আদম মালেক | মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 555 বার পঠিত
প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ে জনগণের আগ্রহ বেশি। এজন্য আমানত ও ঋণ বিতরণে তুলনামূলক শক্তিশালী শরিয়াহ ব্যাংকিং। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে ইসলামি ব্যাংকিং। এজন্য প্রচলিত ব্যাংকগুলো সুদের পাশাপাশি শরিয়া সুবিধাও হাতছাড়া করতে চায় না বলে জানা গেছে।
এ সুবিধার জন্য কোনো কোনো প্রচলিত ব্যাংক নামের সঙ্গে ইসলাম জুড়ে দিয়ে ইসলামি ব্যাংকিং খাতায় নাম লেখাচ্ছে। কেউ পুরোনো নামেই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ে। অনেকে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের জন্য পাইপ লাইনে আছে। কেউ কেউ প্রচলিত সুদি কারবার থেকে সম্পূর্ণ সরে আসতে না পারায় আংশিক শরিয়াহ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নিচ্ছে। এ কাতারে শামিল হয়েছে অমুসলিম উদ্যোক্তা পরিচালিত বিদেশি ব্যাংকগুলোও। প্রতিষ্ঠানগুলো সুদ খায় কিন্তু শরিয়াহ সুবিধার মোহও ছাড়তে পারছে না। তাই সুদভিত্তিক সুবিধা হাতে রেখেই অনেক ব্যাংক ঢুকে পড়ছে শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ে ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইসলামি ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে বর্তমানে ১৩ শতাংশ এসএলআর রাখার বাধ্যকতা থাকলেও ইসলামি ব্যাংকের ক্ষেত্রে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো যেখানে ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা ঋণ দিতে পারে। ইসলামি ব্যাংকগুলো সেখানে ৯২ টাকা দিতে পারে। এদিকে পরিচালন কার্যক্রমে প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে ইসলামি ব্যাংক। ইসলামি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরিয়াহ অ্যাডভাইজারি কমিটি থাকলে ব্যাংকিংয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে প্রত্যেক ব্যাংকের নিজস্ব ইসলামি শরিয়াহ বোর্ড। নিজস্ব শরিয়াহ বোর্ডের কাছেই ইসলামি ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহি করতে হয়। ৬৩টি ব্যাংকের মধ্যে প্রচলিত ব্যাংকের উইন্ডোসহ ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের কাছে আছে মোট আমানতের ২৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল আজিজ বলেন, আমি মনে করি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং করলে তা পুরোপুরি হওয়া উচিত। যেমন বেশ কয়টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং চালায়। সেখানে নিরীক্ষকরা শরিয়াহবহির্ভূত কোনো মুনাফা থাকলে তা বাদ দিতে পারে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে সুদের সঙ্গে শরিয়াহ মুনাফার আলাদা হিসাব সময নাও হতে পারে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৮৩ সালে ইসলমি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ১৯৯৫ আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। ৩য় পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। একই বছর এক্সিম ব্যাংক প্রথাগত ব্যাংকিং চালু করলেও ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি ইসলামি ব্যাংকিংয়ের তালিম গ্রহণ করে। ২০১৩ সালে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয় ইউনিয়ন ব্যাংক। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ইসলামি ব্যাংকিয়ের অনুমোদন পায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম চৌধুরী। একইদিন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকও শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের অনুমতি পায়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কাজী আকরামউদ্দিন আহমদ। মার্চে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য যমুনা ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে প্রথাগত ব্যাংকগুলো ক্রমেই ইসলামি ব্যাংকিংয়ের কাতারে শামিল হতে থাকে। তাছাড়া আইএফআইসি, এনসিসি এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে- রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের। তালিকায় আছে বেসরকারি খাতের পূবালী, এবি, দি সিটি, প্রাইম, সাউথইস্ট, ঢাকা, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া ট্রাস্ট ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এ ছাড়া বিদেশি মালিকানার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, আল-ফালাহ ও এইচএসবিসি ব্যাংকে ইসলামি ব্যাংকিং রয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দিন দিন ইসলামি ব্যাংকিং পরিধি বড় হচ্ছে। অনেকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং না করে উইন্ডো খুলে শরিয়াহ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালায়। যারা সুদি কারবারের পাশাপাশি আংশিক ইসলামি ব্যাংকিং করতে চায় তাদের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইসলামি ব্যাংক মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সব স্তরেই ইসলামি শরিয়ার নীতিমালাকে মেনে চলে। ইসলামি ব্যাংক অর্থের ব্যবসা করে না, বরং পণ্যের ব্যবসা করে। ইসলামি ব্যাংকে নগদ অর্থ পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না, বরং নগদ অর্থকে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সুদি ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে সুদি অর্থের ব্যবসা করে, অর্থাৎ অর্থকে ব্যবসার পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ে যেমন মুনাফা বণ্টন হয়, তেমনি লোকসানের ঝুঁকিও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে তা নেই। তাই সুদি ব্যাংকের শরিয়াহ ব্যাংকিং অনেক গ্রাহক সুনজরে দেখে না। এজন্য যারা সুদের সঙ্গে শরিয়াহ কার্যক্রম চালায় তাদের কারো কারো আমানত কম। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানত এলেও ঋণ বিতরণ সন্তোষজনক নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্কেন্টাইল ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক আমানত সংগ্রহ করেছে ৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আমানতের কোনো ঋণই বিতরণই করতে পারেনি। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঋণ বিতরণও শূন্যের কোঠায়। সোনালী ব্যাংকের বিতরণ ৫ শতাংশ। যমুনা ব্যাংক আমানতের ৬ শতাংশ বিতরণ করেছে; ব্যাংকটির বিতরণের পরিমাণ ৪১৯ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক বিতরণ করেছে সংগৃহীত আমানতের মাত্র ১৫ শতাংশ। মধুমতি ব্যাংক ৯১ কোটি টাকা আমানতের মধ্যে বিতরণ করেছে মাত্র ২৩ শতাংশ।
এবি ব্যাংকের শরিয়া আমানত ৬১০ কোটি টাকা; বিতরণ করেছে ৮৪ শতাংশ। ব্যাংক এশিয়া দুই হাজার ৬৮ কোটি টাকা আমানতের মধ্য বিতরণ করেছে ৭০ শতাংশ। সিটি ব্যাংক এক হাজার ৪৩৪ কোটি টাকার মধ্যে বিতরণ করেছে ৫৬ শতাংশ।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা দেখে বিদেশি ব্যাংকগুলোও বসে নেই। তারাও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং শুরু করেছে। এসব ব্যাংকের মূল দেশ মুসলিম দেশের বাইরে অমুসলিম দেশও রয়েছে। কিন্তু তারাও বিনিয়োগে সুবিধা করতে পারছে না। আল আরাফাহ ৪৫৫ কোটি টাকা আমানতের মধ্যে বিনিয়োগ করেছে ৫০ শতাংশ। হংকংভিত্তিক এইচএসবিসি ব্যাংক আমানতের কোনো টাকাই বিতরণ করতে পারেনি। অন্যদিকে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড চার্টার্ড ব্যাংক এক হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার মধ্যে বিনিয়োগ করেছে এক হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৬২ শতাংশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণের হার ৯৯ শতাংশ। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের হার ৭৬ শতাংশ। ৯২ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক আমানতের ৯৭ শতাংশ; সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ ৯১ শতাংশ; আল আরাফাহ ব্যাংকের ৮৩ শতাংশ; আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৭০ শতাংশ এবং দেশের সব চেয়ে বড় শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে ৮২ শতাংশ।
Posted ৩:৫০ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed