্রি করলে ৬ মাসের জেল কিংবা ৫০০ টাকা বা উভয় জরিমানা হবে।

 

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:৩১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।