শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বীমা খাতের উন্নতি ও অন্তরায়

অনেক অর্জন থাকলেও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি বীমা: সাক্ষাৎকারে শেখ কবির হোসেন

  |   বুধবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   480 বার পঠিত

অনেক অর্জন থাকলেও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি বীমা: সাক্ষাৎকারে শেখ কবির হোসেন

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন

জাতির পিতার স্মৃতিধন্য দেশের বীমা খাতটি বিগত ৫০ বছর ছিলো অনেকটাই নিরবে নিভৃতে। ছিল সবচেয়ে অবহেলার পাত্রও। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার কন্যা ২০০৯ সালে দেশের দায়িত্বভার গ্রহনের পর থেকেই এ খাতের উন্নয়নে নিয়েছেন নানা উদ্যমী পদক্ষেপ। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে বীমা কোম্পানিগুলো। অর্থনীতির অন্যতম এই খাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেই কার্যক্রম এখন আরো বেগবান।

স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ৫০ বছরে বীমা খাতের উন্নয়ন, অগ্রগতি, অন্তরায় ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন-এর সাথে। নিম্নে তার সাথে কথোপকথনটি তুলে ধরা হলো:

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: এমন মাহেদ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে জানতে চাই, বীমা খাত যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছে?

শেখ কবির হোসেন: স্বাধীনতার পর পর যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে বীমা খাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা করপোরেশনসহ আমাদের প্রায় ৮১টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পরেই তখন মাত্র দুটি করপোরেশন ছিল। যদি এই দেশ স্বাধীন না হতো তাহলে আজকে যে ৮১টি বীমা কোম্পানি গড়ে উঠেছে সেগুলো হতো না, তাদের উদ্যোক্তারা বা মালিক পক্ষ হয়তো কখনো বীমা কোম্পানির মালিক হতে পারতো না। সুতরাং স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটা আমাদের একটা বড় অর্জন। অপরদিকে, যদি প্রিমিয়ামের বা আর্থিক দিকের কথা বলি, তাহলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দুই করপোরেশন মিলিয়ে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৫-৬ কোটি টাকা, আর এখন আমাদের বাৎসরিক প্রিমিয়াম আয় ১২-১৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন।

তবে উল্লেখযোগ্য সূচক, যেমন: জিডিপিতে বীমার অবদানের কথা বলি, সেটা আসলে আমরা বেশিদূর এগোতে পারিনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে বা যদি শুধু এশিয়ার দেশগুলোর সাথেও তুলনা করি, আমরা এখানে অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের জিডিপিতে বীমার অবদান ০.৪০ শতাংশ। অথচ প্রতিবেশি ভারতেও এই হার ৪.২৫ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ১.২৫ শতাংশ। অবশ্য জিডিপিতে পিছিয়ে থাকার অনেকগুলো কারণ আছে। তারপরও বলবো যদি আমাদের বীমার মোট বিস্তার দেখি, এখানে সবমিলিয়ে ২০ লাখ লোক জড়িত। অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে, অনেকে উদ্যোক্তা হয়েছেন অনেকে প্রশিক্ষিত হয়েছে, সে অর্থে এটা একটা বড় অর্জন আমাদের জন্য। আমরা হয়তো কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারিনি। আমরা যদি আরো সমর্থন দিতাম, অন্যান্য খাত থেকে সহযোগিতা পেতাম, তাহলে হয়তো বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ভালো অবস্থানে থাকতাম।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: স্বাধীনতার পরে বীমা অন্যান্য খাতের সাথে তালমিলিয়ে এগোতে পারেনি। এর কারণ কী?

শেখ কবির হোসেন: আপনারা জানেন বিশ্বব্যাংক প্রকল্প (বিইএসডিপি) আমাদের ইন্স্যুরেন্স সেক্টরের উন্নয়নে কাজ করছে। এখানে কাজ করতে গিয়ে তারা একটি বিষয় চিহ্নিত করেছে- আমাদের দেশে যে পরিমাণ সম্পদ ও জীবন বীমার আওতায় আসার কথা ছিল তা হয়নি। মার্কিন ডলারে এই প্রোটেকশন গ্যাপ আমাদের মোট জিডিপির ৭ গুণ। বর্তমানে ২০২০ সালে সর্বশেষ জিডিপি ৩২৪.২ বিলিয়ন বা ৩২ হাজার ৪২০ কোটি ডলার হিসেবে বীমার আওতার বাইরে থাকা সম্পদের পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার বা ২,২৬৯.৪ বিলিয়ন ডলার। ডলারের মান ৮০ ধারা ধরলে টাকার অংকে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৮১ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শুধু নন-লাইফের ক্ষেত্রে এই প্রোটেকশন গ্যাপের পরিমাণ ৮ বিলিয়ন বা ৮’শ কোটি ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ নন-লাইফে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ বীমার বাইরে রয়েছে।

আমাদের দেশে অতিসম্প্রতি বড় বড় মেগা প্রজেক্ট যেমন, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এগুলো বীমার আওতায় আসছে। কিন্তু পাঁচ বা সাত বছর আগেও কিন্তু এগুলো বীমার আওতায় ছিলো না। যেমন: যমুনা সেতু যখন হয়েছে তখন বীমার আওতায় ছিলো না। কিন্তু এই পদ্মা সেতুর বীমা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকায়। তার মানে পদ্মা সেতু নির্মাণকালে যদি কোনো কারণে ধ্বংস হয় তাহলে ৩০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে, যেটা দিয়ে আবার সেতু নির্মাণ করা যাবে। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এগুলোকে বীমার আওতায় এনেছেন। ‘জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪’ তে বলা হয়েছে, ‘এদেশের সকল মানুষের বীমা হবে, সকল সম্পদের বীমা হবে।’ এটার বাস্তবায়ন দরকার এবং সেটা সরকারি সম্পদের বীমা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।

নগর-বিভাগসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি যে সম্পদগুলো রয়েছে সেগুলো বীমার আওতায় আসতে পারে। বড় বড় মার্কেট রয়েছে বীমা ছাড়া। বনানীতে কিছুদিন আগে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, বীমা ছিলো না। বসুন্ধরা মার্কেটে বীমা ছিলো না। সরকার জাতীয় বীমা নীতিতে এ কথাই বলেছে যে সকল সম্পদের বীমা করতে হবে।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীমার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে বীমা অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। জাতির পিতার মতো একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক যিনি বিশ্বের মধ্যে এক অনন্য গৌরবে ভাস্বর, বীমা খাতে তার অন্তর্ভুক্তি আমরা কতটুক কাজে লাগাতে পেরেছি?

শেখ কবির হোসেন: আপনি যথার্থই বলেছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ বীমা সেক্টরে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি বীমায় যোগদান করেছেন। সে সময় যেহেতু তাঁর জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল তাই বীমায় যোগ দিয়ে তিনি গোপনে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। আমরা আসলেই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। জাতির পিতার মতো একজন মহানায়ক বীমায় ছিলেন এটাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারতাম, তাহলে আমরা বীমাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নিজেকে বীমা পরিবারের একজন সদস্য দাবী করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে অবসরের পর বীমায় যেন তার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা থাকে। আমরা বীমার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই আবেগ ও ভালোবাসাকেও কাজে লাগাতে পারছি না।

এই প্রসঙ্গে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই- ভারতে একজন্য প্রখ্যাত কার্ডিওলোজিস্ট ডা. দেবী শেঠিকে আমরা অনেকেই চিনি। তিনি তার এলাকার দরিদ্র লোকদের চিকিৎসার সময় বলতেন- তোমরা যদি সমিতির মাধ্যমে স্বাস্থ্যবীমা করো, তাহলে আমি তোমাদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেবো। তার মতো একজন মানুষ দরিদ্র মানুষদের উৎসাহ দিয়েছেন যেন তারা বীমা করে। ডা. দেবী শেঠির মতো এমন দৃষ্টান্ত যদি আমরা উপস্থাপন করতে পারতাম তাহলে আমাদের বীমা সেক্টর অনেকদূর এগিয়ে যেতো। ইউনিসেফসহ অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠানের যেমন অ্যাম্বাসেডর আছে, তেমনি আমাদের বীমারও অ্যাম্বাসেডরের কথা বিভিন্ন সময় সেমিনারে লেখনিতে এসেছে। জাতীয় পর্যায়ে শ্রদ্ধেয়, যার গ্রহণযোগ্যতা সমাজের সর্বস্তরে রয়েছে, এমন কাউকে বীমায় অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করানো যেতে পারে।

ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নিয়ে ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার কতটুক অর্জিত হয়েছে? এবং বীমা খাতের উন্নয়নে আপনার সংগঠন কী কী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে?

শেখ কবির হোসেন: মূলত বীমা খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণে ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল। বীমা খাতের স্টেকহোল্ডার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে আইন ও নীতিমালা গঠনে আমরা সরকারকে সহযোগিতার করেছি এবং আমাদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছি। আমরা বিভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনার আয়োজন করে থাকি বীমার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে। জাতির পিতার স্মৃতি বিজড়িত এই খাতটিকে ঘিরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনেক স্বপ্ন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া বীমার প্রচার ও প্রসারে আমরা পত্রিকায় জনসচেতনামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে সভা সেমিনার আয়োজন করেছি। এছাড়া আমাদের আরো নানা ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে দিকে থেকে আমরা মোটামুটি অনেকখানিই সফল বলা যায়।

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১:০০ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।