| বৃহস্পতিবার, ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 1766 বার পঠিত
কম দামের হেলমেট খুঁজছিলেন মোখলেসুর রহমান। হেলমেট না থাকায় পুলিশ তাকে ৪০০ টাকা জরিমানা করেছে। এজন্যই বংশালের এক দোকানে হেলমেট কিনতে ছুটেছেন পেশায় মোটরসাইকেল চালক মোখলেসুর। তার মতো পেশাদাররা তো বটেই, অন্য যারাই মোটরসাইকেল চালান, গত কয়েক মাসে তারাও হেলমেট ব্যবহার শুরু করেছেন পুলিশের মামলা থেকে বাঁচতে। এতে করে মোটরবাইকের জরুরি এ অনুষঙ্গটির বিক্রি ও আমদানি দুটোই বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজধানীসহ কয়েকটি শহরে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিংয়ের প্রচলন বেড়েছে। অ্যাপভিত্তিক এসব সেবায় নগরবাসীর নির্ভরতার পাশাপাশি বেড়েছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্বিগুণ হয়েছে হেলমেট আমদানি।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে বন্দরে হেলমেট আমদানি হয় ৩৯৩ টন। পরের বছর পণ্যটি আমদানির পরিমাণ বেড়ে হয় ৫৯৯ টন। আর চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসেই হেলমেট আমদানি হয়েছে ৭১৪ টন। এ হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হেলমেট আমদানি দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশে হেলমেট আমদানি হয় প্রধানত ভারত, থাইল্যান্ড ও চীন থেকে। এর বাইরে স্থানীয়ভাবে কম দামের কিছু হেলমেট তৈরি হয়, যা ক্যাপ হিসেবে বেশি পরিচিত। থাইল্যান্ড ও চীন থেকে আমদানি করা হেলমেট চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে দেশে আসে। আর ভারতের হেলমেট আসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে।
এনবিআরের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে সেফটি হেডগিয়ার বা হেলমেটজাতীয় পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয় ৭ কোটি ২২ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬০৬ কোটি টাকা। এর বিপরীত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হেলমেট আমদানি হয়েছে ১৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের বা দেড় হাজার কোটি টাকার। অর্থাৎ এক বছরে হেলমেট আমদানির ব্যয় বাড়ে ১৪৬ শতাংশ।
আমদানিকারক ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা পাঠাও ও উবারের জনপ্রিয়তা মোটরসাইকেল ও হেলমেটের বিক্রি বাড়িয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর হেলমেট ব্যবহারে সচেতনতা ও নজরদারি বেড়েছে। চালকের পাশাপাশি আরোহীরাও হেলমেট ব্যবহারে বাধ্য হওয়ায় পণ্যটির বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে।
২০১৬ সালে রাজধানীতে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং চালু করে পাঠাও। সড়কে যানজটের কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় স্থানীয় এ স্টার্টআপ। এরই মধ্যে পাঠাও নিবন্ধিত রাইডার সংখ্যা দেড় লাখ ছুঁয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির বিপণন ব্যবস্থাপক নাবিলা নূর। তিনি বলেন, পাঠাও অ্যাপসে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতেই রাইড শেষে হেলমেট দেয়া হয়েছে কিনা সেটা রাইড গ্রহীতার কাছে জানতে চাওয়া হয়। ৯৬ শতাংশ পাঠাও রাইডার ও আরোহী হেলমেট ব্যবহার করে বলে যাত্রীদের ফিডব্যাক থেকে জানা যায়। এ হিসাবে বর্তমানে দেড় লাখ পাঠাও রাইডারের মাধ্যমে তিন লাখ হেলমেট নিয়মিত ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে উবার, সহজ রাইডসসহ অন্যান্য রাইডার ও সেবাগ্রহীতারাও হেলমেট ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ২৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ছয় লাখ মোটরসাইকেল। মোটরযান নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডারের হিসাব বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে ৩২ হাজার ৫৬২ মোটরসাইকেল। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক ২৭১টি নতুন মোটরসাইকেল রাজধানীর পথে নেমেছে। একই সময়ে সারা দেশে নিবন্ধন পেয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৬৯৪টি মোটরসাইকেল। এ হিসাবে প্রতিদিন পথে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৫৫টি। জুলাই-আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পর মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের হেলমেট এড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে আগামী বছর মোটরসাইকেল বিক্রি বৃদ্ধির আশা করছেন বাহনটি আমদানি, বিক্রি ও প্রস্তুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে হেলমেটেরও বাজার বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
কয়েক বছর ধরে চীন ও ভারত থেকে হেলমেট আমদানি করছে ইউহি ইন্টারন্যাশনাল। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি হাফ ফেস ও ফুল ফেসের ৪০ হাজার হেলমেট আমদানি করে। আর চলতি বছর শেষের আগেই তাদের হেলমেট আমদানি ৮০ হাজার ছুঁয়েছে। এ হিসাবে দুই বছরের মাথায় হেলমেট আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং পুলিশের শক্ত অবস্থানের কারণে হেলমেটের চাহিদা বেড়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে হেলমেটের বড় বাজার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মোটরসাইকেলের সঙ্গে হেলমেটের বিক্রি জড়িত। তবে এক্ষেত্রে চালক-আরোহীর নিরাপত্তায় গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয়ভাবে নিম্নমানের হেলমেট তৈরি ও বিক্রি বন্ধের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।
দেশে হেলমেটের সবচেয়ে বড় বাজার বংশালের মুকিম বাজারে ভারতের ভেগা, স্টিলবার্ড, জাজ, স্ট্যাটের পাশাপাশি চীনের এসবিকে, ইয়ামাহা, আইবিকে, এইচএক্স ব্র্যান্ডের হেলমেট পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, চলতি বছর কেবল বংশালেই প্রতিদিন খুচরা-পাইকারি মিলিয়ে গড়ে ২০০ কার্টন হেলমেট বিক্রি হয়েছে। এর বাইরে দিনে আরো কমপক্ষে ১০০ কার্টন হেলমেট অন্যান্য মার্কেট থেকে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কার্টনে ৯ অথবা ১২টা হেলমেট থাকে বলে জানান তারা।
হেলমেট আমদানি করে দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরবরাহ করছে সিরাজ সাইকেল স্টোর। চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার হেলমেট আমদানি করেছে। বাজারে চাহিদার কথা ভেবে আমদানির বিকল্প হিসেবে দেশে হেলমেটের কারখানা গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিরাজ সাইকেল স্টোর।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এবং বাংলাদেশ শিল্প বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সদস্য মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মফস্বল থেকে শুরু করে রাজধানীজুড়ে প্রতিদিন মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে। কম দামের হেলমেট বেশিদিন টেকসই না হওয়ায় এবং অনেকে একাধিক হেলমেট ব্যবহার করায় পণ্যটির বাজার বড় হবে।
হেলমেট ব্যবহারের প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যতগুলো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তার ৮৮ শতাংশ ব্যক্তির মাথায় হেলমেট ছিল না। মাথায় হেলমেট থাকলে ৪০ শতাংশ মৃত্যু ঝুঁকি কমে যায়। এক্ষেত্রে ভালো মানের হেলমেট ব্যবহারে জোরারোপ করেন তিনি।
Posted ৪:২৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ জানুয়ারি ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed