শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সফলতার আরেক নাম “জ্যাক মা”

বিবিএনিউজ.নেট   |   বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   |   প্রিন্ট   |   1319 বার পঠিত

সফলতার আরেক নাম “জ্যাক মা”

তুমি যদি চেষ্টাই না কর তবে চান্স আছে কিনা বুঝবে কি করে? – জ্যাক মা

বেকার বা চাকরিজীবী সবাই ভাবেন একটা ব্যবসা করবো। ব্যবসাটা হবে একান্ত নিজের। প্রথমেই কি ব্যবসা করা যায় তার একটা আইডিয়া বের করেন।কিন্তু ব্যবসাটা করা হয় না!!
কারণ, এই আইডিয়া নিয়ে বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করতে গেলেই অধিকাংশই বলে বাজে চিন্তা, ফাউল আইডিয়া, ধরাখাবি হাবিজাবি।

“জ্যাক মা” একবার ব্যবসার একটি আইডিয়া দাড় করালেন। তারপর তিনি তার ১৭ জন বন্ধুকে বাসায় ডেকে আনেন। তাদের সাথে তিনি তার আইডিয়ার কথা শেয়ার করেন। কিন্তু সবাই তার এই আইডিয়াকে ‘স্টুপিড আইডিয়া’ বলে চলে যায়। পুরো রাত জুড়ে জ্যাক মা তার উদ্যোগের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করেন এবং পরের দিন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে অন্যরা যাই বলুক, তিনি এই কাজটি করবেনই।
বন্ধুদের এরকম চলে যাওয়ার পেছনে শুধু যে তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিলো তা নয়, কিছু বাস্তব সম্মত কারনও ছিলো। কারণ জানবো তার আগে জেনে নেই জ্যাক মা কে?

চীনের হোয়াং ঝু প্রদেশে ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন জ্যাক মা। তার পিতা মাতা হাট বাজারে গান গেয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। দাদা ছিলেন চীনের জাতীয়তাবাদী দলের একজন স্থানীয় অফিসার। কম্যুনিস্ট পার্টি বিজয়ের পর মাও মায়ের দাদাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মোটকথা, মা ছিলেন অভাব অনাটনে অতিষ্ঠ এক সাধারণ পরিবারের সন্তান। জ্যাক মা তার শিক্ষাজীবনে ছিলো চরম মাত্রায় ব্যর্থ, চাকরিতেও অসফল।

জ্যাক মা তার জীবনের প্রথম ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেন টানা ২ বার। শুরুতেই গলদ করেই এই ছাত্র বহু কস্টে শিক্ষাজীবনে ১৭ বার ফেল করে গিয়েছিলো কলেজ পর্যন্ত। কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় পর পর দুইবার ফেল করে সবশেষে এই অভিশপ্ত শিক্ষাজীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করেন কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। বোকা ফেল করা ছাত্র হয়েও তিনি পড়তে চেয়েছিলেন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কলেজের একটিতে। সেখানেও ব্যর্থ হন তিনি। একবার না, টানা ১০ বার চেস্টা চালিয়েছিলেন হার্ভাডে পড়ার জন্য কিন্তু ভাগ্য সবার সহায় হয় না।

কেএফসি যখন চীনে তাদের ব্যবসার জন্য আসে তখন জ্যাক ম্যাসহ ২৪ জন কেএফসিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন। সেখানে ২৩ জনের চাকরি হলেও বাদ পড়ে যান হতভাগা মা। এরপর শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নেন জ্যা মা।

জ্যাক মা কিন্তু তার আসল নাম নয়। একজন বন্ধুর পরামর্শে মা ইয়ান থেকে তিনি ধারণ করেন নতুন নাম, জ্যাক মা। পরে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে মাত্র ১০ ইয়েনের বেতনে শিক্ষকতার চাকরি নেন জ্যা মা । অভাব অনটনে চলতে থাকে দিন। প্রাথমিক পরীক্ষায় ফেল ২ বার, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল ৩ বার, পুলিশ হতে গিয়ে ব্যর্থ ১ বার, হার্ভার্ডে ভর্তির চেষ্টায় ব্যর্থ ১০ বার, কেএফসির চাকরিতে ২৩ জনের মধ্যে একাই ব্যর্থ।

জ্যাক মা কি করেছিলেন?
সময়টি ছিলো ১৯৯৫ সাল। ভ্রমণে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে দেখেন অনেকেই ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ধরনের ব্যবসা করছেন। তার মনেও এ ধরনের চিন্তা আসে। তিনি হিসাব করে দেখেন, সামনের দিনগুলোতে ইন্টারনেটের সম্ভাবনা ব্যাপক। দেশে ফিরে পণ্য কেনা বেচার একটি ওয়েবসাইট খুলে বসেন। যার নাম দেন ‘আলীবাবা.কম’।

চিনতে পেরেছেন আলিবাবাকে?
To make it easy to do business anywhere মিশনকে সামনে রেখে ১৯৯৯ সালে শুরু হয় আলীবাবা.কম। আলীবাবা গ্রুপের কর্পোরেট ক্যাম্পাস হাংঝু প্রদেশের জিজি জেলাতে অবস্থিত। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চীনেই আলিবাবা গ্রুপের ১২৬টি অফিস এবং ২৯টি আন্তর্জাতিক অফিস আছে। কর্মচারি সংখ্যা ৭০ হাজারেরও অধিক।

জ্যাক মা তার প্রতিষ্ঠানের নাম আলিবাবা রাখার পিছনে কারণ হচ্ছে। আলীবাবা চরিত্রটি জনপ্রিয় এবং বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ আলীবাবার গল্প জানে এবং এটি উচ্চারণ করাও সোজা। যারাই আলীবাবা চল্লিশ চোরের গল্প পড়েছেন তারাই জানেন সেই বিখ্যাত “খুল যা সিমসিম” মানে দরজা খুলে গেলেই জীবন বদলে গেল। ঠিক তেমনিভাবে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আলীবাবা.কম ছোট উদ্যোক্তাদের জন্যে সম্ভাবনার বিশাল দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ২০০০ সালে আলীবাবা ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পায়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাপানের সফটব্যাংক। ২০০১ সালে আলীবাবার রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখ অতিক্রম করে। ২০০৩ সালে জ্যাক মা’র অ্যাপার্টমেন্টে তাওবাও.কম অনলাইন মার্কেটপ্লেস চালু করা হয়। ২০০৪ সালে আলী-পে চালু করা হয়। ২০০৫ আলীবাবা গ্রুপ এবং ইয়াহু’র সাথে একটি স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ করে। ২০০৬ তাওবাও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্চেন্ট এবং ক্রেতা কীভাবে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করবে তার ওপরে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ২০০৭ হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে আলীবাবার শেয়ার ছাড়া হয়। ২০০৮ আলীবাবা গ্রুপ গবেষণা ইনস্টিটিটিউট স্থাপিত হয়। তাওবাও মার্কেট প্লেসের সাথে তাওবাও মল চালু করা হয় । ২০০৯ আলীইয়ুন নামে আলীবাবা ক্লাউড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় এবং আলীবাবা গ্রুপের দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত। ২০১০ চায়না মার্কেট প্লেসের নাম বদলে ১৬৮৮ ডট কম করা হয়। এ বছরের মার্চে অনলাইন গ্রুপ বাইং মার্কেটপ্লেস জুহুয়াসুয়ান, এপ্রিলে আলিএক্সপ্রেস স্থাপিত হয়। ২০১১ তাওবাও মল আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু করা হয়। আগে এটি তাওবাও মার্কেটপ্লেসের অংশ হিসেবে ছিল। ২০১২ সালে তাওবাও’র দশম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হয় এবং এ উপলক্ষে চীন ও চীনের বাইরে থেকে আলীবাবা গ্রুপের কর্মচারীরা হাংঝুতে আসে। আগস্ট মাসে আলীবাবা গ্রুপ জিজি জেলাতে তাদের কর্পোরেট হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করে। ২০১৪ ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য চীনের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার জন্যে টিমলের নতুন প্ল্যাটফর্ম টিমল গ্লোবাল চালু করা হয়। জুন মাসে মুভি এবং টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠান চায়নাভিশন এর ৬০% স্টেইক ক্রয় করে। বর্তমানে এটি আলিবাবা পিকচার্স গ্রুপ নামে পরিচিত। জুন মাসে ইনটাইম নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে চীনে অনলাইন-টু-অফলাইন ব্যবসা শুরু করে। ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে আলীবাবা গ্রুপ নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তাদের শেয়ার ছাড়ে। প্রথম দিনেই আইপিও থেকে ২ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আয় করে আলীবাবা। এরপর আরো ৪ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়। সব মিলিয়ে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহ করে যা বিশ্বের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অক্টোবর মাসে অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস গ্রুপ চালু হয় ।

এই কোম্পানিটিই বর্তমান বিশ্বে ই-কর্মাসের সফলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আলীবাবার মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করেই জ্যাক চীনের সবচেয়ে বড় ধনী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আলীবাবার ১২ ভাগ শেয়ার বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ। এই শেয়ারের মোট মূল্য ২০ বিলিয়ন ডলার।

কীভাবে জ্যাক মা এমন সফল হলেন?
তিনি ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দিয়েছেন। ১। প্রবল আত্মবিশ্বাস ২। কাজকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে ৩। হাল ছাড়লে চলবে না ৪। উদ্যোগ নিলে সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে ৫। ভয় করলে চলবে না ৬। প্রতিদ্বন্দ্বীদের কখনোই শত্রু মনে করা যাবে না ।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ২৬তম ধনী ব্যক্তি জ্যাক মা। তার বর্তমান সম্পদের পরিমান ২৭ বিলিয়ন ডলারের ওপর। পেশাগত উন্নতি এবং আর্থিক অবস্থা কি আপনাকে নিরুৎসাহিত করে? যদি করে থাকে, তবে চায়নিজ কোটিপতি ‘জ্যাক মা’ আপনাদের জন্য কিছু উপদেশ দিয়েছেন। যা মেনে চলে তিনি নিজেও পেয়েছেন সফলতা।

-“যখন আমাদের টাকা থাকে তখন আমরা ভুল করা শুরু করি।”

-“তুমি যদি হাল ছেড়ে না দাও তবে এখনো তোমার সুযোগ আছে। হাল ছেড়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ”

-“পশ্চাদ্ধাবন যতই কঠিন হোক না কেন সবসময় তোমার সেই স্বপ্নই থাকা উচিত যা তুমি প্রথমদিন দেখেছিলে। এটা তোমাকে উদ্বুদ্ধ রাখবে এবং যেকোন দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করবে” -“সুযোগ যেখানেই নিহিত যেখানে অভিযোগ আছে”

-“কখনো কোনদিন সরকারের সাথে ব্যবসা করো না। তাদের সাথে ভালোবাসা রেখো কিন্তু বিয়ে করো না। ”

-“আমাদের কখনোই ২০ বছরেরর প্রোগ্রাম ২ বছরে শেষ করা উচিত নয়।”

-“আমি কোন প্রযুক্তিবিদ নই বরং আমি আমার কাস্টমার এবং সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে প্রযুক্তির দিকে তাকিয়ে আছি।”

-“আমি নিজেকে সবসময় আনন্দিত রাখতে চেষ্টা করি। কারণ আমি জানি যদি আমি খুশি না থাকি তবে আমার সহকর্মী,অংশীদার ও ক্রেতারাও খুশি থাকবে না।”

-“আমার চাকরি হচ্ছে আরো বেশি লোকদের চাকরি পাইয়ে দেয়া।”

জ্যাক মা তার অদম্য মেধা এবং অধ্যবসায় দিয়ে সকল বাধা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যর্থতা এবং বাধা পেরিয়ে কীভাবে সফল হতে হয় তার চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কেউ হতে পারে না।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৫:৫২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।