বিবিএনিউজ.নেট | ০৪ মে ২০১৯ | ১২:৩৪ অপরাহ্ণ
ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে। এ খাতের এমন দুর্দশার মধ্যেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়া বেড়েছে সরকারের। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৬৭ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ মাসের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকারে ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই তথ্যে অবশ্য সরকারের ঋণ নেয়ার সার্বিক পরিসংখ্যান ইতিবাচক। গত ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৮৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা। গত ৩০ জুনে যার পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ২৫৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১০ মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নেয়া কমিয়েছে ৩ হাজার ৪৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিসংখ্যান বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ ও ট্রেজারি বিল খাতে। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী এ খাতে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। ১০ মাসের ব্যবধানে এর পরিমাণ ৩ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
এর আগে গত ডিসেম্বরে নির্বাচনকেন্দ্রিক আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ। শুধু নভেম্বরেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা। অথচ জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। যেখানে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ নেয়ার লক্ষমাত্রা আছে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে কোনো ঋণই নিতে হয়নি। বরং ওই অর্থবছরে আগের বাকি থাকা ১৮ হাজার ২৯ কোটি টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছিল সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সরকারের যে পরিমাণ ব্যয় বেড়ে গেছে সেই হারে আয় বাড়েনি। এতেই সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনা বেশ চাপে পড়েছে। যার ফলে ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক অনুদানও কমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, একদিকে বড় বড় শিল্পগ্রম্নপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিচ্ছে না, এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে গেছে। সামগ্রিক খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকই নগদ টাকার সংকটে রয়েছে। এতে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তহবিল কমে গেছে। বছরখানেক আগেও যেখানে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল সোয়া লাখ কোটি টাকা, সেটি এখন কমে নেমেছে ৭৫ হাজার কোটি টাকায়, যার বেশির ভাগই সরকারি কোষাগারে ট্রেজারি বিল ও বন্ড আকারে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্ট শেষে ব্যাংকগুলোর নূ্যনতম তারল্য সংরক্ষণের কথা ছিল প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু ব্যাংকগুলোর তারল্য রয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের কোষাগারেই বিল ও বন্ড আকারে রয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ফলে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার যে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হচ্ছে তার বেশির ভাগই ব্যাংকগুলোর হাতে নেই। অন্য দিকে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক বিনিয়োগের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ২৪ শতাংশ, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন ও ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক হলিডে থাকায় ১ জানুয়ারি ব্যাংক লেনদেন শুরু হয়। ওই দিন থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দিনেই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১৮ সালে সবের্শষ ব্যাংক লেনদেন হয় গত ২৭ ডিসেম্বর, সেই দিন পর্যন্ত সরকারের নিট ঋণ ছিল ৯২ হাজার ১০৫ কোটি টাকা।
সরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি গত ৫ বছরের মধ্যে সবির্নম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ওই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ০১ শতাংশ।
অন্যদিকে প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না সরকারের। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, চলতি অথর্বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ হাজার কোটি টাকা কম ছিল রাজস্ব আদায়। ডিসেম্বরের তথ্য আরও হতাশাজনক। জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ২৯ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর।
গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন নতুন ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সুশাসনের অভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকের সব পর্যায়ে আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাত নাজুক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সম্পদের বিপরীতে আয়, ইকুইটির বিপরীতে আয়, সম্পদের বিপরীতে নিট সুদ আয় ও সুদবহির্ভূত আয়, খেলাপি ঋণ এবং মূলধনের বিপরীতে শ্রেণিকৃত ঋণের সূচকে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। যদিও প্রতি বছর নতুন শাখা খোলা হচ্ছে। নতুন শাখার পাশাপাশি নতুন কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেতন বাড়াতে হচ্ছে। এসব কারণে প্রতি বছর ব্যয় বাড়ছে ব্যাংকের। কিন্তু ভালো ব্যবসা করতে না পারায় একদিকে প্রতিষ্ঠানের আয় কমছে, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি নীতির ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও আপস করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিত্যনতুন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৪ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৪ মে ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed