শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাক্ষাৎকারে ড. এম মোশাররফ হোসেন, চেয়ারম্যান, আইডিআরএ

‘বীমা খাতে মানিলন্ডারিং বন্ধে প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র কমিটি দরকার’

জাহিদুল ইসলাম   |   বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   426 বার পঠিত

‘বীমা খাতে মানিলন্ডারিং বন্ধে প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র কমিটি দরকার’

মানিলন্ডারিং বা অবৈধ অর্থকে বৈধ করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে দুই দশক আগেও দেশের সাধারণ মানুষ তেমন পরিচিত ছিল না। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ক্যান্সার বা এইডসের মতো এই মহাব্যাধী আজ আর্থিক খাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। আমাদের অজান্তেই শেষ করে দিচ্ছেন দেশের অর্থনীতির কাঠামো। যেন আর্থিক খাতের ‘নিরব ঘাতক’। মানিলন্ডারিংয়ের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন পাস করে। আইনটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে এবং এর আওতায় তদন্ত ও মামলা করতে দুদককে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অন্যথম উপাদান হচ্ছে বীমা ব্যবসা। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো মানবজীবন, সম্পদ ও ব্যবসায়ের বিভিন্ন ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা প্রতিকারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করে। তবে মানিলন্ডারিংয়ের ঝুঁকি থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও মুক্ত নয়। বরং বীমা ব্যবস্থা মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের দিকথেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বিষয়ে বীমা খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে প্রতিবছরের মতো এবারও বীমা খাতের ক্যামেলকো সম্মেলন- ২০২১ আয়োজন করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ। আগামী ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের কাছে। সে সময় বীমা খাতে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে আইডিআরএ’র ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি’র প্রতিবেদক জাহিদুল ইসলাম। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি : বীমা খাতে সম্প্রতি মানিলন্ডারিং যে ঘটনাগুলো উদঘাটিত হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আইডিআরএ’র পদক্ষেপ কি?

ড. এম মোশাররফ হোসেন: মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টা বিএফআইইউ দেখে এবং এটাই তাদের দায়িত্ব। বিষয়গুলো দেখতে তাদের অধিক ক্ষমতা রয়েছে। হয়তো আপনার জানা আছে, ফ্যাটএফ (এফএটিএফ- দ্যা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স) নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে বিভিন্ন দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটগুলো। বাংলাদেশে রয়েছে বিএফআইইউ। তারাই মূলত এটা দেখেন। তাদের আইনটিও অনেক শক্তিশালী। সেটা যেমন শাস্তির দিক থেকে তেমনি তথ্য আদান প্রদান ও সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রেও। এখন যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে যে, আমরা এ বিষয়ে কি করছি? এক্ষেত্রে বলবো- আমরা যেখানে মনে করছি মানিলন্ডারিংয়ের উপদান রয়েছে সেগুলো আমরা বিএফআইইউ’র কাছে পাঠিয়ে দেই। তারা যদি তখন বিচার বিশ্লেষণ করে এ ধরণের ঘটনার বিষয়ে প্রমাণ পান তখন আইনের আওতায় তারা ব্যবস্থা নেন। এ ধরণের কিছু ঘটনা আমরা ইন্স্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে পেয়েছি। যেসব ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে যেমন বিদেশে ফান্ড যাওয়া, লেয়ারিং মতো ঘটনা ঘটিয়ে টাকা আগমনের আসল উৎসকে গোপন করা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে বিএফআইইউ’র সহায়তা নিয়েছি। আমাদের আইনে পলিসিহোল্ডারের স্বার্থ রক্ষা করে যতটুক সম্ভব দেখে বাকিটা বিষয় বিএফআইইউকে প্রেরণ করি। সাধারণত কোম্পানিগুলো থেকে এসটিআর আমাদের কাছে তেমন আসেনা। যতটুক সেটা মিডিয়া থেকে তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান করি। প্রমাণ পেলে আমাদের আইনেই বেশিরভাগ (আত্মসাৎ, খেলাপী) ব্যবস্থা নেই। তবে মানিলন্ডারিং পেলে আমরা তখন বিএফআইইউকে জানাই। মানিলন্ডারিং একটি বড় বিষয়, এর শস্তি ও জরিমানাও ব্যাপক। তাই ওই অবস্থায় যাওয়ার আগে নিশ্চিত হতে হয় এমনটা হয়েছে কিনা? কারণ সবই তো আর মানিলন্ডারিং না। ধরুন, এক ব্যক্তি পলিসিহোল্ডারের টাকা মেরে দিয়েছে, সেক্ষেত্রে মানি স্যুট করতে হবে, এটা মানিলন্ডারিং না।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি : বীমা খাতে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে আইডিআরএ কি ভূমিকা রাখছে?

ড. এম মোশাররফ হোসেন : আপনারা জানেন ইন্স্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রির বিষয়ে বিএফআইইউ’র একটি মার্স্টাস সার্কুলার আছে। মূলত ওই সার্কুলারটা যেন সঠিকভাবে মেনে চলা হয় এটা তদারকি করাই আমাদের প্রাথমিকভাবে বড় দায়িত্ব। এটা অনুসরণ করলে অনেকাংশেই এ ধরণের ঘটনা কমে যাবে। আর দ্বিতীয়ত হলো এর সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ। সেটার জন্য আমরা প্রায়শই প্রশিক্ষণের আয়োজন করি, যেটা নভেম্বরের ১২ তারিখে বীমাখাতের ক্যামেলকোদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে কিভাবে তারা আইন পরিপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে, কিভাবে এসটিআর করবে এগুলো দেখানো হবে। তৃতীয়ত হলো- কি কি ক্ষেত্রে কি কি ভাবে মানিলন্ডারিংয়ের সুযোগ থাকে সে বিষয়ে ক্যামেলকোদের ট্রেইন আপ করা। এইগুলো আইডিআরএ করছে।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি : বীমা খাতে মানিলন্ডারিং পুরোপুরি বন্ধ করতে কি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

ড. এম মোশাররফ হোসেন : আইন পুরোপুরি পালন করলেই যে মানিলন্ডারিং নির্মূল হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমরা যখন কোন নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন দেই যে, একটা অনিয়ম যেন না ঘটতে পারে তার জন্য এইসব কাজ করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে, পরিকল্পনা ও গবেষণা করে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যায় ঠিকই তারা ফাঁকফোকড় বের করে ফেলে। মানিলন্ডারিং নিয়ে সারা বিশ্বেই ভালো কাজ চলছে। এটাকে দূর করতে হলে সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি : আইডিআরএ’র কাছে এখন পর্যন্ত কতটি মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ এসেছে এবং আইডিআরএ কি পদক্ষেপ নিয়েছে?

ড. এম মোশাররফ হোসেন : অভিযোগ এসেছে এবং একাধিক অভিযোগ আছে মানিলন্ডারিং ইস্যুতে। এসবের মধ্যে দু’একটি আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করেছি। তারা যেহেতু এ বিষয়ে প্রফেশনাল, তারা এইসব অভিযোগ নিয়ে তাৎক্ষণিক কোন মন্তব্য করেনি। তারা তাদের পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণে যখন দেখে তখন বলে এটা মানিলন্ডারিং। যে সব অভিযোগ দেয়া হয়েছে সেগুলো ওই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়নি, কিন্তু আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে অবহিত করেছি। এছাড়া অন্য আরো দু’একটা ইস্যু আছে, সেগুলোর একটিতে আমাদের কাজ চলছে। এটাতে বিদেশে ফান্ড প্রেরণের ঘটনা থাকায় মানিলন্ডারিংয়ের উপাদান রয়েছে।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি : বীমা কোম্পানিগুলোকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হলেও এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

ড. এম মোশাররফ হোসেন : এখানে শুধু একজন ক্যামেলকো দিয়েই যে হবে তা নয়, এখানে মানিলন্ডারিং মনিটরিংয়ে অনেকগুলো স্তর রয়েছে। এজন্য এই দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলকেই জানতে হবে কোন লেনদেনটা সন্দেহজনক, সেই ট্রানজেকশন ধরেই এগোতে হবে। এখানেই একটা চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হলো- যারা এই দায়িত্বে রয়েছে তাদের যদি একটি স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে দেয়া না হয়, যেমন: একটি ব্যাংকে যদি সন্দেহজনক লেনদেন হয় এবং সেটা যদি বিএফআইইউতে জানানো হয় তবে দেখা গেলো ওই গ্রাহক ব্যাংকে আর এফডিআর করছে না। এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা গেলে হয়তো পরিত্রাণ সম্ভব। সেজন্য একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বডি দরকার, যদিও ইন্ডিপেন্ডেন্ট থাকে না। যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডাইরেক্টর কি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থাকে? তারা কোন না কোনভাবে পকেটস্থ হয়ে যায়। তখন দেখা যায়, তারাই কোন অনিয়ম করতে সহায়তা করে, বা দেখেও না দেখার ভান করে। অতীত বিষয় বিশ্লেষণ করলে এমনটাই দেখা যায়। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে কিছু করতে গেলে আপনি আর স্বতন্ত্র থাকছেন না। এ ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ আছে। পাশাপাশি আইন কঠিন করতে হবে। যেমন আমাদের দেশের বীমা আইনে সর্বোচ্চ আর্থিক জরিমানা ৫ লাখ টাকা, অথচ ভারতে সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার সুযোগ রয়েছে। যদি এ ধরণের একটি জরিমানার মুখেও কেউ পড়ে তবে এটা তার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা দূর্বলতা তো আছেই আবার আইনও তেমন শক্তিশালী নয়।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি : সকল বীমা প্রতিষ্ঠানে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে সেন্ট্রাল কমপ্লায়েন্স ইউনিট গঠিত আছে কিনা এবং এসকল তথ্য আইডিআরএ’র কাছে রয়েছে কিনা?

ড. এম মোশাররফ হোসেন : বীমার সব প্রতিষ্ঠানেই সেন্ট্রাল কমপ্লায়েন্ট ইউনিট আছে। গত বছর করোনার কারণে কনফারেন্স হয়নি কিন্তু এর আগের বছর হয়েছে। আবার এখন হচ্ছে। এসব বিষয়ে তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে। যদি সেটা না হয়, তাহলে আমাদের আইনে এক অপরাধ, আবার বিএফআইইউ’র আইনেও আরেক অপরাধ।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:১৩ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।