শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শেয়ার বাজারে সফল হতে হলে মানি, নলেজ এবং ধৈর্য প্রয়োজন -অধ্যাপক আবু আহমেদ

  |   রবিবার, ১৪ মার্চ ২০২১   |   প্রিন্ট   |   1466 বার পঠিত

শেয়ার বাজারে সফল হতে হলে মানি, নলেজ এবং ধৈর্য প্রয়োজন -অধ্যাপক আবু আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং পুঁজি বাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেছেন, শেয়ারবাজারে যারা বিনিয়োগ করতে আসবেন তাদের বাজার সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা নিয়ে আসতে হবে। শেয়ার ব্যবসায় সম্পর্কে জানতে হবে। এটা অন্য কোনো সাধারণ ব্যবসায়ের মতো নয়। এখানে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কেউ যদি না জেনে হুজুগে শেয়ার বাজারে আসে তাহলে সে ফকির হয়ে যাবে। কাজেই বাজার এবং ব্যবসায়ের ধরন সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে বুঝেই শেয়ার বাজারে আসতে হবে। শেয়ার বাজারে সফল হতে হলে তিনটি বিষয় দরকার। এগুলো হচ্ছে, মানি, নলেজ এবং ধৈর্য।
অধ্যাপক আবু আহমেদ ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। সম্প্রতি তার সাথে কথা হয় শেয়ারবাজারের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। ব্যাংক বীমা অর্থনীতি (বিবিএ)’র পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এম এ খালেক। তার সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ এখানে উপস্থাপন করা হলো:
বিবিএ: স্টক মার্কেটে প্রায়শই নানা ধরনের গুজবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। গুজবের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারিরা বিভ্রান্ত হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: শেয়ার বাজার সব সময়ই অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ক্ষেত্র। বাজারে প্রায়শই নানা ধরনের গুজব প্রচারিত হয়। অনেকেই ফেসবুক, অনলাইনে শেয়ার আইটেম খোঁজ করে কেনার জন্য। এই প্রবণতা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হুজুগে যে কোনো কোম্পানির শেয়ার না কিনে কোম্পানির মৌলিক ভিত্তি, যেমন কোম্পানিতে আগের বছর ডিভিডেন্ড দিয়েছে কিনা, কোম্পানির উৎপাদন অবস্থা, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি ভালোভাবে যাচাই করার পরও কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনোক্রমেই হুজুগে শেয়ার ক্রয় করা উচিৎ নয়। কখনো কখনো দেখা যায়, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ২/৩ গুন বেড়ে যায়। অনেক সময় বিনিয়োগকারিরা কোনো কিছু না বুঝেই এসব কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করে। যারা গুজব ছড়ায় এটা তাদের একটি কৌশল মাত্র। তাদের হাতে থাকা শেয়ার বেশি দামে বিক্রির জন্য তারা এই কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। অনেকেই বেশি মুনাফা পাবার আশায় গুজবে প্রভাবিত হয়ে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিবিএ: শেয়ারবাজারে মাঝে মাঝেই অস্বাভাবিক উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায় এর কারণ কি?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: মূলত ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের পার্থক্যের কারণে এটা হয়ে থাকে। কোনো সময় বাজারে শেয়ারের সরবরাহ কমে যাবার পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এটা ঘটতে পারে। কোনো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ বেশি এবং চাহিদা কম থাকলে সেই শেয়ারের দাম কমে যাবে। আবার শেয়ার সরবরাহ কম থাকলে এবং চাহিদা বেড়ে গেলে সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে যাবে এটাই অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম। অর্থনীতিতে কোনো ভালো সংবাদ সৃষ্টি হলে শেয়ার বাজারে তার প্রভাব পড়তে পারে। এমন কি কোনো কোম্পানির ব্যবসায়িক সাফল্য বা উন্নতির কোনো সংবাদ পাওয়া গেলে সেই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বেড়ে যেতে পারে। কারণ এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের জন্য ক্রেতাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তারা বেশি মুনাফা পাবার আশায় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার কিনতে উৎসাহি হয়ে উঠতে পারে। আবার বিপরীত অবস্থাও লক্ষ্য করা যায়। কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে অথবা পরিচালকদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হলে সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে যেতে পারে।

বিবিএ: সম্প্রতি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ মুনাফা প্রদানের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আপনি এই সিদ্ধান্তকে কিভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদানের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি মনে করি, এটা মোটেও সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশ বর্তমানে মুক্ত বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল চেতনার পরিপন্থি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার উচিৎ। কারণ এতে বিনিয়োগকারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারতো। বিনিয়োগকারিরা অধিক হারে মুনাফা অর্জন করতে চায়। কিন্তু মুনাফার সর্বোচ্চ হার যদি নির্ধারণ করে দেয়া হয় তাহলে বিনিয়োগকারিরা নিরুৎসাহিত হবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক একদিকে বলছে তারা শেয়ার বাজারের ভালো চায় আবার অন্য দিকে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ভূমিকা আমার নিকট স্ববিরোধি বলে মনে হচ্ছে। একটি কোম্পানির সর্বোচ্চ কত ডিভিডেন্ড দিতে পারবে তা কোনো দেশেই নির্ধারণ করে দেয়া হয় না। কোম্পানি তার সামর্থ মতো ডিভিডেন্ড দেবে এটাই রীতি। আমি আশা করবো, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে তারা ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরের আর্থিক ভীত শক্ত করবে। কিন্তু এভাবে আর্থিক ভীত শক্ত করা যায় না। তারা যদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভীত শক্তিশালি করতে চায় তাহলে প্রভিশনিং ব্যবস্থা কড়াকড়ি করুক। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

বিবিএ : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার কথা ছিল তা হয়নি। ব্যক্তি খাতে নতুন যে সব শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার জন্য শর্তারোপ করা কি সম্ভব?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে নিয়ে আসার ইস্যুটি এখন পুরনো হয়ে গেছে। এগুলো বাজারে আসেনি। আর কখনো আসবেও না। ব্যক্তি খাতে যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে তাদের শেয়ার বাজারে আনার শর্তারোপ করা ঠিক হবে না। কারণ এটা উদ্যোক্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে। জোর করে কোনো কিছু করা ঠিক হবে না। সারা পৃথিবীতে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যারা শেয়ার বাজারে আসতে চায় তারা আসতে পারে। যদি কিছু সুবিধা দেয়া হয় তাহলে ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে আসতে পারে। যেমন করপোরেট ট্যাক্স যদি ১৫ শতাংশ কম করা হয় তাহলে তারা শেয়ার বাজারে আসার ব্যাপারে উৎসাহি হতে পারে।

বিবিএ: বর্তমানে শেয়ার বাজারের যে অবস্থা তাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিরা বাজারে এলে তাদের কি কি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: একজন বিনিয়োগকারি যখন বাজারে আসবেন তাকে শেয়ার ব্যবসায় সম্পর্কে ভালোভাবে জেনেই আসতে হবে। শেয়ার ব্যবসায় সম্পর্কে জানতে হবে। এটা অন্য কোনো সাধারণ ব্যবসায়ের মতো নয়। এখানে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কেউ যদি না জেনে হুজুগে শেয়ার বাজারে আসে তাহলে সে ফকির হয়ে যাবে। কাজেই বাজার এবং ব্যবসায়ের ধরন সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে বুঝেই শেয়ার বাজারে আসতে হবে। শেয়ার বাজারে সফল হতে হলে তিনটি বিষয় দরকার। এগুলো হচ্ছে, মানি, নলেজ এবং ধৈর্য।

বিবিএ: ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ জনিত এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেতে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: আপনি ঠিকই বলেছেন। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। অতীতে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত চ্যালেঞ্জ আর কখনো মোকাবেলা করতে হয়নি। কাজেই আগামী অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হবে বলে মনে হয় না। গত প্রায় এক বছর ধরেই দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চলছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটা আসেনি। বরং কোনো কোনো আগে বিনিয়োগকৃত বিদেশি পুঁজি চলে গেছে। স্থানীয় বিনিয়োগেও এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে অনেক দিন ধরেই। গত এক বছরে সেই স্থবিরতা আরো বেড়েছে। আমদের শেয়ারবাজারে পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট তেমন একটা আসেনি। বরং যেগুলো ছিল তাও প্রত্যাহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ সম্প্রতিক সময়ে উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছিল। সর্বশেষ ৮শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। কিন্তু করোনার কারণে সেই প্রবৃদ্ধি অনেকটাই নেমে গেছে। করোনার কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪দশমিক ৫ শতাংশে নেমে গেছে। যদিও জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই হার বিশে^র অনেক দেশের চেয়ে ভালো। তাই আমি একে মন্দের ভালো বলবো। কারণ অনেক দেশই আমাদের তুলনায় কম জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি করোনাকালিন সময়েও ভালো করার কারণ হলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেকেটাই উচ্চ মাত্রায় ছিল। চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রণীত হয় তার উপর করোনার প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের সময়ও আমাদের করোনার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। করোনা ভাইরাস এখনো আমাদের দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে। এটা কতদিন চলবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যদিও বলা হচ্ছে বাংলাদেশ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় অনেক দেশের তুলনায় বেশি সাফল্য প্রদর্শন করেছে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। করোনা সংক্রমণ শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে চলবে না। বিশে^র অন্যান্য এলাকায় যদি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসে তাহলে বাংলাদেশকেও তার প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে। কারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির এই সময়ে বিশে^র কোনো দেশই বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে রপ্তানি আয় বাইরের দেশগুলোর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপি’র প্রায় ৪০ শতাংশই বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজেই বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা না গেলে তার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়বে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিশ^ অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির উপরও পড়ে। কিন্তু তা সত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক এখনো ভালো অবস্থানে রয়েছে। যেমন, আমাদের পণ্য রপ্তানি আয় কিছুটা কমে গেলেও জনশক্তি রপ্তানি খাতের আয় বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। করোনার কারণে বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছে। কিন্তু তা সত্বেও রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে এই রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সার্ক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। স্ফীত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকার অর্থই হলো দেশটি সম্পর্কে বিদেশিদের ধারনা ভালো থাকবে। বাংলাদেশ স্থানীয় মুদ্রা টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে পেরেছে। এটাও একটি বড় ধরনের সাফল্য। অনেক দেশই করোনাকালে তাদের স্থানীয় মুদ্রার মান ধরে রাখতে পারেনি। উন্নয়নশীল অনেক দেশই তাদের স্থানীয় মুদ্রার মান ধরে রাখতে পারেনি। ভারত, তুরস্ক ইরান ইত্যাদি দেশ তাদের স্থানীয় মুদ্রার মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশ স্থানীয় মুদ্রার মান সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চমৎকার সাফল্য প্রদর্শন করতে পেরেছে।
বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তেমন একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। বিনিয়োগ যেটা হয়েছে তা মূলত সরকারি খাতেই হয়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে অনেক দিন ধরেই। কাজেই আগামী বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে। এটা সহসাই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো বড় ধরনের প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এক ধরনের দ্বিধার মধ্যে রয়েছেন। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আগামীতে পরিস্থিতি অনুকূল হলে হয়তো তারা নতুন বিনিয়োগের কথা চিন্তা করবেন। আগামী অর্থবছরে আমরা কেমন করতে পারবো তা অনেকটাই নির্ভর করছে বিশ^ অর্থনীতি কত দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে তার উপর। আমি মনে করি, আমরা যে অর্থবছর পেরিয়ে এলাম তা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ বছর। আগামী অর্থ বছর তার চেয়ে কিছুটা হলেও ভালো হতে পারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৫দশমিক ৫ বা তার চেয়ে একটু বেশি হয় তাহলে সেটা সন্তোষজনক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ট্যাক্স-রেভিনিউ রেশিও খুবই কম। আমাদের দেশের ট্যাক্স-রেভিনিউ রেশিও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সবার নিচে। অথচ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্যাক্স কালেকশনের সম্ভাবনাও ভালো। কিন্তু ট্যাক্স আদায় হচ্ছে না। সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটের জন্য ব্যাংকিং সেক্টর থেকে যে পরিমাণ ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করেছিলেন তা নিতে হয় নি। কারণ করোনার কারণে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হয়েছে। ইনফ্লেশনের তেমন কেনো ভয় নেই আপাতত।

বিবিএ: ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে দেবার পর বিনিয়োগ কমে গেছে। অনেকেই বলেন, ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করেই ঋণদান কমিয়ে দিয়েছে। আপনি কি বলেন?
অধ্যাপক আবু আহমেদ: ব্যাংকিং সেক্টরের সুদের হার কমানো হয়েছে। এটা ঠিকই আছে। উন্নত দেশগুলোতে সুদের হার আরো কম। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, ব্যাংক ঋণ প্রবাহ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। আপনি বললেন, কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করেই ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু আমি তেমনটা মনে করি না। ব্যাংকগুলো পরিকল্পিতভাবে ঋণ দান কমিয়ে দিয়েছে তেমনটি আমার মনে হয় না। করোনা কালিন সময়ে দেশে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। উদ্যোক্তারা এই অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। মূলত চাহিদা কমে যাবার কারণেই ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে। অন্য কোনো কারণ এখানে কাজ করেনি। চাহিদা কম থাকার কারণেই মূলত ব্যাংকিং সেক্টরে উদ্বৃত্ত তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। শিল্প খাতে বিনিয়োগের জন্য ঋণের চাহিদা কমেছে। এমন কি ভোগ্য পণ্য ক্রয়ের জন্যও ঋণের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংক ঋণের প্রবাহ বাড়াতে হলে সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকার যদি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে তাহলে ব্যক্তি খাতও সেই উদাহরণ অনুসরণ করবে।

বিবিএ: বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। আগামীতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্কম্্ুক্ত সুবিধা হারাবে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: আমি মনে করি, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারাটা একটি বিরাট অর্জন। কারণ আমরা তো চাচ্ছিলাম উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসার জন্য। আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে। স্বাধীনতাত্তোরকালে এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট অর্জন। কারণ কোনো দেশই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকতে চায় না। আবার চাইলেই সবাই স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উঠে আসতে পারে না। বাংলাদেশ সেটা পেরেছে। কাজেই আমি এই অর্জনকে সাধুবাদ জানাই। ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৬টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসতে পেরেছে। অনেকেই বলেন, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশ কিছু সুবিধা হারাবে। সুবিধা হারাবো বলে কি আমরা আজীবন স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকবো। সুবিধা হারালে হারাবো তাকে ক্ষতি নেই। আমরা অন্তত উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা তো লাভ করতে পারলাম-এটাই বা কম কিসের? উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আরো ১০/১২ বছর আগে এটা অর্জন করতে পারলে ভালো হতো। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসতে পারা একটি ভালো অর্জন যদিও আমরা অনেক বিলম্বে এটা পেয়েছি। আরো আগে হলে ভালো হতো। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হবার ৩ বছর পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে দেয়া জিএসপি সুবিধা হারাবে। ২০২৯ সাল এখন থেকে অনেক দূরে। আমরা এই সময়ের মধ্যে চেষ্টা করলে অর্থনীতিকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। এই সময়ের মধ্যে আমাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্লক এবং দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা করতে হবে। আগামীতে আমাদের প্রতিযোগিতা করেই বিশ^ বাজারে টিকে থাকতে হবে। কাজেই সেভাবেই প্রস্তৃতি নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কে স্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ একেবারেই কম।

বিবিএ: করোনাকালিন সময়ে এসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রণোদনা দেয়া হলেও এসএমই উদ্যোক্তারা এই ঋণের অর্থ গ্রহণ করতে পারেনি। এর কারণ কি?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: ব্যাংকগুলো এসএমই খাতে ঋণ দানের জন্য উদ্যোগী থাকলেও তারা নানা কারণেই এই ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। যে কোনো ঋণ নিতে হলে কিছু শর্ত পরিপালন করতে হয়। এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই এসব শর্ত পরিপালন করতে পারেনি। ফলে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারেনি। যারা ঋণ নেয়ার তারা যদি না নেয় তাহলে ব্যাংক কি করতে পারে? সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছেন এটা ঠিক আছে। তবে অর্থনীতির সব সেক্টর আরো আগেই খুলে দেয়া দরকার ছিল।

বিবিএ: সম্প্রতি ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিকট থেকে জিএসপি সুবিধা লাভ করেছে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে ভিয়েতনামের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। এটা কি ভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো তুলনা হয় না। ভিয়েতনাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের বিশেষ বাণিজ্য চুক্তি আছে। তারা আসিয়ানের সদস্য। আরো বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্লকের সঙ্গে ভিয়েতনামের সম্পর্ক রয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ব্যাপক ভিত্তিক দুর্নীতির উপস্থিতি। আমরা এখনো বিশে^র ১০টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের একটি। কাজেই উন্নয়নের সুফল আমরা পুরোপুরি ভোগ করতে পারছি না। উন্নয়ন যা হচ্ছে তার সুফল সামান্য কিছু মানুষের ভান্ডারে জমা হচ্ছে।

বিবিএ: বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সবচেয়ে স্ফীত অবস্থায় আছে। এই রিজার্ভ কিভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক আবু আহমেদ: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একমাত্র বিকল্প ব্যবহার হতে পারে বিনিয়োগ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের চাহিদা বাড়লে রিজার্ভ ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই মন্থর হয়ে আছে।

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:২৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৪ মার্চ ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।