শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোহাম্মদপুরে ভবনের ছাদে ঝুঁকিপূর্ণ মোবাইল টাওয়ার

হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা লঙ্ঘন. এলাকাবাসী আতঙ্কিত. দেখার কেউ নেই

আবুল কাশেম   |   রবিবার, ০২ অক্টোবর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   101 বার পঠিত

হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা লঙ্ঘন. এলাকাবাসী আতঙ্কিত. দেখার কেউ নেই

হাইকোর্টের রায় এবং নির্দেশনা অমান্য করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর এবং ঘণবসতিপূর্ণ আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকার ভবনগুলোতে প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় মোবাইল কোম্পানির বড় বড় টাওয়ার স্থাপনের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৯ সালে ২৫ এপ্রিল হাইকোর্টের রায় এবং ১১ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে ঘণবসতিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এলাকায় ভবনের ছাদে ঝুঁকিপূর্ণ মোবাইল কোম্পানির স্থাপিত টাওয়ার দ্রুত সরাতে হবে। একই সঙ্গে নতুন টাওয়ার স্থাপন করা যাবে না।
কিন্তু হাইকোর্টের ওই রায় এবং নির্দেশনা অমান্য করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডের আবাসিক ও ঘণবসতিপূর্ণ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ছাদে অবৈধভাবে মোবাইল কোম্পানির উচু টাওয়ার বসানোর প্রতিযোগিতা চলছে। ওই এলাকায় ৬ নম্বর রোডের ২৫২/৭/এ এবং ২৫২/৮/এ পাশাপাশি দুইটি ৭ তলা ভবন। এর চারদিকে আরও অনেক ভবন রয়েছে। প্রায় ১০ বছর আগে ২৫২/৭/এ’র ছাদের ওপর স্থাপিত গ্রামীণ মোবাইল কোম্পানির বড় টাওয়ারটি এখনো সরানো হয়নি। উল্টো ওই ভবনের পাশে ২৫২/৮/এ’র ছাদের ওপর ‘বাংলালিংক’ মোবাইল কোম্পানির পরপর আরও দুইটি উচু টাওয়ার বসানোর কাজ চলছে। এই ভবনটির মালিক মো. আতাম হোসেন চৌধুরী ও চৌধুরী শাহানাজ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে (কাওরান বাজার) রাজস্ব বিভাগে ভবনটি আংশিক ৭ তলা উল্লেখ করে হোল্ডিংট্যাক্স দেওয়া হচ্ছে। অথচ পুরো ভবনটিই ৭তলা। বর্তমানে পাশাপাশি ওই দুই ভবনে মোবাইল কোম্পানির ৩টি উচু টাওয়ার স্থাপনের মাধ্যমে মারাত্নক ক্ষতিকর রেডিয়েশন নিয়ে পুরো এলাকাবাসীর মাঝে প্রচন্ড আতঙ্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই।

আরও অভিযোগ উঠেছে, ওই ভবন দুইটি মালিক রাজউকের পক্ষ থেকে ৬ তলা পর্যন্ত নিমার্ণের নকশা অনুমোদন নিয়ে ৭ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করেছেন। এর ওপর আবার মোবাইল কোম্পানীর ৩টি উচু টাওয়ার স্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু ওই ভবন মালিক এবং মোবাইল কোম্পানির লোকজন এতোই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান যে, তাদের ভয়ে ওই এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করার সহাস পাচ্ছেন না।

এদিকে ২৫২/৮/এ নম্বর ভবনের মালিক ‘আতাম সাহেরে’ সঙ্গে তার ০১৮১৯-২৩৯০৯৮ নম্বরে ছাদের ওপর ‘মোবাইল টাওয়ার’ স্থাপন নিয়ে হাইকোর্টের রায় এবং নির্দেশনার বিষয়ে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ভবন মালিক বলেন, হাইকোর্টের প্রকাশিত রায় সম্পর্কে তিনি জানেন। তাহলে ওই রায় অমান্য করে কেনো আবাসিক ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভবনের ছাদের ওপর মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করছেন ? এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন রেখে দেন।

উল্লেখ্য, ঘণবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার স্থাপনের বিষয়ে করা রিট মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চের ২০১৯ সালে ২৫ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। রায়ে দেশের ঘণবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা এবং স্পর্শকাতর জায়গা থেকে ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়ানো মোবাইল টাওয়ারগুলো দ্রুত অপসারণের আদেশ দেন। পরে ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের দুই বিচারপতির স্বাক্ষরে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়েও ১১টি নির্দেশনা রয়েছে। স্পর্শকাতর জায়গা বলতে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ছাড়াও হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজকে বোঝানো হয়েছে।

১১ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে; ১) মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণ মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার দশ ভাগের একভাগ করা। ২) মোবাইল টাওয়ার বাসার ছাদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কারাগার, খেলার মাঠ, জনবসতি এলাকা, হেরিটেজ ও প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাসহ ইত্যাদি স্থানে না বসানো এবং যেগুলো বসানো হয়েছে,তা অপসারণ করতে হবে। ৩) বিকিরণ মাত্রা যেন বেশি না হয় সে ব্যাপারে অতিরিক্ত নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৪) টাওয়ার বসাতে জমি অধিগ্রহণে কোনো বাধা আছে কি-না বা বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা। ৫) টাওয়ারের বিকিরণ মাত্রা বিটিআরসি ও লাইসেন্সি দুপক্ষকেই স্বাধীনভাবে আইটিইউ এবং আইইসির মান অনুসারে পরিমাপ করা। ৬) কোনো টাওয়ারের বিকিরণ মাত্রা বেশি হলে তা অপসারণ করে নতুন টাওয়ার বসানো। ৭) টাওয়ার ভেরিফিকেশন মনিটর পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিটিআরসির দায়-দায়িত্ব বাধ্যতামূলক করা। ৮) বিটিআরসি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। ৯) বিটিআরসিকে অন্যদেরকে নিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটি গঠন। লাইসেন্সকে প্রতি ছয় মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল। ১০) মোবাইল সেটে দৃশ্যমানভাবে এসএআর মান লেখা। ১১) সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সের প্রতিটি রিপোর্ট ও রেকর্ড পাঁচ বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদালতের আদেশ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে আরও গবেষণা করে রিপোর্ট দিতেও বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১২ সালে একুশে টেলিভিশনে ‘একুশের চোখ’ অনুষ্ঠানে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর বিকিরণের (রেডিয়েশন) বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

রিটের শুনানি নিয়ে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির কয়েকটি মোবাইল ফোন টাওয়ার পরিদর্শন করে রেডিয়েশন বিষয়ে আদালতে একটি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রায় প্রকাশের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আদালতের আদেশ অনুসারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গবেষণা করে জানায়, দেশে ব্যবহৃত টাওয়ারে নিঃসৃত বিকিরণ আন্তর্জাতিক মাত্রার তুলনার বেশি। এরপর এ নিয়ে একটি গাইড লাইন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সে অনুসারে বিটিআরসি একটি গাইড লাইন করে আদালতে দাখিল করেছিল। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে অন্তত পাঁচবারের চেষ্টায় সেই গাইড লাইন সংশোধন করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলার শুনানিতে আমরা ভারতের দুটি রায় আদালতে দাখিল করেছি। সেখানে আমরা বলেছি, আমাদের দেশের টাওয়ারের রেডিয়েশনে যে মাত্রা রয়েছে, তা ১০ ভাগের একভাগে কমিয়ে আনতে হবে।’

সূত্র মতে, আদালতের আদেশ অনুসারে মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তা (রেডিয়েশন) খুবই উচ্চমাত্রার এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মর্মে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে সব মোবাইল অপারেটর এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে (বিটিআরসি) এই তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। এছাড়া আদালত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করতে স্বাস্থ্য সচিবকে নির্দেশ দেন। ওই কমিটিতে বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং আণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধিদের রাখতে বলা হয়। এ কমিটিকে মোবাইল টাওয়ার থেকে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশগত প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৮:০৪ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০২ অক্টোবর ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।