নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 542 বার পঠিত
একটি কোম্পানির সর্বোচ্চ পদ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। মূলত সিইও কোম্পানির যাবতীয় কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। বীমা কোম্পানিতে এ পদের গুরুত্ব আরো বেশি। এক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০-এ কোনো বীমা কোম্পানিতে সিইও পদ একাধারে তিন মাসের অধিক খালি না রাখার বিষয়ে নির্দেশ আছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন নিয়ে তা ছয় মাস বর্ধিত করার সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর সিইও নিয়োগ দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো। ফলে ভারপ্রাপ্তের ভারে (!) অস্থির বীমাখাত। চলতি দায়িত্ব (সিসি) বা ভারপ্রাপ্ত সিইওর দায়িত্ব পালনে তেমন কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় তাদের দ্বারাই আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বারবার। এই সমস্যা সমাধানে এবার সক্রিয় ভূমিকা নেয়ার কথা ভাবছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এমনটাই জানা গেছে আইডিআরএ সূত্রে।
সূত্র জানায়, গত ৬ সেপ্টেম্বর জীবন বীমা খাতের ৬ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় আইডিআরএ। দীর্ঘদিন থেকে কেন সিইও পদ শূন্য রয়েছে এর কারণ জানাতে এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে সিইও নিয়োগ দিতে চিঠিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। অন্যথায় বীমা আইন ২০১০-এর ৮০ ধারার ৫ উপধারার আলোকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে আইডিআরএর নতুন এ নির্দেশকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বীমাসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে অস্থিরতা চলছে, এ নির্দেশের ফলে তা অনেকাংশেই লাঘব হবে। কেননা যারাই সিইওর চলতি দায়িত্বে রয়েছেন, পদের স্থায়িত্ব না থাকায় তারা পরিকল্পনার আলোকে কাজ করতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব ও পদ স্থির থাকলে তারা সুপরিকল্পিতভাবে কাজ এগিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি সিইও নিয়োগের শর্তে কিছুটা শিথিলতা আনার জন্যও তারা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শীর্ষস্থানীয় এক বীমা কোম্পানির মুখ্য কর্মকর্তা জানান, এমনিতেই আমাদের বীমাখাতের ওপর সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তাছাড়া এখনকার প্রেক্ষাপটে বীমা পেশায় সম্মান ও সম্মানী কাক্সিক্ষত না হওয়ায় এর প্রতি শিক্ষিত তরুণদের তেমন আগ্রহ নেই। ফলে লোকবল সংকট থাকছে। উপরন্তু মুখ্য নির্বাহী হতে বীমা আইনে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট শ্রেণির বীমায় ১৫ বছর এবং সিইও অব্যবহিত পদে ন্যূনতম ৩ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিকূলতার কারণে বীমাখাতে স্থায়ী ক্যারিয়ার তৈরিতে শিক্ষিত সমাজের আগ্রহ নেই। ফলে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত অনেকেই পূরণ করতে পারছে না। যে কারণে সিইওর চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের দিয়েই প্রতিষ্ঠান চলছে বছরের পর বছর। এমন প্রেক্ষাপটে সিইও নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২ এর ৩ ধারার (ঘ) এবং (ঙ) অনুচ্ছেদে বিশেষ ডিগ্রিধারীদের জন্য ৫ বছর ও ৩ বছর পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। তেমনিভাবে সিইওর অব্যবহিত পদে অন্যূন তিন বছর শর্তের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রেও যদি ব্যক্তির পূর্বের পারফরমেন্সকে বিবেচনায় এনে এ শর্ত কিছুটা শিথিল করা হয়, তবে বীমাখাতের জন্যই তা মঙ্গল হবে।
চিঠিপ্রাপ্ত কয়েকটি কোম্পানির সাথে কথা বললে তারা জানান, সিইও নিয়োগের বিষয়ে তাদের আগেই চিঠি দেয়া আছে আইডিআরএতে। এরপরও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ থেকে নতুন যে চিঠি পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে বোর্ডমিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সে সিদ্ধান্তের পরই এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে।
কথা হয়, চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্ব পালন করা এসএম জিয়াউল হকের সাথে। তিনি বলেন, কোম্পানির সর্বশেষ বোর্ডমিটিং গত ২৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমাকে এমডি হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এখন চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের পর তা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য। তবে সিইও পদের অব্যবহিত নিচের পদে দায়িত্ব পালনে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে বলেন, শর্তপূরণ না হলেও পারফরমেন্সের ভিত্তিতে কনসিডার পেতে পারি বলে জানিয়েছে আইডিআরএ। উল্লেখ্য, চার্টার্ড লাইফ ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই সিইও পদ শূন্য রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল সিইও হিসেবে কামরুল হাসান যোগদান করার কিছুদিন পর পদত্যাগ করেন।
গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে সিইও’র চলিত দায়িত্বে রয়েছেন মো. আমজাদ হোসেন। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি সাবেক সিইও নূর মোহাম্মদ ভূঁইয়া পদত্যাগ করলে তিনি চলতি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আমরা গত ৯ সেপ্টেম্বর সিইও অনুমোদনের জন্য আইডিআরএকে চিঠি দিয়েছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ বিষয়ে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কেননা, প্রকৃতপক্ষেই সিসি দায়িত্ব পালনকালে কোম্পানিতে সঠিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া যায় না।
আলফা লাইফে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ মার্কেটিং অফিসার নূরে আলম সিদ্দিকী অভি। তিনি জানান, আইডিআরএ থেকে গত ৮ সেপ্টেম্বর আমরা চিঠি পেয়েছি। ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমরা এর জবাব দেবো। আর সিইও নিয়োগে ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে আমরা কমপ্লায়েন্স ঠিক করবো।
এ বিষয়ে যমুনা লাইফে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করা কামরুল হাসান খন্দকার জানান, আমরা ৬ সেপ্টেম্বর চিঠি পেয়েছি। এর জবাব দিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ মাসের যে কোনো সময় বোর্ডমিটিং ডাকা হবে বলে আশা করছি। আমাদের বোর্ড জানিয়েছে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সিইও নিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ট্রাস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও (চলতি দায়িত্ব) গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমরা ইতোমধ্যে চিঠির উত্তর দিয়েছি। আর তিন মাসের মধ্যে সিইও নিয়োগের যে বিষয় রয়েছে, সে বিষয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে অনেক বীমা কোম্পানি বহু আগেই সিইও নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আইডিআরএর কাছে চিঠি দিয়ে রেখেছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিইওর শর্তপূরণ না হওয়া সাড়া দেয়নি সংস্থাটি। সেসব কোম্পানির বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হবে, নতুন এ নির্দেশে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাছাড়া এ ৬টি বাদে জীবন বীমায় যে ১০টি কোম্পানিতে সিইও নেই তাদের বিষয়ে কি হবে তাও জানায়নি সংস্থাটি। এগুলো হলো- বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, স্বদেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং আস্থা লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
আবার তিন মাসের সময়সীমা দেয়া হলেও এ সময়ের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগ যে সম্ভব না, তেমনই আভাস মিলেছে কর্তৃপক্ষের বরাতে। এক্ষেত্রে বাধা হয়েছে খোদ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন। বর্তমানে সংস্থায় মাত্র দু’জন সদস্য রয়েছে। অথচ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০ ধারা ১৩-এর ৪ উপধারার আলোকে কোরাম পূর্ণ হতে তিনজন সদস্যের কথা বলা হয়েছে। আর কোরামপূর্ণ না হলে কোনো বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টিও অমীমাংসিত থেকে যাবে।
একদিকে আইনি বাধা, অন্যদিকে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাব। এই যখন বীমাখাতের অবস্থা, সে মুহূর্তে সিইও নিয়োগশর্তে কিছুটা শিথিলতা আনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বীমা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বর্তমান প্রজন্মের বয়সভিত্তিক শর্তে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় তারা এগিয়ে রয়েছে। তাই সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে তাদের দায়িত্বে আনা প্রয়োজন। তবে সেটা তখনই সম্ভব, যখন সিইও নিয়োগশর্তে কিছুটা নমনীয় হবে আইডিআরএর প্রবিধান। বীমাখাতের উন্নয়নে প্রয়োজন হলে প্রবিধানেও সংশোধন আনা জরুরি।
Posted ১:২৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed