নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট | 103 বার পঠিত
বৈশ্বিক করোনার হিংস্র থাবায় বাংলাদেশসহ অনেক দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই আবার চেপে বসেছে ‘রুশ-ইউক্রেন’ যুদ্ধ। এর বিরুপ প্রভাবে পড়েছে বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। চলমান এই যুদ্ধ বন্ধ না হলে আগামীতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন খাদ্য বিজ্ঞানিরা। তাদের মতে,পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যাচ্ছে পর্যাপ্ত টাকা নিয়ে বাজারে গিয়েও প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
খাদ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি)’ সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই শঙ্কা প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে ৫২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্য ঝুঁকিতে থাকবে ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়াবে ৪০ কোটি ৬২ লাখ। তবে একই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যার কারণে এই চূড়ান্ত পর্যায়ে দাঁড়াবে ৫৯ কোটি ৩৩ লাখ। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে ৬৯ লাখ মানুষ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে ৮৭ লাখে।
তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ, বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে সাপ্লাই সাইড ইফেক্ট। চলতি মৌসুমে বিশ্বব্যাপী খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনের হার অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উৎপাদিত খাদ্য দ্রব্যে সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন মিলিতভাবে মোট বিশ্ব গমের চাহিদার ৩০ শতাংশ যোগান দিয়ে থাকে। চলতি বছর ইউক্রেনে মোট ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্য দ্রব্য উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশই খাদ্যদ্রব্য যুদ্ধের কারণে কৃষকগণ ঘরে তুলতে পারেনি। এছাড়া উৎপাদিত খাদ্য পণ্য বন্দরে জাহাজ বোঝাই করে রাখা হলেও যুদ্ধের কারণে তা বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। গত ২৪ জুলাই তুরস্কের মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানির লক্ষ্যে ১২০ দিনের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি স্বাক্ষনের পর ইউক্রেনীয় পণ্যবাহি জাহাজগুলো বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে বন্দর ত্যাগ করেছে। এতে বিশ্ববাজারে খাদ্য দ্রব্যে মূল্য কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে। তবে যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের কৃষক এবং কৃষি ফার্মের মালিকগণ তাদের জমিতে ফসল বপন করতে পারছেন না। ফলে আগামী মৌসুমে ওই দেশটির খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন অনেক কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতি, বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়া জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের যোগান কমিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব জ্বালানি তেলের এক দশমাংশ যোগান দেয় রাশিয়া। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গ্যাসের একটি বড় যোগানদাতা হচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের যোগান কমিয়ে দিয়েছে অথবা বন্ধ করেছে। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর বিশ্বব্যাপী যে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির পেছনে রয়েছে পরিবহন সঙ্কট। কিন্তু আগামী মৌসুমে পরিবহন সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন স্বল্পতা সঙ্কটও যুক্ত হবে। গত মার্চ থেকে জুনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন লেবাননে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৩৩২ শতাংশ। অর্থাৎ চার মাস আগে ওই দেশটিতে ১০০টাকার খাদ্যদ্রব্যের ক্রয় করতে ৩৩২ টাকা লাগছে।
এদিকে জিম্বাবুয়ে বর্ণিত সময়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ২৫৫ শতাংশ। ভেনিজুয়েলায় ১৫৫ শতাংশ, তুরস্কে ৯৪ শতাংশ, ইরানে ৮৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৮০ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬৬ শতাংশ। এই বিপুল খাদ্য মূল্যস্ফীতির জন্য মূলত পরিবহন সঙ্কটই দায়ি। কিন্তু আগামী মৌসুমে এর সঙ্গে উৎপাদন হ্রাস জনিত সঙ্কট যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যারা সামান্যতম খাদ্য পণ্য উৎপাদন করতে পারে না। যেমন মরুভূমির দেশগুলোতে কোনো খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন হয় না। কোনো কোনো দেশে সামান্য পরিমাণ খাদ্য পণ্য উৎপাদিত হলেও তা দিয়ে দেশের সার্বিক চাহিদা পূরণ হয় না। খাদ্য দ্রব্যের সঙ্কট আরও ব্যাপক হতে পারে। যেমন ২০০৭-২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা। সেই সময় বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিল সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে খাদ্য ক্রয় করতে পারছিল না।
২০১৮ সালে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্য সূচক ছিল ৯৫ দশমিক ৮। ২০১৯,২০২০এবং ২০২১ এই তিন বছরে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্য সূচক ছিল যথাক্রমে ৯৫ দশমিক ১, ৯৮ দশমিক ১ এবং ১৪৯ দশমিক ৭। আগেই বলা হয়েছে, বিশ্ব গমের চাহিদার ৩০ শতাংশ যোগান দেয় রাশিয়া এবং ইউক্রেন। ভুট্টার ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় এই দু’টি দেশে। বৃটেনে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানে ১০ দশমিক এক শতাংশ। আগামী অক্টোবর মাসে তা ১৩ শতাংশে এবং আগামী জানুয়ারি মাসে তা ১৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এতে বৃটেনের ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ জ্বালানি দারিদ্র্যে পতিত হতে পারে। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ৩০ আগস্ট, ২০২১ তারিখে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড তেলের মূল্য ছিল ৬৯দশমিক ২১ মার্কিন ডলার। গত মার্চে তা ১২৩ দশমিক ৭০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। গত ২৩ আগষ্ট তা ৯১ দশমিক ৮৬ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু আবারো যে কোনো সময় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়তে শুরু করতে পারে। বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি ক্রমশ বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালি এবং স্থিতিশীল অর্থনীতিতেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশটির মূল্যস্ফীতির গড় হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ,যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। জার্মানিকে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। জার্মানি রাশিয়ান জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। মেক্সিকোতে মূল্যস্ফীতির হার হচ্ছে ৮দশমিক ১৫ শতাংশ,নেদারল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৩শতাংশ। আর্জেন্টিনা এবং তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার হচ্ছে ৭১ শতাংশ ও ৭৯দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কিছু দিন আগে জ্বালানি তেলের মূল্য লিটারপ্রতি ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বাজারে প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০৩০সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষ ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে। একই সময়ে বৈশ্বিক খাদ্য ঝুঁকিতে থাকবে ৫২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। করোনা শুরু হবার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। করোনাকালীন অবস্থায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের গবেষণা মতে, দেশে করোনার কারণে অন্তত ৩ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে।
এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে সরু চালের মূল্য ৬২-৭০ টাকা থেকে ৬৫-৮০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। মাঝারি মানের চালের মূল্য ৫২-৫৬ টাকা থেকে ৫৫-৬০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। মোটা চাল ৪৬-৫০ থেকে ৫৫-৫৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্যাকেটজাত ময়দা ৪০-৪৫ টাকা থেকে ৫৫-৬০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। মান ভেদে কেজি প্রতি মসুর ডালের মূল্য বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গুঁড়ো দুধের মূল্য বেড়েছে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। অন্যান্য পণ্যের মূল্যও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাজারে গিয়ে কোনো পণ্যই সাধ্যের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা মোতাবেক,বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশের কাছাকাছি। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবার কারণে অনেকের পক্ষেই পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় উন্নত মানের খাদ্য ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাপী সম্ভাব্য খাদ্য সঙ্কট নিয়ে আলাপ হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। ইউরোপের অনেক দেশে নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। গত ৫০০ বছরের মধ্যে এমন প্রচণ্ড খরা আর কখনো প্রত্যক্ষ করা যায়নি। আগামীতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের মূল্য আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ অনেক দেশই তাদের কৃষি খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবে না। বাংলাদেশও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে থাকবে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। গম এবং ভুট্টা উৎপাদন বাড়নোর জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে পারবে।
Posted ১২:৪২ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy