আবুল কাশেম | সোমবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 287 বার পঠিত
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এ দেশে প্রতিটি সেক্টরেই ঘুষ দুর্নীতি বেড়েছে। ঘুষ ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের প্রতিরোধ করতে হবে। তাদেরকে প্রতিরোধে দুদকের হাতকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজন জনগণের সচেতন ও গণজাগরণ সৃষ্টির আহবান জানিয়েছেন তিনি।
দুদক চেয়ারম্যান মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরের এ পর্যায়ে আলোচনার শুরুতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সামজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষা- সংস্কৃতি এবং এ দেশের বিভিন্ন শ্রেনি ও-পেশার মানুষের জীবন যাত্রার মান এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ডে এদেশের উন্নয়ন ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়েও কথা বলেছেন।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস গত ৯ ডিসেম্বর দুদক আয়োজিত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়ামে এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন তিনি। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদতবরণকারী ৩০ লক্ষ বীর বাঙালি এবং দুই লক্ষ নির্যাতিতা মা বোন ও সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের ত্যাগ ও জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ’।
দুদক চেয়ারম্যান :‘আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ একটি সন্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত হতে চলেছে। আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছি। কিন্তু দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে আমাদের উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে যাবে। কতিপয় দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের কারণে এদেশের মাথা নিচু হতে দেয়া যাবে না। অর্থনীতির অভাবনীয় উন্নতির সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সকল দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে’।
দুদক চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদেশের কৃষক, শ্রমিক ও খেষতমজুরা দুর্নীতি করে না। ওইসময় দেশের শিক্ষত লোকদের মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষ ঘুষ খায় ও দুর্নীতি করতো।
নিম্মে দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো;
বক্তব্যের শুরুতেই দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারশ্যান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
‘আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদতবরণকারী ৩০ লক্ষ বীর বাঙালি এবং দুই লক্ষ নির্যাতিতা মা বোন ও সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের ত্যাগ ও জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ’।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজকের এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বাণীবদ্ধ ভাষণ প্রদান করেছেন, এজন্য আমরা সকলেই উজ্জ্বীবিত ও অনুপ্রাণিত। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের সংগ্রামী জীবনে আপনি এদেশের তৃণমূল জনগণের জন্য কাজ করে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। আপনার অকৃত্রিম দেশ প্রেম, প্রজ্ঞা, সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠা নতুন প্রজন্মকে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োজিত হতে অনুপ্রাণিত করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি’।
‘বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। আপনার উপস্থিতিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সকল কর্মচারী অনুপ্রাণিত হবে এবং একই সাথে দুর্নীতিবিরোধী কাজে আর সাহসী ও প্রত্যয়ী হবে’।
দুদক চেয়ারম্যান: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ‘অনুপার্জিত আয়’ কে সর্বতোভাবে বারিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এই নীতির বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সমাজে দুর্নীতি দমন এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমাদের জাতীয় মুক্তির ঐতিহাসিক সংগ্রামের চালিকাশক্তি ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন। ক্ষুধা, দারিদ্র ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। আর এই যাত্রায় অন্যতম প্রধান সহযাত্রী হলো দুর্নীতি দমন কমিশন’।
দুদক চেয়ারম্যান: ‘সারাবিশ্বে নৈতিকতার অবক্ষয় আজ দৃশ্যমান; ন্যায় অন্যায় বিবেচনা না করে যে কোনো উপায়ে সম্পদশালী হওয়ার এক সর্বগ্রাসী অশুভ প্রতিযোগিতা সর্বত্র লক্ষণীয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও তার প্রভাবমুক্ত নয়। দুর্নীতি আজ বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই দুর্নীতি এখন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে পরিবার ও সমাজকে গ্রাস করছে। অতীতকালে দুর্নীতিবাজদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো, কিন্তু এখন তাদের সম্মান করা হয়, সমাজে তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। দুর্নীতিবাজদের প্রভাব প্রতিপত্তির মোহে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ মুখিয়ে থাকে’।
‘এভাবে সামাজিকভাবে ঘুষ ও দুর্নীতিকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া ও সম্মান করা সমান অপরাধ। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এদেশকে স্বাধীন করেছি আত্মনির্ভরশীল উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাড়াবার জন্য। কতিপয় দুর্নীতিবাজের কারণে আমাদের এই মহান স্বাধীনতা ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যর্থ হতে য়োা যাবে না’।
দুদক চেয়ারম্যান:‘দুর্নীতিগ্রস্থ বলতে আমরা সাধারণত সরকারি কর্মচারীদের দিকে আঙ্গুল তুলি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিটি অনৈতিক লেনদেনে টেবিলের অন্য প্রান্তেও েেকউ না কেউ থাকেন। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিগ্রস্থ করতে লোভী ব্যক্তিগণ প্রলুব্ধ করে এবং প্রভাবশালীগণ ভীতি প্রদর্শন করে। সরকারি সেবা প্রদানে কেউ অবৈধ অর্থ দাবী করলে আমরা প্রতিবাদ করি না। কখনো কখনো নিজেরাও যেন সেই দুষ্টচক্রের সুবিধাভোগী হয়ে উঠি’।
দুদক চেয়ারম্যান: ‘সামান্য কিছু অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে একজন দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদের অপব্যয় অপচয় করেন। এদেশের মেহনতি দুখী মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেন’। ‘দুর্নীতির নেশা কিছু মানুষকে একমাত্রিক চিন্তায় বন্দি করে ফেলেছে- রাতারাতি সম্পদ বাড়াও, জীবনকে ভোগ করো’। ’অন্তহীন লোভ মানুষের সুস্থ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের শিকড় উপড়ে ফেলছে। দুর্নীতি ও সততার দ্বান্দ্বিকতা সমাজে বিভক্তির রেখা টেনে দিচ্ছে। নতুন নতুন সামাজিক সংকট ও অপরাধ সৃষ্টি করছে’।
দুদক চেয়ারম্যান : ‘যাদের মন ও মননকে দখল করে রেখেছে দুর্নীতি, এমন একশ্রেণীর অবিবেচক মানুষ অবৈধ ব্যবসা, অনৈতিক মুনাফা এবং ঘুষের টাকা সন্তানদের অস্থিমজ্জায় মিশিয়ে দিচ্ছে। এমনকি বিয়ের মত সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে অভিভাবকের আয় এবং গাড়ি-বাড়ির তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সন্তানকে বিশেষ কোন পেশায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, এই লোভে নিমজ্জিত হয়ে একজন পিতামাতা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সন্তানের পেছনে ব্যয় করেন, এমনকি ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাসকারী চক্রের হাতে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে দিচ্ছেন। এসব কেবল দুর্নীতিই নয়, বরং চরম নৈতিক ও সামাজিক স্খলনের নিদর্শন’।
দুদক চেয়ারম্যান : ‘তাই দুদকের মত একটা প্রতিষ্ঠান দিয়ে শুধু দুর্নীতিবাজদের ধরে একটি সমাজকে পরিশুদ্ধ করা দুরুহতম কাজ। শুধু আইন প্রয়োগ করে দুর্নীতি নির্মূলযোগ্য নয়। পরিবারের পিতা-মাতার স্বভাব সন্তান সৎ বা অসৎ হওয়ার পেছনে গভীর ছাপ রেখে যায়। যে সন্তান বাবার হাত ধরে বড় হয়েছে, তার সামনে বাবা রোল মডেল। তাই বাবার দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজ সন্তানের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। এই মানসিকতা নিয়েই সে বড় হয়। আইন সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ প্রলয় থেকে বাঁচতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকলকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার একটি বক্তব্য স্মরণ করি’। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক অপিনিয়ন মোবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক করতে হবে।
দুদক চেয়ারম্যান : ‘আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ একটি সন্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত হতে চলেছে। আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছি। কিন্তু দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে আমাদের গতি শ্লথ হয়ে যাবে। কতিপয় দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের কারণে এদেশের মাথা নিচু হতে দেয়া যাবে না। অর্থনীতির অভাবনীয় উন্নতির সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সকল দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে’।
দুদক চেয়ারম্যান : ‘তাই আমাদের আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করতে হবে; নিজের পরিবার থেকে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আসুন আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্নীতিকে না বলি। দুর্নীতি নিজে করব না, অন্যকেও কোন প্রকারে দুর্নীতিতে জড়িত হতে প্রলুব্ধ বা সহায়তা করব না। আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস-২০২১ এ এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার’।
দুদক চেয়ারম্যান : ‘এবারের আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আপনার অধিকার,আপনার দায়িত্ব: দুর্নীতিকে না বলুন’ সফল হোক এটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা। আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবসের অনুষ্ঠানমালা সফল করার নিমিত্ত দুদকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ঢাকা এবং সারাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত দিনব্যাপী সকল কর্মসূচী সফল করার জন্য দুদকের সকল স্তরের কর্মচারীবৃন্দ, সরকারের মন্ত্রণালয় এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, সুধীজন, বিজ্ঞ আইনজীবীগণ, এনজিও প্রতিনিধিবর্গ বিশেষ করে পিকেএসএফ এবং এর সহযোগী সংগঠনসমূহ, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দসহ সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই’।
Posted ১২:২২ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy