বিবিএনিউজ.নেট | সোমবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 309 বার পঠিত
চীনের একটি প্রাচীন কবিতার দুটি চরণ এমন: “চাঁদের দিকে তোমার চোখ মেলে ধর/মাথা নত করে বাড়ির কথা মনে কর।” চীনে পূর্ণিমার গোল চাঁদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনের প্রতীক; এ চাঁদ চীনা মানুষকে আপনজনদের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রাচীন কালে চীনা মানুষ চাঁদের উপাসনাও করতো। আজকাল অবশ্য তেমনটা কমই দেখা যায়। তবে, এখনও চীনে মধ্য-শরৎ উৎসবে চীনা মানুষ মুনকেক (চাঁদের মতো গোল কেক) খায় এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়। কেউ কোনো কারণে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে না-পারলে, পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্বজনদের কথা স্মরণ করে। চীনাদের কাছে চাঁদ আরেকটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে চান্দ্রপঞ্জিকা। চীনে চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে সারা বছরজুড়ে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। কৃষিশিল্পেও আছে চান্দ্রপঞ্জিকার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একসময় ‘চাঁদের বুড়ি’র গল্প প্রচলিত ছিল। এখনও হয়তো আছে! আমাদের ছোটবেলায় আমরা রীতিমতো এটা বিশ্বাস করতাম যে, চাঁদে একজন বুড়ি অবিরাম সুতা কেটে চলেছেন! চীনেও চাঁদ সম্পর্কে অনেক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তেমনি এক কাহিনীর নায়িকা ‘ছাং এ’। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ছাং এ ছিলেন হৌ ই নামক এক ভালো মানুষের স্ত্রী। হৌ ই একসময় অমরত্বের ওষুধ পেয়ে যান। কিন্তু ওষুধ অল্প, একজন মাত্র খেতে পারেন। হু ই স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসতেন। তিনি একা অমর হতে চাইলেন না। তাই তিনি ওষুধ গোপন জায়গায় রেখে দিলেন। একসময় স্ত্রী ছাং এ ওষুধের সন্ধান পেয়ে যান এবং অমরত্বের লোভে সেটুকু খেয়ে ফেলেন। ফলস্বরূপ, ছাং এ পরিণত হন পরীতে এবং ‘চাঁদবাসে’ যেতে বাধ্য হন। চাঁদে যাবার সময় তিনি সঙ্গে শুধু একটি খরগোশ নিতে পেরেছিলেন। সেই থেকে ছাং এ তাঁর প্রিয় খরগোশটি নিয়ে চাঁদে বাস করছেন। অনেক চীনার কাছে ‘ছাং এ’ হচ্ছেন চাঁদের দেবী।
চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিল আর্মস্ট্রং। তিনি ও এডউইন অলড্রিন মিলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকাও চাঁদের বুকে স্থাপন করেছিলেন। চাঁদে মানুষ পাঠানোর স্বপ্নপূরণ থেকে চীন এখনও কমপক্ষে ১০ বছর দূরে থাকলেও, চাঁদের বুকে চীনের পতাকা স্থাপিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। ‘ছাং এ ৫’ মিশনের অংশ হিসেবে, মানুষের হয়ে কাজটা করেছে রোবট। মার্কিন জাতীয় পতাকার পাশাপাশি চীনের জাতীয় পতাকাও এখন শোভা পাচ্ছে চাঁদের বুকে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহে ‘ছাং এ’ নামের কোনো চীনা দেবী নেই, কিন্তু আছে চীনের পাঁচ তারকাখচিত লাল পতাকা! কবে নাগাদ চীনা মহাকাশচারীরা নিজেদের পদচিহ্ন চাঁদের বুকে এঁকে দিতে সক্ষম হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
চীনে বাস্তবেও ‘ছাং এ’ আছে। এ ছাং এ অবশ্য কোনো নারী বা পরী নয়; এ ‘ছাং এ’ হচ্ছে চন্দ্রযান, যেটির নামকরণ হয়েছে পৌরাণিক কাহিনীর ওই দেবীর নামে। চীনা মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত এক এক করে পাঁচটি ‘ছাং এ’ চন্দ্রযান তৈরি করেছেন। এর মধ্যে পঞ্চমটি নিয়ে বর্তমান বিশ্বে চলছে ব্যাপক আলোচনা, বিশেষ করে বিজ্ঞানের জগতে। চাঁদের বুক থেকে মাটি আর পাথর সংগ্রহ করে সেটি পৃথিবীতে আসছে। অনেক কারণেই এই ঘটনাটি চীনের জন্য তথা গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানের জগতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে, পঞ্চম ‘ছাং এ’-র প্রসঙ্গে যাবার আগে আগের চারটি ‘ছাং এ’ সম্পর্কে একটু বলে নিই।
