শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

অর্থনীতিতে ক্যান্সার

ড. ফাহমিদা খাতুন   |   বৃহস্পতিবার, ০৪ এপ্রিল ২০১৯   |   প্রিন্ট   |   633 বার পঠিত

অর্থনীতিতে ক্যান্সার

ব্যাংকিং খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত। এখানে পুঁজিবাজার, বন্ড ও ইক্যুইটি মার্কেট_ আর্থিক খাতের এসব অংশ তেমন শক্তিশালী নয়। সঙ্গত কারণেই ব্যাংকিং খাতের ওপর অর্থনীতির নির্ভরতা অনেক। যথার্থভাবেই বলা হয়, এ খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের প্রাধান্য শুরু হয়েছে। এ সময়ে কাঠামোগত সংস্কারও শুরু হয়। ব্যাংকিং খাতেও প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন কমিশন-কমিটির সুপারিশে ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করা হয় এবং এর ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হতে থাকে। এ ধরনের সংস্কারের জন্য বিদেশি দাতাদেরও চাপ ছিল।

আমাদের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। জাতীয় বাজেট, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা বাড়ছে। এখন ৫৭টি তফসিলি ও বিশেষায়িত ব্যাংক কাজ করছে এবং এগুলোর বেশিরভাগ বেসরকারি মালিকানাধীন, যাদের হাতে রয়েছে মোট আমানতের প্রায় ৭০ শতাংশ। কিন্তু সার্বিক বিচারে বলা যায়, ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ভালো নয়। নন-পারফর্মিং লোন বা কুঋণের পরিমাণ অনেক। সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে এ সমস্যা বেশি। বৃহস্পতিবার সমকালে ‘শীর্ষ খেলাপির বেশিরভাগই সরকারি ব্যাংকের :অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রধান কারণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপি একশ’ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির যে তালিকা প্রকাশ করেছেন, তার বিশ্লেষণ থেকেই মিলেছে এ তথ্য। এসব ব্যাংকে দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি রয়েছে। জবাবদিহির ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি-নজরদারি বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচিত। ব্যাংকের বোর্ডে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনায়_ এমন অভিযোগ রয়েছে। আমরা জানি, দেশে রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেক দক্ষ-যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের অনেকে এ মানদণ্ড পূরণ করেন না, অথচ ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তারা হস্তক্ষেপ করেন বলে অভিযোগ। বড় অঙ্কের ঋণ মঞ্জুরে তাদের ভূমিকা দৃশ্যমান। এ ধরনের ঋণে নীতিমালা মানা হয় না। প্রকল্পের উপযোগিতা, গ্রহীতার ঋণ সঠিকভাবে কাজে লাগানো, ঋণ ফেরত দানের রেকর্ড_ এসব তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্যান্য শীর্ষ পদে মনোনয়নেও তাদের পছন্দ-অপছন্দ থাকে।

ব্যাংকের অর্থ নিয়ে যারা ফেরত দেন না তারা প্রভাবশালী। সমাজে প্রভাবশালী আরও অনেকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকে। এর সঙ্গে ব্যাংকের বোর্ড ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্তদের সংযোগ ঘটলে ঋণ আদায় কার্যক্রম বিঘি্নত হওয়া স্বাভাবিক।

ব্যাংকিং খাতের তদারকি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতের তদারকিতে তাদের ভূমিকা রয়েছে এবং গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয়তা বেড়েছে। কিন্তু ওপর মহলের প্রভাব বিস্তারের কারণে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে না_ এমন অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার উদাহরণ টানতে পারি। লিকার ব্যারন হিসেবে পরিচিত বিজয় মালিহা ভারতে ব্যবসায়ী মহলে পরিচিত নাম। তার খেলাপি ঋণ ছিল ৯ হাজার কোটি রুপি। তিনি লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে তাকে ভারতের অনুরোধে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাহারা গোষ্ঠীর প্রধান সুব্রত রায়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর ছিল এ গোষ্ঠী। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ২৪ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের অভিযোগে দুই বছর যাবৎ তিনি জেলে রয়েছেন। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক এ ক্ষমতা প্রদর্শন করছে এবং সেখানকার সরকার তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও সেটা পারছে না। এখন পর্যন্ত বড় কোনো ঋণখেলাপির গুরুতর শাস্তি হয়েছে_ তেমন উদাহরণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে মামলা হয়, কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও নিষ্পত্তি হয় না, অর্থ উদ্ধার হয় না। প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের যোগাযোগের কারণেই এটা ঘটছে। আমাদের কুঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

অর্থমন্ত্রী সংসদে খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছেন। ঋণখেলাপিদের নিয়ে সমাজে যে উদ্বেগ, তার প্রেক্ষাপটে এটি ভালো পদক্ষেপ। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, তার তালিকা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী একটি ভালো কাজ করেছেন এবং এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পাবেন। তালিকাটি সংসদে উত্থাপনের সময় তিনি ছিলেন না। অর্থ প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন না। এ কারণে খাদ্যমন্ত্রী তা সংসদে পেশ করেন। বাংলাদেশে ঋণখেলাপি ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ কারণে খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে। তবে তালিকায় হলমার্ক গ্রুপ এবং আরও দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আলোচিত অন্যদের নাম অনুপস্থিত। তাদের নাম কি এতদিন ভুল করে আলোচনায় আনা হয়েছে? তারা কি বকেয়া ঋণ ফেরত দিয়েছেন? কিংবা তারা ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নিয়েছেন? এসব প্রশ্ন স্বাভাবিক। তালিকায় প্রকাশিত কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কারা রয়েছেন, কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে কত টাকা পাওনা, কতদিন ধরে পাওনা, ঋণ প্রথম কবে নেওয়া হয়েছে এবং তার কত অংশ এ পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হয়েছে_ এসব তথ্য নেই অর্থমন্ত্রীর তালিকায়।

আমরা জানি, বড় অঙ্কের ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠন করেছিল ব্যাংকগুলো। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থ এবং বকেয়া ঋণ আদায়ের সুবিধার্থে এ পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই। ২০১৫ সালের প্রথমদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ১১টি শিল্প গ্রুপের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। যাদের ঋণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি তারাই এ সুবিধার আওতায় আসে। কিন্তু কিস্তি পরিশোধের সময় এলে তাদের অনেকে পুনর্গঠন করা ঋণে আরও ছাড় চাইছেন। কেউ কেউ কোনো অর্থই পরিশোধ করেননি। কেউ কেউ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী এদের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেবেন, সেটা দেশবাসীর জানার অধিকার রয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি ব্যাংকের অর্থ সংকট কাটাতে জাতীয় বাজেট থেকে বর্তমান অর্থবছরে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হলে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আগেও এ ধরনের ভর্তুকি বাজেট থেকে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে কেন তার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে_ এ প্রশ্ন সঙ্গত।

এখন সময় এসেছে নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের। আমরা চাই, একটি স্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন, যাদের তদারকিতে গোটা ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রম থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং দেশি-বিদেশি সব ব্যাংক তাদের সুপারিশ যেন গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, সে ক্ষমতা তাদের থাকতে হবে। অর্থমন্ত্রী নিজে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের পক্ষে_ সেটা বিভিন্ন সময়ে বলেছেনও। এখন প্রয়োজন বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ।

বাংলাদেশে ব্যাংকের আমানত ৯ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রায় ৭০ শতাংশ এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পদ্ধতি নিয়েও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ব্যাংকটি ভালোভাবে চলছিল। এক ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ শেয়ারের মালিক হয়ে গেছেন_ এ ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। এটা কি আমরা পরিবর্তন বলব? যিনি বড় অংশের শেয়ারহোল্ডার, আবার তিনিই বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতা_ ব্যাংকে এমন ঘটনা ঘটলে সেটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয় না। অর্থনীতির জন্যও তার ফল শুভ হয় না। ব্যাংকিং আইনের একটি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন আছে। এত দিন বিধান ছিল, এক পরিবারে সর্বোচ্চ দু’জন সদস্য পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন। কিন্তু এর পরিবর্তন করে চারজন রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে, যারা পরপর তিন টার্মে ৯ বছর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আমরা জানি, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অর্থের সিংহভাগের জোগান আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে। ছোট-বড় অঙ্কের অর্থ তারা জমা রাখেন। উদ্যোক্তাদের অর্থের তুলনায় আমানতকারীদের জমা অর্থ অনেক অনেক বেশি। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে কেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেওয়া? এখন চলছে করপোরেট যুগ। কিন্তু সরকার কেন ব্যাংকিং খাতকে সাবেকি যুগে ফেরত নিতে সহায়তা করবে? আমাদের বেসরকারি ব্যাংকেও সুশাসনের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ। ব্যাংক পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে এ সমস্যা আরও প্রকট হবে।

ব্যাংকিং খাত এখন অশেষ সম্ভাবনাময়। তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বাড়াচ্ছে, কৃষি খাতে ঋণ বাড়াচ্ছে। বড় বড় অর্থনৈতিক উদ্যোগে তারা অর্থ জোগাতে সক্ষম। ব্যাংকগুলোতে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এ খাতের অবদান দৃশ্যমান। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এ ভূমিকা আরও বাড়বে। সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চয় এদিকটির প্রতি মনোযোগ বাড়াবেন। (সূত্র: সমকাল, ১৪ জুলাই ২০১৭)

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:৫০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ এপ্রিল ২০১৯

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।