বুধবার ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এসবিসির ভুয়া অ্যাকাউন্টে ২৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ

সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩৫ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছে দুদক

আবুল কাশেম কবিরাজ   |   সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   267 বার পঠিত

সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩৫ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছে দুদক

এক্সিম ব্যাংক লিমিটেডের ইমামগঞ্জ শাখায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) নামে ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যেমে প্রিমিয়ামের ২৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার তদন্তে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ৩৫ জনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার তথ্য উপাত্ত পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ওই ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যেমে এসবিসির প্রিমিয়ামের ২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের প্রধান আসামি মো. আবুল কাশেম এবং সহযোগী আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে গত ২৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেছে দুদক। এর আগে গত বছর ২০২০ সালে ৯ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক সিরাজুল হক বাদী হয়ে এসবিসির নিউমার্কেট শাখা-৯ এর সাবেক ম্যানেজার মো.আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ৫(২) ও ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। এর পর গত ২৯ জুলাই প্রধান আসামি আবুল কাশেমকে গ্রেফতার করে দুদক।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, বিদেশ থেকে সরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানিকৃত মালামাল বন্দর থেকে খালাস করার জন্য মেরিন বীমা পলিসি করতে হয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বুয়েট, বিসিএসআইআরসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রিমিয়ামের অর্থ প্রায় ২৬ কোটি টাকা আত্মসাত মামলার মূল আসামি এসবিসির নিউমার্কেট শাখার ম্যানেজার আবুল কাশেম। তিনি জালিয়াতির মাধ্যে এক্সিম ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখায় একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট করেন। সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান বীমার প্রিমিয়ামের টাকা ভুয়া কাগজপত্রের ওপর পরিশোধ করেছে। ব্যাংকের পে-অডারে এসবিরির কোন শাখার বিল তা উল্লেখ ছিল না। এছাড়াও হাতে হাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ টাকার বীমার প্রিমিয়ামের পে-অর্ডার দেওয়া এবং গ্রহণ করার কোনো আইন ও বিধান নেই। অফিস থেকে ফরোয়াডিংসহ এসবিসির সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো টানা ১০ বছর ধরে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে দুদকের মামলায় চার্জশিটে তাদেরও আসামি করা হয়।

এদিকে দুদকের সহকারী পরিচালক সিরাজুল হক এক বছর ধরে ওই মামলার তদন্ত করে সাধারণ বীমা, এক্সিম ব্যাংক, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বুয়েট, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার তথ্য উপাত্তসহ কমিশনের সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর গত ১৫ নভেম্বর কমিশনের বৈঠকে ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেওয়া হয়। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব জালিয়াতির চিত্র। এমন কী তাদের তৈরি করা চিঠিতে প্রিমিয়ামে জমা দেওয়া অর্থ এসবিসির কোন শাখা সংশ্লিষ্ট তার উল্লেখ থাকতো না। বাহকের চেকের মতো হাতে হাতে এসবিসির বীমার প্রিমিয়ামের চেক/পে-অর্ডারগুলো সাবেক ম্যানেজার আবুল কাশেমের হাতে তুলে দিতেন। আবুল কাশেম নকল মানি রশিদ দিয়ে ওই পে-অর্ডারগুলো গ্রহণ করে এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় জমা করতেন। আবার নিজেই সুযোগ মতো ওই ব্যাংক থেকে টাকা স্থানান্তর ও উত্তোলন করতেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন ও নিয়ম নীতি অমান্য করে টানা ১০ বছর ধরে চলছে প্রতারণা, জালিয়াতি এবং কোটি কোটি টাকার আত্মসাতের ঘটনা। প্রিমিয়ামের অর্থ প্রদানকারীদের পক্ষ থেকে এসবিসির প্রধান ও সংশ্লিষ্ট শাখা কার্যালয়কে অফিসিয়াল চিঠির মাধ্যমে অবহিত করার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তারা বিষয়টি গোপন রাখেন।

সূত্র মতে, ৩৫ জন আসামির মধ্যে ভুয়া অ্যাকাউন্টের মালিক এসবিসির সাবেক শাখা ম্যানেজার মো. আবুল কাশেম, তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার, এসিবিসির ফার্মগেট শাখার সাবেক ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম, এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার সাবেক ম্যানেজার, বর্তমানে কেরানীগঞ্জ শাখায় কর্মরত মুসা আহমেদ। এসবিসিকে প্রিমিয়াম প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাকী ৩১ জনের মধ্যে আছেন-বুয়েটের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিদফতর) মিজানুর রহমান, উপ-পরিচালক শেলিনা বেগম, কন্ট্রোলার জসিম উদ্দিন আখন্দ।
২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বুয়েটের ১২৬টি পে-অর্ডার/চেকের মাধ্যেমে এসবিসির নামে ইস্যুকরা বীমা প্রিময়াম প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১৯ জন:
এসবিসির বীমা প্রিমিয়ামের প্রায় ১৯ কোটি আত্মসাতের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১৯ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। তাদের সহযোগিতায় টানা ১০ বছর ধরে ৬২টি পে-অর্ডার/ চেকের মাধ্যমে এসবিসির নামে তৈরি করা বীমা প্রিমিয়ামের এসব অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।

এ ১৯ জনের মধ্যে আছেন-বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ পরিদফতর শাখার সাবেক নিম্নমান সহকারী (বীমা) উপেন্দ্র চন্দ্র দাস, নিম্নমান সহকারী এএফএম আশরাফুল আলম, হিসাব পরিদফতরের সাবেক উপ-পরিচালক (হিসাব) কাজী আসরাফুল হক, সাবেক সহকারী পরিচালক (হিসাব) সাহানারা আফরোজ, সাবেক সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক (হিসাব) আলতাফ হোসাইন, সাবেক সহকারী পরিচালক (হিসাব ও অর্থ) ফয়েজ আহাম্মদ, সাবেক উপ-পরিচালক (সিপিএ সেল) আওলাদ হোসেন, সহকারী পরিচালক (হিসাব) গৌতম কুমার দেবনাথ, অডিট পরিদফতরের সাবেক উপ-পরিচালক (বর্তমানে অতিরিক্ত পরিচালক) আসাদুজ্জামান খান, হিসাব পরিদফতরের সাবেক উপ-পরিচালক (বর্তমানে অর্থ পরিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক) চুনী লাল দেবনাথ, অর্থ পরিদফতরের উপ-পরিচালক মেহবুব মোর্শেদ, উপ-পরিচালক (অর্থ) রইছ উদ্দিন, সাবেক পরিচালক আবুল বাসার চৌধুরী, সাবেক পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কাজী আহসান উল্লাহ, সাবেক পরিচালক অজিত কুমার ঘোষ, সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান সরকার, সাবেক পরিচালক নুরুল আলম, সাবেক পরিচালক আনোয়ার হোসেন।

বিসিএসআইআরের ৭ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা:
এসবিসির বীমা প্রিমিয়ামের ৩৩টি পে-অডার/ চেকের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি আত্মসাতের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা অভিযোগে বিসিএসআইআরের ৭ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে দুদকের চার্জশিটে অন্তভুক্ত করা হয়েছে। এ ৭ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হলেন- সাবেক ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. স্বপন কুমার রায়, তিনি বর্তমানে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাবেক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শিরীন আক্তার জাহান বর্তমানে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাবেক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ শাহরিয়ার বাসার বর্তমানে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাবেক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মালা খান বর্তমানে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম জামান, সাবেক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তুষার উদ্দীন বর্তমানে চামড়া গবেষণা ইনস্টিটিউটের (সাভার) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. দিপা ইসলাম।

এছাড়াও আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিদফতর) মোছেনা বেগম ও মহাখালী টিবি হাসপাতালের এমএলএসএস মো. মিলন।

এদিকে, চার্জশিট ভুক্ত আসামি এসবিসির ফার্মগেট শাখার সাবেক ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম বর্তমানে এসবিসির প্রধান কার্যালয়ে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত।

তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, কয়েক বছর আগে এসবিসির নামে বীমার প্রিমিয়ামের এক্সিম ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখার ৪/৫টি পে-আর্ডার তিনি গ্রহণ করেছিলেন। ওই পে-অর্ডারগুলো ফার্মগেট অগ্রণী ব্যাংক শাখায় তার একজন স্টাফ জমা দিয়েছেন। তিনি সরল বিশ্বাস থেকে ওই পে-অর্ডারগুলো যাচাই বাছাই করেননি। এ কারণে জহিরুল ইসলামকে চার্জশিটে আসামি করেছে দুদক। তিনি এখনো নিয়মিত অফিস করছেন।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:২২ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।