বিগত ২০০০ সালের ২২ নভেম্বর চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ তথা মন্ত্রিসভার তথ্য-কার্যালয় থেকে দেশের মহাকাশ-গবেষণা নিয়ে প্রথমবারের মতো একটি শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়। শ্বেতপত্রে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়: ‘চন্দ্র-গবেষণার ওপর ভিত্তি করে, চীনে গভীর-মহাকাশ নিয়ে প্রাথমিক গবেষণার কাজ শুরু করা হবে’। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকার চন্দ্র-অনুসন্ধান প্রকল্প অনুমোদন করে। শুরু হয় গভীর মহাকাশ নিয়ে গবেষণার কাজ।
চীনের প্রাথমিক পর্যায়ের চন্দ্র-অনুসন্ধান কার্যক্রমকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়: প্রথম পর্যায়ে অনুসন্ধান-উপগ্রহ কর্তৃক চন্দ্র-প্রদক্ষিণ; দ্বিতীয় পর্যায়ে চন্দ্রযানের চাঁদের বুকে অবতরণ; এবং তৃতীয় পর্যায়ে মনুষ্যবিহীন চন্দ্রযানের চাঁদের বুকে অবতরণ ও পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন। গোটা প্রক্রিয়াটি মোটামুটি এমনভাবে সাজানো হয়: প্রথম দিকে অনুসন্ধান-উপগ্রহ চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে ও পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। পরে এসব তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে চীনের চন্দ্রযান চাঁদের বুকে অবতরণ (soft landing) করবে। এ যাত্রা হবে একমুখী বা ওয়ান ওয়ে; চন্দ্রযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে না, বরং সেটি চাঁদের বুকে পূর্বনির্ধারিত গবেষণা চালাবে এবং পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করবে পৃথিবীতে। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে চন্দ্রযানকে চাঁদের বুকে অবতরণ করানো হবে এবং প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহের পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে।
পরিকল্পনা অনুসারে, ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর চীনের প্রথম চন্দ্র-অনুসন্ধান কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ছাং এ ১’ (Chang’eⅠ) উৎক্ষেপণ করা হয়। ৫ নভেম্বর, দীর্ঘ যাত্রাশেষে, বেইজিং সময় সকাল ১১টা ৩৭ মিনিটে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে ‘ছাং এ ১’ এবং চাঁদকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে। চন্দ্র-অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করে চীন। নিজের পূর্বনির্ধারিত কাজ শেষ করার ১২৭ দিন পর চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে ‘ছাং এ ১’। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে উপগ্রহটি চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পৃথিবীতে পাঠায়।
এর পর চীন একে একে ‘ছাং এ ২’ ও ‘ছাং এ ৩’ চাঁদে পাঠায়। এই তিনটি চন্দ্রযানকে ডাকা হয় ‘তিন ফুল-বোন’ বলে। চাঁদে চন্দ্রযানের সফ্ট ল্যান্ডিংয়ের সম্ভাব্যতা ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি যাচাই করার কাজটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করে ‘ছাং এ ২’। আর এই কাজ করতে গিয়ে এটি ৭ কোটি কিলোমিটারের বেশি পথ (পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব এবং চন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করার সময় অতিক্রান্ত দূরত্বের যোগফল) অতিক্রম করে। এর আগে চীনের কোনো মহাকাশযান এতো বেশি পথ অতিক্রম করেনি। এর পর ‘ছাং এ ৩’ চাঁদের বুকে অবতরণ করে, যাকে কেতাবি ভাষায় বলে ‘সফ্ট ল্যান্ডিং’। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীন তৃতীয় দেশ হিসেবে এ সাফল্য অর্জন করে। তবে, ‘ছাং এ ৩’ চাঁদের বুকে কর্মঘন্টার হিসেবে আগের দুই দেশের চন্দ্রযানগুলোকে পেছনে ফেলে, তথা বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে। এই ‘তিন ফুল-বোন’-এর সম্মিলিত সাফল্যের ফলে চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামিয়ে, সেটি আবার পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার প্রযুক্তি আয়ত্ত করে চীন। পরে, চাঁদের দূরবর্তী অন্ধকার অঞ্চলে ‘ছাং এ ৪’ অবতরণ করিয়ে চন্দ্র-গবেষণার ক্ষেত্রে আরেকটি রেকর্ড করে দেশটি। ‘ছাং এ ৪’ চাঁদের বুকে এখনও কাজ করে চলেছে, পূর্বনির্ধারিত সময়ের চেয়ে যা অনেক বেশি।
চার চারটি ‘ছাং এ’ চন্দ্রযান পাঠানোর পর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ‘ছাং এ ৫’ যাত্রা শুরু করে চাঁদের উদ্দেশ্যে। এবারের যাত্রা একমুখী নয়, বরং দ্বিমুখী; যাবে আবার ফিরেও আসবে, সঙ্গে নিয়ে আসবে চাঁদের মাটি ও পাথর। চাঁদ থেকে মাটি ও পাথরের নমুনা সঙ্গে করে পৃথিবীতে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত চন্দ্রবিজয়ীত্রয়: মাইকেল কলিন্স, এডউইন অলড্রিন ও নিল আর্মস্ট্রং। সে ১৯৬৯ সালের কথা। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন তিন তিনবার চাঁদে মানববিহীন চন্দ্রযান নামিয়ে একুনে ৩০০ গ্রাম নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। সেটিও প্রায় ৪০ বছর আগের কথা! ‘ছাং এ ৫’-এর লক্ষ্য দুই কেজি বা ২০০০ গ্রাম নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা। সেই লক্ষ্য পূরণ হতে চলেছে। ‘ছাং এ ৫’ চন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে গত ২৪ নভেম্বর। চলতি ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে চন্দ্রযানটির একটি অংশ চাঁদের নমুনা নিয়ে চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ার সিজি ওয়াংছি অঞ্চলে অবতরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীনের এই চন্দ্রাভিযান মোটেই সহজ কাজ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা-র উপ-প্রধান বিজ্ঞানী ডেভিড ড্রেপার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন: ‘এটি সত্যিই একটি দুঃসাহসী ও স্পর্ধার মিশন।’ কেন এটি দুঃসাহসী মিশন? একটু খুলে বলি। মোটাদাগে ‘ছাং এ ৫’-এর মোট চারটি অংশ: অরবিটার (Orbiter), ল্যান্ডার (Lander), অ্যাসেন্ডার (Ascender), ও রিটার্নার (Returner)। অন্যভাবে বললে, চন্দ্রযানটির দুটি অংশ: অরবিটার-রিটার্নার অংশ এবং ল্যান্ডার-অ্যাসেন্ডার অংশ। চন্দ্রযানটি চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করার পর প্রথম ঠিক কোথায় অবতরণ করবে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক করে নেয়। তারপর ল্যান্ডার-অ্যাসেন্ডার অংশ সেই নির্ধারিত অংশে অবতরণ করে। একটি যান্ত্রিক হাত চাঁদের বুকে প্রায় ৬ ফুট গর্ত খুড়ে নমুনা সংগ্রহ করে। চাঁদের উপরিতল থেকেও সংগ্রহ করা হয় মাটি ও পাথরের নমুনা। সব মিলিয়ে প্রায় ২ কেজি নমুনা একটি কনটেইনারে নেওয়া হয়। পরে সেই কন্টেইনার নিয়ে অ্যাসেন্ডার অংশটি চাঁদের বুক ছেড়ে শূন্যে উঠে যায়। ওদিকে, অরবিটার-রিটার্নার অংশ চাঁদকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত। অ্যাসেন্ডারকে নিখুঁতভাবে অরবিটার-রিটার্নার অংশের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। অরবিটার-রিটার্নারের গতি, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, অ্যাসেন্ডারের গতি—সবকিছুই এখানে বিবেচ্য বিষয়।
মোদ্দাকথা, অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। সামান্য একটু এদিক-ওদিক হলেই সব শেষ! শেষ পর্যন্ত এই জটিলতম কাজটিও সম্পন্ন হয়। এধরনের সংযুক্তির কাজ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো মিশনেও ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে। কিন্তু তখন অরবিটার অংশে কলিন্স ছিলেন এবং অ্যাসেন্ডার অংশে ছিলে অলড্রিন ও আর্মস্ট্রং! এবার কোনো মানুষ নেই! তাই কাজটা ছিল জটিলতর। যা হোক, সংযুক্তির পর চন্দ্রযানের রিটার্নারে নমুনার কনটেইনারটি সফলভাবে স্থানান্তর করা হয়। এর পর অ্যাসেন্ডার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অরবিটার-রিটার্নার অংশ থেকে। এখন এই অরবিটার রিটার্নারকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। শেষ পর্যন্ত চাঁদের নমুনাসম্বলিত রিটার্নারই ইনার মঙ্গোলিয়ায় অবতরণ করবে, যদি সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলে।
চীনের ‘ছাং এ ৫’ মিশন নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাসসৃষ্টিকারী। প্রথম কথা হচ্ছে, এ মিশনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ৪০ বছর পর আবারও চাঁদের মাটি-পাথর নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাবেন। আবার চীনের চন্দ্রযান নমুনা সংগ্রহ করেছে এমন একটি জায়গা থেকে, যেখানে এর আগে কোনো চন্দ্রযান অবতরণ করেনি। চাঁদের এই জায়গাটির নাম ‘মনস রামখা’ (Mons Rumker)। জায়গাটি একটি আগ্নেয় সমভূমি (volcanic plain)। এটি ‘ঝড়ের সমুদ্র’ (Ocean of Storms) নামেও পরিচিত। নাসার বিজ্ঞানী ডেভিড ড্রেপার বলেছেন, এই স্থানের নমুনা নিয়ে গবেষণা করতে পারলে বিজ্ঞানীরা চাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য পাবেন। তাঁর এই বক্তব্যের কারণও আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নমুনা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, চাঁদের বুকে আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে। কিন্তু আজকাল বিজ্ঞানীরা বলছেন মনস রামখা’র মতো এলাকায় সম্ভবত ১২০ কোটি বছর আগেও আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল।
চীনের বিজ্ঞানী সিয়াও লুং এ প্রসঙ্গে বলেন: ‘বিজ্ঞানীদের এ ধারণা যদি সত্যি হয়, তবে চীনের চন্দ্রযানের সংগৃহীত নমুনা নতুন ইতিহাস রচনা করবে’। বস্তুত, ‘ছাং এ ৫’ কর্তৃক সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কেও অজানা তথ্য পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনা বিজ্ঞান একাডেমির ইন্সটিটিউট অব জিওলোজি অ্যান্ড জিওফিজিক্সের গবেষক লিন ইয়াংথিং বলেছেন, “চাঁদের মাটি হচ্ছে একটি গোপন বইয়ের মতো, যাতে পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদের অনেক গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে। আমাদের সৌরজগত ও পৃথিবীকে আরও ভালোভাবে জানতে চাঁদের মাটির গবেষণা সাহায্য করবে।”
এখানে একটি কথা বলে রাখি, পৃথিবী থেকে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার কিলোমিটার দূরে, চাঁদের কক্ষপথে চন্দ্রযানের দু’টি মানববিহীন অংশের (অরবিটার-রিটার্নার ও অ্যাসেন্ডার) সংযুক্তির ঘটনা মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এবারই প্রথম ঘটলো। তা ছাড়া, চাঁদের পৃষ্ঠের ৬ ফুট নিচ থেকে নমুনা সংগ্রহের ঘটনাও এই প্রথম ঘটেছে। এই দুই দিক দিয়েও চীনের এবারের চন্দ্রাভিযান বিশেষ স্থান দখল করে থাকবে।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরাও গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন ‘ছাং এ ৫’ মিশন থেকে প্রাপ্ত চাঁদের নমুনা নিয়ে গবেষণার সুযোগের জন্য। নাসা’র অ্যাসোসিয়েট এডমিনিস্ট্রেটর থমাস জাবুহন (Thomas Zurbuchen) এক টুইটে বলেছেন: “এটা (ছাং এ ৫ মিশন) মোটেই সহজ কাজ নয়। যখন এই নমুনা পৃথিবীতে আসবে, তখন আশা করি, সবাই তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পাবেন এবং এর মাধ্যমে বিশ্বের বিজ্ঞান জগতে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।” চীনও ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে, ‘ছাং এ ৫’ কর্তৃক সংগৃহীত নমুনা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরাও পাবেন। চায়না ন্যাশনাল স্পেস এডমিনিস্ট্রেশান (সিএনএসএ)-এর চন্দ্রাভিযান ও মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের উপ-পরিচালক চাও ইয়ু বলেছেন, দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা ‘ছাং এ ৫’ মিশন থেকে প্রাপ্ত চাঁদের নমুনা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাবেন।
না, চীনের চন্দ্রাভিযান এখানেই থেমে যাবে না। চীন চাঁদে স্থায়ী স্টেশনও নির্মাণ করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা-ও একই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নাসা চীনের চেয়ে পিছিয়ে আছে বলা চলে। কারণ, ১৯৭২ সালের পর নাসা চাঁদে কোনো মিশন পাঠায়নি। অন্যদিকে, ‘ছাং এ ৫’ মিশন চূড়ান্তভাবে সফল হবার পর, চীনের চন্দ্রাভিযান নতুন পর্যায়ে পৌঁছাবে। চায়না ন্যাশনাল স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন (সিএনএসএ) চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিএনএসএ আগেই জানিয়েছে যে, ‘ছাং এ ৬’ চাঁদের দক্ষিণ মেরু থেকে আরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করবে এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রায় ১০ কেজি নমুনা অফার করবে। আর ‘ছাং এ ৭’ চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ল্যান্ডস্কেপ, ভূমির গঠন, পরিবেশ বিশ্লেষণ করবে এবং ‘ছাং এ ৮’ মিশন চাঁদের বুকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির পরীক্ষা চালাবে। চাঁদের মেরুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ, এখানে ১৮০ দিন অবিরাম সূর্যালোক পাওয়া যায়। ‘ছাং এ ৮’ মিশনে চাঁদে স্থায়ী স্টেশন গড়ে তুলতে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে ও এক্ষেত্রে একাধিক দেশের সঙ্গে কাজ করবে চীন। অবশেষে চীনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানো।
চীনের চন্দ্রাভিযান কার্যক্রমের প্রধান ডিজাইনার উ ওয়েইরেন বলেছেন, চাঁদের বুকে স্থায়ী স্টেশন গড়ে তোলার মৌলিক অবকাঠামোর মধ্যে থাকবে চাঁদের কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত একাধিক উপগ্রহ এবং চাঁদের বুকে কর্মরত একাধিক যান। ইতোমধ্যেই চীনের এমন প্রায় ৭টি উপগ্রহ ও যান চাঁদের কক্ষপথে ও চাঁদের বুকে সক্রিয় আছে বলে জানা গেছে। উ ওয়েইরেন আরও বলেন, চাঁদে স্থায়ী স্টেশান তৈরিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী চীন।
চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিল আর্মস্ট্রং। তিনি ও এডউইন অলড্রিন মিলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকাও চাঁদের বুকে স্থাপন করেছিলেন। চাঁদে মানুষ পাঠানোর স্বপ্নপূরণ থেকে চীন এখনও কমপক্ষে ১০ বছর দূরে থাকলেও, চাঁদের বুকে চীনের পতাকা স্থাপিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। ‘ছাং এ ৫’ মিশনের অংশ হিসেবে, মানুষের হয়ে কাজটা করেছে রোবট। মার্কিন জাতীয় পতাকার পাশাপাশি চীনের জাতীয় পতাকাও এখন শোভা পাচ্ছে চাঁদের বুকে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহে ‘ছাং এ’ নামের কোনো চীনা দেবী নেই, কিন্তু আছে চীনের পাঁচ তারকাখচিত লাল পতাকা! কবে নাগাদ চীনা মহাকাশচারীরা নিজেদের পদচিহ্ন চাঁদের বুকে এঁকে দিতে সক্ষম হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Posted ১:৫৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed