বিবিএ নিউজ.নেট | বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 297 বার পঠিত
প্রায় দুই দশক ধরে ইসলামী ব্যাংকের ফেনী শাখার গ্রাহক হাজেরা খাতুন। রেমিট্যান্সের অর্থ গ্রহণ ও আমানত রাখতে ব্যাংকটির সঙ্গে লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বলে জানিয়েছেন এ নারী। শুধু হাজেরা খাতুন নন, প্রবাসী পরিবারের আরো অনেক নারী রয়েছেন, যারা বছরের পর বছর ব্যাংকটির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা ১ কোটি ৫৯ লাখ। বিপুল এ গ্রাহকের মধ্যে ৩২ শতাংশই নারী। ব্যাংকটির পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকে পুরুষ গ্রাহকের সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ। নারী গ্রাহকের সংখ্যা ৫১ লাখের বেশি। মূলত আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই এ ব্যাংক ছেড়ে অন্য ব্যাংকে যাওয়ার কথা ভাবেন না তারা।
কেবল গ্রাহক নয়, ইসলামী ব্যাংকে নারী কর্মীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে দিন দিন। ব্যাংকটির মানবসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের কর্মীসংখ্যা ১৮ হাজার ৫০০। এর মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী ধারার ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের যাত্রা। প্রতিষ্ঠার তিন দশকে অভূতপূর্ব সাফল্য পায় ব্যাংকটি। সম্প্রসারণ ও ব্যবসার আকারে সমসাময়িক অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে যায় এ ব্যাংক। যদিও প্রতিষ্ঠা থেকে বিকাশ পর্যন্ত সব পর্যায়েই কর্মী নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা ছিল বিভিন্ন মহলে। তবে পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের রদবদলের পর ইসলামী ব্যাংকে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে।
নারীদের পাশাপাশি ব্যাংকটিতে এখন নিয়োগ পাচ্ছেন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাও। ব্যাংকটিতে বর্তমানে ৩৫ জন অমুসলিম কর্মী কাজ করেন। ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক পর্যায়েও বৈচিত্র্য এসেছে। দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষই এখন নির্দ্বিধায় ব্যাংকটির সেবা নিতে পারছেন বলে জানা গিয়েছে। গ্রাহকদের মধ্যেও অন্তত ১০ শতাংশ অমুসলিম বলে ব্যাংকটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন।
ব্যাংক পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে গত কয়েক বছরে ইসলামী ব্যাংক সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে মনে করছেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বেসরকারি খাতের বৃহত্তম ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বয়সসীমা শেষ হওয়ায় আগামীকালই ব্যাংকার হিসেবে তার শেষ কর্মদিবস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালে ইসলামী ব্যাংকের জন্মলগ্নে আমি এ ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম।
এরপর টানা ৩৬ বছর আমি এ ব্যাংকেই চাকরি করেছি। সে হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের জন্ম থেকে সাফল্যের শীর্ষে ওঠা—আমি প্রতিটি ধাপেরই সাক্ষী। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ প্রান্তে এসে আমি বলতে পারি, ইসলামী ব্যাংক এখন জাতি, ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সবার আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার ব্যাংক।
পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক পরিচালনায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে এ ব্যাংকের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার পাশাপাশি ভিতও শক্তিশালী হয়েছে। বাইরে থেকে ইসলামী ব্যাংকের যে পরিচ্ছন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে, ভেতরের পরিস্থিতিও তাই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃষ্টিতেও আমাদের ব্যাংকের অবস্থান শক্তিশালী।
ইসলামী ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে ব্যাংকটির গ্রাহক, আমানত, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, আমদানি-রফতানিসহ সবক’টি সূচকেই বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বৈচিত্র্য এসেছে ব্যাংকটির বিনিয়োগের ধরন, গ্রাহক নির্বাচন ও গ্রাহকের শ্রেণীবিন্যাসে।
বর্তমানে মুসলিমদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের অনুসারীদের মাঝেও ইসলামী ব্যাংকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যদিও ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকটির সার্ভারেও গ্রাহক তথ্যে ধর্মভিত্তিক কোনো বিভাজন রাখা হয়নি। তবে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের দাবি, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের অন্তত ১০ শতাংশ অমুসলিম। ইসলামী শরিয়াহ অনুসরণ করেই অন্য ধর্মাবলম্বীরা ব্যাংকটি থেকে ঋণ নিচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ইসলামী ব্যাংকের প্রথম ঋণগ্রহণকারী গ্রাহক ছিলেন কেশবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। মতিঝিলে ইস্টার্ন টাইপরাইটার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে টাইপরাইটার আমদানির জন্য ৫ লাখ টাকার ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে ব্যাংকটির বিনিয়োগ শুরু হয়েছিল।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মো. মাহবুব উল আলমের ভাষ্য হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ম ও লিঙ্গের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীকে বিভাজন করার সুযোগ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতেও অধিকার ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সব মানুষের অধিকার সমান। শুরু থেকেই ইসলামী ব্যাংকে অন্য ধর্মের অনুসারীরা গ্রাহক হয়েছেন। তবে সংখ্যায় এটি কিছুটা কম ছিল। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে গত কয়েক বছরে এ সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ইসলামী ব্যাংকের সব শাখায় এখন নারী কর্মীরা কাজ করছেন। অন্য ধর্মের অনুসারীদের আমরা ব্যাংকে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছি।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বড় পরিবর্তন আসে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে। ওই সময় ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে গত চার বছরে ইসলামী ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। শুধু চলতি বছরেই ব্যাংকটির আমানত ২১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা বেড়েছে। বছর শেষে এর পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
চার বছর আগে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা। ১৫ ডিসেম্বর ব্যাংকটির বিনিয়োগের পরিমাণ ৯৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে গত চার বছরে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেড়েছে। একই সময়ে শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ইসলামী ব্যাংক।
গতকাল পর্যন্ত ব্যাংকটির শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭৩। ১৬১টি উপশাখা ও ২ হাজার ২০৩টি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে বর্তমানে সারা দেশে সেবা দিচ্ছে ব্যাংকটি।
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগে ফিড মিল দিয়েছেন বগুড়ার হায়দার সরকার। ব্যাংকটির সঙ্গে লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী অনেক সময় ব্যাংকের কাছ থেকে হয়তো টাকা পাইনি। কিন্তু ঋণ নেয়ার জন্য ব্যাংকের কর্মীদের কখনো ঘুষ দিতে হয়নি। লেনদেনে স্বচ্ছতার পাশাপাশি ইসলামী শরিয়াহ্ অনুসরণের কারণেই ব্যাংকটির সঙ্গে আছি।
১৯৯৫ সাল থেকে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) নামে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইসলামী ব্যাংক। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের বিস্তৃতি হয়েছে দেশের ২৫ হাজার ৭৭৪ গ্রামে। প্রকল্পটি থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছেন ১৩ লাখ ১১ হাজার ৬৩৭ গ্রাহক। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের অধীনে ৩ হাজার ১৩৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংকটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণগ্রহীতাদের ৯২ শতাংশই নারী। এর মধ্যে ৫ শতাংশ গ্রাহক অমুসলিম।
চলমান মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক। বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতে ৩ হাজার কোটি, সিএসএমই খাতে ২ হাজার কোটি ও কৃষিতে ৪০০ কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রবাসীদের কাছেও যথেষ্ট আস্থা অর্জন করেছে ইসলামী ব্যাংক। দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশ আসছে ব্যাংকটির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সিংহভাগই ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠান। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৬৭১ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমেই এসেছে ২১২ কোটি ডলার।
প্রবাসীদের নারী স্বজনরা ইসলামী ব্যাংকের সেবা নেয়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করেন বলে মনে করছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম। তিনি বলেন, গ্রাহকদের ভিড় বেশি থাকায় আমাদের প্রতিটি শাখায় নারী গ্রাহকদের দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে টাকা তুলতে হয়। অথচ আমি কখনো তাদের মুখে বিরক্তির ছাপ দেখিনি। আমাদের কর্মীরা নারী গ্রাহকদের নিজেদের মা-বোনের মতোই সম্মান করেন। ফলে নারীরা ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
২০২১ সালের প্রথম দিন থেকে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে ইসলামী ব্যাংক। এরই মধ্যে ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে শীর্ষ নির্বাহী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মুনিরুল মওলা এখানে কর্মরত ১৯৮৬ সাল থেকে।
নিজস্ব কর্মীকেই শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারার বিষয়টিকে ইসলামী ব্যাংকের সফলতা হিসেবে দেখছেন মো. মাহবুব উল আলম। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের মতো দেশের বৃহৎ ব্যাংক পরিচালনার জন্য একজন যোগ্য মানুষ দরকার। আমরা সে যোগ্য মানুষ তৈরি করতে পেরেছি।
দীর্ঘ কর্মজীবনে মুনিরুল মওলা সততা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমার ভালো লাগছে এই ভেবে, একজন যোগ্য মানুষের হাতে ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পেরেছি।
Posted ৫:০৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | rina sristy