এস জেড ইসলাম ও আদম মালেক | বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ | প্রিন্ট | 480 বার পঠিত
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য প্রথম আলো সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের স্বীকৃতি আছে। স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করেছেন তিনি। সামনে এসেছে দুর্নীতির অনেক চিত্র। বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল। উন্মোচিত হয় দুর্নীতিবাজদের মুখোশ। বেকায়দায় পড়েন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তারা। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফাইল চুরি নয় রোজিনা ইসলামের সৎ সাংবাদিকতাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
চলতি বছরের ১১ এপ্রিল ‘এখন এক কোটি দেব, পরে আরও পাবেন’ শিরোনামে রোজিনা ইসলামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দেশের সুপরিচিত জাতীয় দৈনিকে। ঐ প্রতিবেদনে দেখা যায়Ñ করোনাকালে সরকারি হাসপাতালে টেকনিক্যাল কর্মী সংকট থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৮’শ লোক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়। এমন তথ্য ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরলে নিয়োগ কমিটি থেকে দুজন সদস্যকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় নিয়োগ কার্যক্রম। এতে ওই সিন্ডিকেটের রোষাণলে পড়েন রোজিনা ইসলাম। এই রিপোর্টের রেশ না কাটতেই ৩০ এপ্রিল, ‘স্বাস্থ্য খাতে ৩৫০ কোটি টাকার জরুরী কেনাকাটায় অনিয়ম’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন ছাপা হয় একই পত্রিকায়। এই প্রতিবেদনে অনিয়ম দুর্নীতির আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেন। বিপুল অঙ্কের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেও সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করে যথাযথ অনুমোদন নেয়া হয়নি। জামানত ছাড়া এ ক্রয় কার্যক্রমে হয়নি কোন সম্পাদনা চুক্তি। এমনকি সরবরাহ আদেশে পণ্য সরবরাহের নির্দিষ্ট সময়সীমাও উল্লেখ ছিল না। সংশ্লিষ্ট সামগ্রীর পরিমাণ উল্লেখ করা হলেও নির্ধারিত কোনো একক মূল্য ও মোট মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে হামলা, মামলা ও কারাবরণের পরও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সচল রোজিনার কলম। গত মঙ্গলবারও রোজিনা ইসলাম ও শিশির মোড়লের যৌথ প্রতিবেদন- ‘পড়ে আছে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রি’ প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে জানা যায়, দীর্ঘ ১০ মাস ধরে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০২ কোটি টাকা মূল্যের চিকিৎসা সামগ্রী পড়ে আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে এক হাজার দুই’শ পিস অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটার, বিপুল পরিমাণ পালস অক্সিমিটার, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, মাস্ক, পিপিইসহ আরও নানা সামগ্রী। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় অনেক উপকরণই নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য ব্যবহৃত প্রায় ৩০০ ভেন্টিলেটর অযথা পড়ে রয়েছে। অথচ প্রয়োজনে অক্সিজেন পাচ্ছে না হাসপাতালে ভর্তি করোনার রোগী। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু বাড়ছে।
রোজিনা ইসলামের এসব প্রতিবেদনে ক্রমেই ফাঁস হচ্ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অদক্ষতার তথ্য। এসব অনিয়মে নামমাত্র তদন্ত হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। এসব অনিয়মে পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সম্পৃক্তা রয়েছে বলেও অনেকে দাবী করছেন। এতেই গাত্রদাহ শুরু হয় মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজদের। তাই ফাইল চুরির নাটক সাজিয়ে রোজিনা ইসলামকে পঙ্গু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে মনে করছেন সাংবাদিক মহল।
সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেনÑ আমি এ বিষয়ে অভিযুক্ত অতিরিক্ত সচিবকে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি জানিয়েছেন রোজিনাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি। বরং রোজিনা তার ওপর হামলা করেছিল। ঘটনার পর রোজিনাকে যখন আটকানোর চেষ্টা করা হয় তখন তিনি ওই অতিরিক্ত সচিবকে খামচি দিয়েছেন, থাপ্পড় মেরেছেন। এরপর পুলিশ এলে তাকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্থা করা সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, তাকে আটকে রেখে কোন ধরনের নির্যাতন বা আঘাত করা হয়নি। বরং সাংবাদিক নিজেই মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তাকে সেই কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল না এবং তাতেই এত সময় লেগেছে।
গণমাধ্যম কর্মীদের মতে, জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনের সূত্রে তদন্ত চালিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয়ের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে সরকার। অনেকেই আছেন শাস্তি আতংকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালিক ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। অভিযোগ রয়েছেÑ তার প্রশয়ে হচ্ছে এসব দুর্নীতি। অনিয়মের অর্থের একটি বড় অংশ যাচ্ছে তার পকেটে। তাই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাঁচাতে মরিয়া স্বয়ং মন্ত্রী। সাফাই গাইছেন দুর্নীতিগ্রস্থদের পক্ষে।
এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভোরর কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘তথ্য চুরি’র যে অভিযোগ আনা হচ্ছে দেখতে হবে সেটা কী কারণে হয়েছে। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা কাজটি করেছেন রিপোর্ট করার জন্য। সাংবাদিকতা করতে গেলে এরকম করতেই হবে। টুকটাক আমরাও করেছি। এটাকে চুরি বলা যাবে না। অন্যায় কাজ বলা যাবে না। এখানে উদ্দেশ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। তার উদ্দেশ্য আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া ছিল না।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজের প্রতিষ্ঠান সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স নিয়েও বীমা খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রীত্ব লাভের আগে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে জাহিদ মালেক স্বপন দায়িত্বপালন করলেও বর্তমানে তার বোন প্রফেসর ড. রুবিনা হামিদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন যাবৎ আমানতকারী গ্রাহকদের টাকা প্রদান না করা, অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় চেয়ারম্যান ও সিইও বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। শুধু কুষ্টিয়া জেলার গ্রাহকদের পক্ষ থেকেই শতাধিক মামলা হয়েছে কোম্পানির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধশত মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। যা কুষ্টিয়ার আদালত থেকে ঢাকার বনানী থানায় প্রেরণ করা হয়েছে। শুধু মন্ত্রীত্বের ক্ষমতা ও দাপটে আসামীদের গ্রেফতার করতে পারছে না বনানী থানা পুলিশ।
এছাড়া রংপুর জোনাল অফিসের (গণমুখী বীমা প্রকল্প) সাতশ আশি জন গ্রাহকের প্রায় কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ দাবী গত তিন বছর যাবত পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ওই অঞ্চলে কর্মরত প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা প্রায়ই গ্রাহকদের দ্বারা মানসিক হেনস্তা ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছে এক কর্মকর্তা। এমনকি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছেও বিষয়টি চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোন ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি আইডিআরএ। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনে ওই কর্মকর্তা চিঠি দিলে দুদক থেকে আইডিআরএকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানানো হয়। একপ্রকার চাপে পড়ে অবশেষে এ নিয়ে তদন্তে নেমে সত্যতা পায় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইডিআরএতে এমন অভিযোগ দিয়েছে কুমিল্লার মুরাদনগরে কোম্পানির ডেপুটি ভাইস প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত হোসেন। সেখানেও ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে দাবীর টাকা পাচ্ছে গ্রাহকরা। ফলে ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের রোষ থেকে বাঁচতে নিজের পকেট থেকে টাকা দিতে হচ্ছে ওই কর্মকর্তার। অবস্থার আলোকে মনে হচ্ছে- কোন পাপের কারণেই বীমা পেশায় সৃষ্টিকর্তা তার আগমন ঘটিয়েছেন এবং সামাজিক সম্মান হারাচ্ছেন। কোম্পানির কাছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাহকদের দাবীর পরিমাণ শতকোটি টাকার উর্ধ্বে।
তারল্য সম্পদের সংকট থাকার দাবী পরিশোধে সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে কোম্পানির পর্ষদ। এজন্য ১৫নং মহাখালীতে কোম্পানির নির্মানাধীন ভবনসহ ৮.৩৭ কাঠা জমি বিক্রয়ে গত ২৮ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন দেয়। এটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে নিটল মর্টস কোম্পানি। উভয় পক্ষের আলোচনার পর ৪৬ কোটি টাকা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ হয়। এরপর জমি বিক্রয়ের অনুমোদন চেয়ে আইডিআরএ’র কাছে চিঠি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ আবেদনে সাড়াও দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে কোম্পানির পর্ষদের প্রতি আস্থাহীনতা থাকায় ‘বিক্রয়লব্ধ অর্থ শুধু দাবী পরিশোধে ব্যয় করা হবে’ এমন শর্তে অনুমোদন দেয় সংস্থাটি।
এসব বিষয় জানতে কোম্পানির অফিসিয়াল নাম্বারে একাধিকবার ফোন করা হলেও কেউ রিসিভ করেননি। এরপর অর্থ ও হিসাব বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহেদুর রহমানের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন করা হলে তিনি শুনতে পাচ্ছেন না বলে লাইনটি কেটে দেন। পরবর্তীতে আবার ফোন করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আরেক প্রতিষ্ঠান বিডি থাই নিয়েও পুঁজিবাজারে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি রাইট শেয়ার ইস্যু করে বিনিয়োগকারীদের পকেট কেটেছে বলে ক্ষোভও জানিয়েছে অনেকে।
Posted ২:২১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy