শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তান

বিবিএনিউজ.নেট   |   সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯   |   প্রিন্ট   |   456 বার পঠিত

হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তান

ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশ হয় গত জুন মাসে। তাতে পুরো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়। এর বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ফলে সুপারিশ বাস্তায়নের পথ থমকে যায়। সে ঘটনার দুই মাস কাটতে না কাটতেই বহু ভাষাভাষীর ভারতীয়দের ওপর হিন্দি চাপানো নিয়ে পুরনো বিতর্ক আবার উস্কে দিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদকে চাঙ্গা করতে হিন্দিকে জনপ্রিয় করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আগে থেকেই রয়েছে বিজেপির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও হিন্দিকে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। তবে বাস্তবতা হলো, দেশটির প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জনই হিন্দিতে কথা বলে না। তা ছাড়া বাংলা, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কানাড়াসহ ভারতে ২২টি তফসিলি ভাষা রয়েছে। আর সব মিলে এক হাজার ৬৫২টি ভাষার প্রচলন আছে দেশটিতে। এ পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দিকে রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে বিজেপির প্রচারিত ‘এক রাষ্ট্র, এক ভাষা’ নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

ইতিহাসে দেখা যায়, স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন সময়ে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। এ জন্য রক্তও দিয়েছে তামিলরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপির এসব কর্মকাণ্ড মূলত তাদের আদর্শিক সংগঠন আরএসএসের ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’- এ তিন নীতিরই অংশ। ভারতের সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী বলেন, ‘ভাষাপ্রেম যে কী, তা অমিত শাহের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। দেশকে হিন্দি দিয়ে বাঁধার কথা বলছেন কিন্তু আসলে তা বিভাজনের দিকেই যাবে।’ খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও আনন্দবাজার পত্রিকার।

২০১১ সালে ভারতের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জনেরই মাতৃভাষা হিন্দি নয়। ৪৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা বলে। তার পরই বাংলার অবস্থান। ভারতের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। মারাঠিতে কথা বলে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, তেলেগু ভাষাভাষীর সংখ্যা ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং তামিল জনগোষ্ঠী ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বাকি জনসংখ্যার ভাষা এক হাজার ৬শ’রও বেশি। অমিত শাহর হিন্দি আগ্রাসনের পরিকল্পনা এসব ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বের হুমকিতে ফেলবে।

হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতের অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সবসময় সোচ্চার। ২০১২ সালে এ-সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে গুজরাট হাইকোর্ট বলেছিলেন, গুজরাটিদের জন্য হিন্দি বিদেশি ভাষা। এ ছাড়া ২০০৬-এ জাতীয় সড়ক প্রশস্ত করার প্রকল্প নিয়েও তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। ওই সময় ন্যাশনাল হাইওয়ে অব ইন্ডিয়ার (এনএইচএআই) বিজ্ঞপ্তি কেন শুধু হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন জুনাগড়ের চাষিরা। তারা গুজরাট হাইকোর্টের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। তখন আদালত রায়ে বলেছিলেন, গুজরাটি ভাষায় বিজ্ঞপ্তি জারি না করে ভুল করেছে এনএইচএআই। একই কারণে সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তিও বাতিল করেছিলেন হাইকোর্ট।

ভারতের কয়েকটি ভাষার লড়াই :১৯৩৭ সালে তামিলনাড়ূর স্কুলে হিন্দি পড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হয়েছিল। ১৯৫০ সালে ১৫ বছরের জন্য হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও সরকারি কাজকর্মের ভাষা রাখার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন অন্য ভাষাভাষীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৩ সালে ‘সরকারি ভাষা আইন ১৯৬৩’তে বলা হয়, ১৯৬৫ সালের পরও ইংরেজি সরকারি ভাষা থাকছে। তবে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দির বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করে তালিমরা। এরপর ১৯৬৭ সালে আইন সংশোধন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইংরেজি চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার।

ভারতের দুটি প্রধান ভাষাগোষ্ঠী হলো ইন্দো-আর্য (মোট জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ) ও দ্রাবিড় (মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ)। অপরাপর ভাষাগোষ্ঠীগুলো হলো অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও তিব্বতি-বর্মী ভাষাগোষ্ঠী। এককভাবে ভারতের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা হিন্দি, যা কি-না কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে নির্ধারিত। ‘সহায়ক দাপ্তরিক ভাষা’ ইংরেজি প্রশাসন ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহূত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ইংরেজির প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। ভারতের সংবিধান বাংলাসহ ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এগুলো হয় প্রচলিত, না হয় ধ্রুপদী ভাষা। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়ে আসছে তামিল ও সংস্কৃত। এ ছাড়া কানাড়া ও তেলেগু ভাষাকে ভারত সরকার নিজস্ব যোগ্যতাসূচক ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে।

এ অবস্থায় বিজেপি শীর্ষ নীতিনির্ধারক অমিত শাহের ‘এক রাষ্ট্র, এক ভাষা’ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা ভারতীয়রা কীভাবে জবাব দেয়, তা দেখার বিষয়। যদিও অমিত শাহ একটু ঘুরিয়ে হিন্দির গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতে বহু ভাষা রয়েছে। প্রতিটির গুরুত্ব রয়েছে। তবে দেশের একটি ভাষা থাকা প্রয়োজন, যাকে বিশ্ব স্বীকৃতি দেবে ভারতীয় ভাষা হিসেবে। যদি কোনো ভাষা দেশকে ঐক্যের সুতায় বাঁধতে পারে, তা হলো হিন্দি।’

অমিতের মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিএমকে সভাপতি এমকে স্ট্যালিন, পদুচেরির মুখ্যমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী, কর্ণাটকের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারস্বামী থেকে শুরু করে বাম নেতারা এক সুরে অমিত শাহের বক্তব্যের কঠোর বিরোধিতা করেছেন। স্ট্যালিন বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদির উচিত অমিত শাহের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া। না হলে ডিএমকে আর একটি ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবে। এটা ইন্ডিয়া না কি হিন্দিয়া?’ টুইটারে মমতা লিখেছেন, ‘আমাদের উচিত সব ভাষা, সংস্কৃতিকে সমানভাবে সম্মান দেখানো। আমরা অনেক ভাষাই শিখতে পারি। কিন্তু মাতৃভাষাকে ভোলা উচিত নয়।’

Facebook Comments Box
বিষয় :
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ২:০১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।