শুক্রবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একের পর এক কেলেঙ্কারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে

আদম মালেক   |   মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি ২০২১   |   প্রিন্ট   |   563 বার পঠিত

একের পর এক কেলেঙ্কারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে

একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকবহিভর্‚ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে কোম্পানির শীর্ষ ব্যক্তিরা গড়ে তোলে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে কর্তাব্যক্তিরা ক্রয় করে নিজেদের গাড়ি-বাড়ি। চলে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর ও প্রমোদ ভ্রমণ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে অনেক ঋণ ভুল করে শীর্ষব্যক্তিদের হিসাবে গেছে বলে তারা দাবি করেন। আবার কারো কারো জালিয়াতের অর্থ উদার হস্তে কয়েকজন বান্ধবীর মাঝেও বিতরণের ঘটনা ঘটে। তাই ডুবতে বসেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে ডুবন্ত পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন পুনর্গঠনের পথ খুঁজছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রিমিয়ার লিজিং বাঁচাতে এসেছে প্রশাসক। দেশের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম। তার আগে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে প্রশান্ত কুমার হালদার। তার বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ইন্টারপোল।

সম্প্রতি উত্তরা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কয়েকজন পরিচালক নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সময়ে তিন হাজার ৪৪০ কোটি টাকা বের করে ব্যক্তিগত কাজে লাগিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে যে উত্তরা ফিন্যান্সের হাত ধরে উত্তরা মোটরসের যাত্রা সে উত্তরা মোটরসই প্রতিষ্ঠানটিকে খেয়ে ফেলার সব ক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। ইতোমধ্যে উত্তরা ফিন্যান্সের ৩৩৫ কোটি টাকা গিলে ফেলেছে উত্তরা মোটরস। হদিসবিহীন ৮৯০ কোটি টাকা। কোম্পানির স্থিতিপত্রে অগ্রিম ও প্রিপেমেন্ট খাতে ৯০ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং শেয়ারে বিনিয়োগ খাতে ২২১ কোটি আট লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। অথচ বিস্তারিত হিসাব যাচাই করে পরিদর্শকরা উদঘাটন করেছেন, এ দুই খাতে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার ২০১ কোটি ২০ লাখ টাকা। যার সবই গেছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হিসাবে। এর বাইরেও বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে পড়েছে কোম্পানিটি। এফডিআরও ভেঙে খরচ করছে কোম্পানিটি। ২০১৮ সালে কোম্পানিটির এফডিআর কমেছে ২৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধি আরো মারাত্মক হারে হ্রাস পেয়েছে। এ সময় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৯৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে এফডিআরের পরিমাণ ছিল ২০৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। পরের বছর এফডিআর কমে ১১০ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। কোম্পানি এফডিআর ভেঙে কি কাজে ব্যবহার করেছে তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে উত্তরা ফিন্যান্স থেকে এক হাজার ৫শ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে এমডি ও পরিচালকরা। এদিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে গেল বছরের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দিলো প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে।

২০১৯ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ কমে এক হাজার ৬৯৮ কোটি টাকায় নেমেছে। ২০১৭ সালে যা এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ছিল। আমানতের ক্ষেত্রেও পতনমুখী প্রবাহ। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির আমানত ছিল ৯৬৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৫৩ কোটি হ্রাস পেয়ে তা ৮১৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ আমানতের ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক। যার বেশিরভাগই ফেরত দিতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। ঋণ বিতরণেও প্রতিষ্ঠানটির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। চার বছরে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৬৫ কোটি টাকা।
প্রিমিয়ার লিজিংয়ের চেয়ে মারাত্মক সংকটাপন্ন অবস্থায় পতিত হয় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। এজন্য ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পিপল্স লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। হাইকোর্টের অনুমতিও নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে অবসায়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কোম্পানিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু আমানতকারীরা আজও তাদের অর্থ ফেরত পায়নি।

১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে। এছাড়া গুলশান ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা রয়েছে। পিপলস লিজিংয়ে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। আর ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ আছে এই কোম্পানির শেয়ারের।

তাছাড়া চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে প্রশান্ত কুমার হালদার। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। চারটি প্রতিষ্ঠান দখলে নিলেও কোনো প্রতিষ্ঠানেই পি কে হালদারের নিজের নামে শেয়ার নেই।

প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিষ্ঠান দখল ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে। অনেক ক্ষেত্রে সমর্থনও পেয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে। এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা গেছে তার ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার, তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা ও মা লীলাবতীর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। তাছাড়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর বান্ধবীদের অ্যাকাউন্টে টাকা গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এ কথা বলেছেন।

খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠানে অর্থ রেখে অনেকে হয়রানি ও ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। ভুক্তভোগীরা আমার চেম্বারে এসে দেখা করে কথা বলেছেন। পি কে হালদারের অনেক বান্ধবী থাকা ও তাঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা রাখার তথ্য মূলত ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। তাদের সংখ্যা ৭০/৮০ বলে জানান তিনি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের হলে তিনি ফোন ধরেননি। এ কারণে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৫:১১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রডের দাম বাড়ছে
(11186 বার পঠিত)

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।