বিবিএনিউজ.নেট | বৃহস্পতিবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট | 438 বার পঠিত
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে। দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন পার্টির নেতাকর্মীরাও। শীর্ষ নেতারা এ ব্যাপারে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত কে হবেন বিরোধীদলীয় নেতা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী জানিয়েছেন, বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার আশঙ্কা, পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। সামাল দিতে না পারলে পার্টির সাংগঠনিক শক্তি তথা অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বর্তমান জাপাপ্রধান জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে গত মঙ্গলবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেন কয়েকজন দলীয় সংসদ সদস্য। প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের নেতৃত্বে তারা স্পিকারের দপ্তরে গিয়ে চিঠিটা পৌঁছে দেন। চিঠিতে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ঘটনার পর জাপায় তোলপাড় শুরু হয়। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনের দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে কাড়াকাড়ির মধ্যেই আলোচনা সমালোচনা দেখা দেয়। রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা ছুটে যান তার বাসভবনে। তারা যেকোনোভাবে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে উঠেপড়ে লেগে যান। ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই গতকাল বুধবার রওশন এরশাদ নিজেই নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বাসানোর জন্য চিঠি লেখেন স্পিকারকে। দলীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু চিঠিটি নিয়ে বিকেলেই পৌঁছে দেন স্পিকারের কাছে। তবে এ ব্যাপারে কেউই মুখ খুলতে চাননি।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন রওশন এরশাদ। স্পিকারকে দেয়া চিঠি সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের জানাবেন। তবে শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেবেন তার সমর্থকরা। এতে তার বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার সমস্ত বাধা দূর হবে।
এর আগে গত ১৮ আগস্ট জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে এরশাদের চেহলাম প্রস্তুতি উপলক্ষে প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথসভায় জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন হাফডজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। যুক্তি তুলে ধরে তারা বলেছিলেন, জি এম কাদের ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিত্ব। তৃণমূলে তার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। সব শ্রেণির নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগও ভালো। তাই দলের গতিধারা অব্যাহত রাখতেই তাকে বিরোধীদলীয় নেতা হতে হবে। সভায় মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা জি এম কাদেরের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্ধারণ করা হবে।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি-বিধি অনুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নিয়োগ দেন স্পিকার। আর বিরোধীদলীয় নেতা মন্ত্রী ও উপনেতা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেন। বিগত দশম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন রওশন এরশাদ। জাপা চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়েছিলেন পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদার প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূত। চলতি একাদশ সংসদেও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশনকে দেখতে চান তার সমর্থকরা। তবে জি এম কাদের পার্টিপ্রধান হওয়ায় এ নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দেয়। পদটি নিয়ে ভাবি-দেবরের চাপা বিরোধ দেখা দেয়।
জানতে চাইলে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, এ ব্যাপারে আমার কিছুই বলার নেই। কোনো মন্তব্য করতেও চাই না। তবে রওশনপন্থী এক প্রেসিডিয়াম সদস্য পরিস্থিতির জন্য জি এম কাদেরের দিকে আঙুল তুলে বলেন, তিনি দেবর-ভাবির সুসম্পর্ক নিয়ে নেতাকর্মীদের ভুল তথ্য দিয়েছেন। ভাবির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারেও মোটেই তৎপর ছিলেন না। নেতাকর্মীদের সেটা বুঝতেও দিতেন না। এ কারণে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ভাবি-দেবরের মধ্যে প্রবল বিরোধের প্রকাশ্য রূপ নেয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার সময় এরশাদের পক্ষে ছিলেন জি এম কাদের। আর স্বামী-দেববের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোটে অংশ নিয়ে বিএনপিবিহীন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন রওশন এরশাদ। এর মধ্যে ভোটের পুরোটা সময় সিএমএইচে কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছিলেন এরশাদ। শেষ অবধি সব হারিয়ে পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছিলেন জি এম কাদের। তবে এরশাদ দুবছরের মাথায় পার্টিতে কো-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে জি এম কাদেরকে সেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এতে রওশনপন্থিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে সেই ক্ষোভ সামাল দিতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করে স্ত্রী রওশনকে ভাইয়ের ওপরে স্থান দিতে বাধ্য হন এরশাদ।
তবে এরশাদের মৃত্যুর পর পার্টির সম্ভাব্য ভাঙন ঠেকাতে দেবর-ভাবির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন কয়েকজন নেতা। শেষ অবধি রওশন এরশাদ দেবর জি এম কাদেরকে সন্তানতুল্য হিসেবে উল্লেখও করেন। তবে পদ আর দলীয় আধিপত্যের কারণে তাদের স্নায়ুযুদ্ধের অবসান যে লোক দেখানো তার প্রমাণ আবার দেখা গেল বিরোধীদলীয় নেতা পদ নিয়ে কাড়াকাড়িতে।
দেবর-ভাবির বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়াস চালানো নেতা জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ বলেন, আমরা এমনটা আশা করিনি। তবে সংবাদ সম্মেলনে রওশন কী বলেন সেটার উপরেই নির্ভর করছে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে।
বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি- স্পিকার : দুপক্ষ পাল্টাপাল্টি চিঠি দিলেও বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান তিনি। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় এ মন্তব্য করেন স্পিকার।
জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার সাংবাদিকদের বলেন, আমি মালদ্বীপে স্পিকারস সামিট থেকে সবে ফিরলাম। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দুটি চিঠি পাঠানোর কথা শুনেছি। তবে বিরোধীদলীয় নেতা করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। চিঠি দেখে বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার বিকেলে নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা করার দলীয় সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে স্পিকারকে চিঠি দেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দলীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদসহ পাঁচ সংসদ সদস্য ওই চিঠি স্পিকারের দপ্তরে পৌঁছে দেন। এদিকে ওই চিঠি গ্রহণ না করার অনুরোধ জানিয়ে স্পিকারকে গতকাল বুধবার বিকেলে পাল্টা চিঠি দেন রওশন এরশাদ। রওশন এরশাদের চিঠিটি স্পিকারের হাতে পৌঁছে দেন দলীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু। ওই চিঠিতে স্পিকারের কাছে জি এম কাদেরের চিঠি দেয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
স্পিকারকে চিঠি লেখার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এর আগে স্পিকারকে একতরফাভাবে চিঠি লেখা হয়েছে। কারণ বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, সে বিষয়ে দলের সংসদ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাব করে স্পিকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সে বিষয়ে আপত্তির কথা স্পিকারকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। চিঠির বিষয়বস্তু আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানানো হবে।
উল্লেখ্য, গত ১৪ জুলাই জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুতে বিরোধীদলীয় নেতার পদ শূন্য হয়। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা মন্ত্রী এবং উপনেতা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পান। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি-বিধি অনুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নিয়োগ দেন স্পিকার।
Posted ১:১৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed