ড: নিয়াজ পাশা | বুধবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 1952 বার পঠিত
আব্দুল হামিদ । ভাটির মাটির, কাদা-জলে মাখামাখি করে বেড়ে উঠা একজন খাঁটি মানুষ । হাওরের বন্ধু, ভাটির শার্দুল । তাঁর কথা, উচ্চারণ ভঙ্গি, রসিকতা হাসি তাঁকে অনন্য করেছে। তিনি ইটনা, অষ্টগ্রাম আর মিটামনের চার পুরুষের নেতা, আপনজন । ভাটিবাসির প্রিয় হামিদ ভাই, একজন অজাত শত্রু, দরদী মানুষ । মানুষের উপকার করতে না পারলেও তাঁর দ্বারা কারো কোন ক্ষতি হয়েছে, এমন উদাহরণ নাই । অন্য নেতাদের মত ‘কাইজ্জা’ লাগিয়ে ফায়দা লুটেন না । অন্য উকিলদের মত তিনি মামলা ঝুলিয়ে না রেখে, যে কোন সমস্যার এমনকি পারিবারিক ঝগড়া ঝাটির ঘটনাও আপোসে মীমাংসার চেষ্টা করেন । তিনি একজন পরম ধৈর্যশীল মানুষ । তাঁর এই ধৈর্যগুণ, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সততা, সরলতা, উপকারি মনোভাব, উদারতা, মানবপ্রেম, ভালবাসা, অসাম্প্রদায়িকতা আজ তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ আসনে আসীন করেছে । ইটনা, অষ্টগ্রান আর মিটামনের মানচিত্র তাঁর হৃদয়ের মণি কোঠায় আঁকা আছে । চোখ বন্ধ করে তিনি বলে দিতে পারেন, এলাকার কি সমস্যা, কি চাহিদা ? ‘আফালের তাফালিং’এ হাওর-গ্রাম ভাঙ্গণে ঢেউয়ের প্রতিটি আঘাত তাঁর হৃদয়ে লাগে । এই তিন উপজেলার এমন কোন গ্রাম, বাড়ি নাই, যেখানে তাঁর পদচিহ্ন পরে নাই, তাঁর উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে নাই । এমন কি তিনি সমগ্র জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন । কিশোরগঞ্জে, তাঁর বৈঠক খানাটি ছিল একটি মিলন কেন্দ্র, আশা-ভরসা স্থল । সকল শ্রেণীর, পেশার, মতের লোকের সমাগমে সরগরম থাকতো এটি । সর্বত্র তাঁর সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে । গভীর রাত পর্যন্ত চলা রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির সব কিছু আলোচনায় উঠে আসে । আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৮৪ সালে আমরা তিন বন্ধু রোকন, মকবুল এবং আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধের জন্য ফিশারি রোডে একটি মেসে থাকি ।
একদিন একজনকে কোন কারণে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় । আমরা ছুটে যাই, ভাটিবাসির ভরসা স্থল হামিদ সাহেবের বাসায় । সেদিন আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন । টেনশনে আমরা সে খবর জানতে পারি নাই । মধ্যরাত পর্যন্ত আমাদের সাথে বসে থেকে আব্দুল হামিদ তাঁকে মুক্ত করেন । ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে নৌকায় চড়ে প্রচারণাকালে দেখেছি, মাইকের শব্দে রাতে টর্চ আর কুপি হাতে মানুষকে ভালবাসার আকর্ষনে ছুটে আসতে। হাওরবাসির নিরন্তর সাপোর্ট এবং ভালবাসায় সিক্ত করে হাওরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বঙ্গভবনে, শিখর থেকে শিকড়ে-দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন । বিনিময়ে হাওরবাসি হাজার বছরের ইতিহাসে হাওর-ভাটির মাটির খাটি এবং যোগ্য সন্তান, তাঁদের পরম আপনজন, একজন রাষ্ট্রপতি হিসাবে এডভোকেট আব্দুল হামিদকে পেয়ে ধন্য হয়েছে । মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নামে করা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভূমিষ্ঠ প্রথম বাচ্চার নাম ‘আব্দুল হামিদ’ রাখা হয় । এতো জনগণের ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ । ভাটি বাংলার জনগণ সব সময় স্বাধীনতার শক্তির পক্ষে ভোট দিয়ে আসছে ।
ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বিপক্ষীয় শক্তি হাওরবাসিকে বঞ্চিত করেছে, বঞ্চিত করেছে তাঁদের কাংখিত উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে । কিন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে হাওরে, উন্নয়ন বৈষম্যের দীর্ঘদিনের উপোস নিবারণে কর্ম তৎপরতা পরিচালনা করে । শুরু হয় বিভিন্ন মূখী উন্নয়ন কার্যক্রম । প্রতিষ্ঠা করেন ‘হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড’ । ডেপুটি স্পিকার আব্দুল হামিদ এ সময় হাওরাঞ্চলে ‘ডুবা সড়ক’ এর এক অনন্য এবং ব্যতিক্রমধর্মী ধারণা তৈরীর মাধ্যমে যোগাযোগে এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। হাওরাঞ্চলের জন্য এটিই সহজ, সস্তা, পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের উপজেলা-ইটনায় ছিল না এক কিলোমিটার দীর্ঘ পাকা সড়ক । নামের সাথে স্থানের মিল ছিল। আর এখন সেখানে গাড়ীতে চড়ে আমার প্রিয় গ্রাম লাইম পাশার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। হাওরের চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগ, পরিবহণ বৃদ্ধি এবং বন্যা দেরী করবে এ সড়ক । এ ডুবা, ভুরা বা আভুরা সড়ক নির্মিত হওয়ায় হাওরাঞ্চলে যোগাযোগ এবং পরিবহণে যুগান্তরকারি পরিবর্তন ঘটেছে । অনেকে প্রথম বারের মত স্বচক্ষে, বাস্তবে রিক্সা দেখার সুযোগ পায় । আধুনিক যন্ত্রযান হাওরের বুক চিড়ে ছুটে চলে আব্দুল হামিদের জয় যাত্রার ঘোষনা করছে । উতপাদিত পণ্য পরিবহণে, বন্যা প্রলম্বিত হয়েছে ।
সংসদে হাওর উন্নয়নে তিনি সর্ব দলীয় কমিটি করেছেন । হাওরাঞ্চল জাতীয়ভাবে পরিচিতি এবং উম্ময়ন কার্যক্রমে গুরুত্ব পায় । হাওরবাসির মূখ উজ্জ্বল হয়েছে । বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হাওরাঞ্চলের অনেক জায়গায় প্রথম্ বারের মত বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে । বিদ্যুত সম্প্রসারণ কার্যক্রমও চলমান । ২০৩২ সালের মধ্যে হাওরের ৯০% গ্রাম বিদ্যুতের আওতায় আসবে । হাওরের মানুষের জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আরেক যুগান্তরকারি পদক্ষেপ হচ্ছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা । দ্বীপসম গ্রামগুলো অসংখ্য সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। স্বচ্চ মিঠা পানিতে ভাসমান গ্রাম গুলোতে সৌর বিদ্যুতের আলোর প্রতিছবি এক অপরুপ মন মুগদ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা করে । বিদ্যুত বা সৌর বিদ্যুতের সংযোগ কৃষি পণ্য উতপাদন ব্যয় ও ক্ষতি হ্রাস, খাদ্যের গুণাগুণ অক্ষুন্ন রাখা, পণ্যের ভ্যালু এডেড এবং বহুমূখীকরণের সুযোগ বৃদ্ধি করবে । মোবাইলের দাম ও রিচার্জ কমানোর সাথে সৌর বিদ্যুত সংযোগ হাওরবাসিকে যোগাযোগ নেট ওয়ার্কে সহজতরভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে । হাওরাঞ্চল বাসির জীবনে ছন্দ, আধুনিক জীবন যাত্রার ছোঁয়া ও স্বাচ্চন্দ পেয়েছে । চোখ মেলে দেখার সুযোগ হয়েছে, পৃথিবী কত সুন্দর, কত বড়, কত বিচিত্র ও কর্মময় । পথ দেখিয়েছে মানুষকে প্রগতির পথে, উন্নয়নের সাথে, প্রবেশ করেছে গ্লোবাল ভিলেজে ।
সুদিনে (শুস্ক মৌসুমে) দিগন্তজোড়া সবুজ পতিত গো-চারণ ভূমি ‘গো পাট’, বর্ষায় সমুদ্রসম স্বচ্চ কালো জলরাশি, ছ’মাস কাজ, ছ’মাস বেকার-এ হচ্ছে হাওরাঞ্চলের চিত্র । স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার জার্মানী হতে বিশেষ বিমানে করে হাজার হাজার সেচের পাম্প এনেছিল। তখনকার তরুণ এম পি আব্দুল হামিদ এর সিংহভাগ হাওরাঞ্চলের জন্য বরাদ্দ এনে বিএডিসির মাধ্যমে সরবরাহ করেছেন; ইরি ধানের বীজ, কলের লাঙ্গল, সার, ফ্রি কীটনাশক বিতরণ, আর বিমান থেকে কীটনাশক ছিটানোর ফলে হাওরাঞ্চলের পতিত ‘গো-পাট’ হয়ে উঠে সবুজ শ্যামল ‘শস্য ভান্ডার’। হাওর এলাকা পরিণত হয় ‘খাদ্য উদ্ধৃত অঞ্চল হিসাবে । হাওরবাসির ‘ছনের ঘর’র জায়গায় তৈরী হয়েছে চকচকে রঙিণ ঝিলিক দেয়া রুপালি টিনের দ্বোচালা-ঘর । অনেকেই তখন ‘লাখপতি’ বনে গিয়েছিল। হাওরবাসির এই যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, তার পিছনে ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের সর্বোকনিষ্ঠ এম পি আব্দুল হামিদের নিরলস শ্রম আর একাগ্রতা । এ অতিরিক্ত খাদ্য হাওর এলাকায় সংরক্ষণে খাদ্য গোদাম, সাইলো নির্মাণ অপরিহার্য । সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সীমানা মেনে বাঁধ নির্মাণ করত । ভাটিতে অবস্থিত আমাদের এলাকা অরক্ষিত থাকত, ফসল তলিয়ে নিত। আমার আফসোস আর দুঃখের শেষ ছিল না । ফলে ফসলহানি ছিল নিত্য ঘটনা । এ অবস্থা থেকে নিস্কৃতি পেতে তিনি কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছেন ।
হাওর, ভাটি বাংলার প্রতি আব্দুল হামিদের আগাধ ভালবাসা তাঁর জীবনের পরতে পরতে কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ গড়ার সাথে হাওরের উন্নয়নেও তিনি আত্ননিয়োগ করেন । হাওরের আরেক কৃতি সন্তান, জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে মিলে তিনি ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠণে সত্রিয় ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন । একদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডেকে বললেন, সবাই তো মন্ত্রি, মিনিস্টার, গভর্ণর হচ্ছে, আরো কত কিছু চাচ্ছে । তুমি কি চাও ? আব্দুল হামিদ ভাবলেন, বয়সে আমি সর্বোকনিষ্ট, অভিজ্ঞতাও তেমন নাই। তিনি তাঁদের কর্তক প্রতিষ্ঠা পেতে যাওয়া ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ এর প্রধান কার্যালয় কিশোরগঞ্জে স্থাপনের আবদার করলেন । বঙ্গবন্ধু তাঁর আবদার রাখলেন। আর কিশোরগঞ্জে ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ এর প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে ‘হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড’ পুনঃগঠন করেন । দ্বিতীয় মেয়াদে হাওর উন্নয়নে ২০১২ সালে প্রায় ২৮ জাহার কোটি টাকার ‘হাওর মাস্টার প্লান’ প্রণয়ন করেন । আব্দুল হামিদ আবারও স্পিকার মনোনীত হয়। চলতে থাকে বহুমূখী উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে হাওরবাসির ভালবাসার প্রতিদান । জিও, এনজিও’র উন্নয়ন মূখী প্রায় সব স্রোত হাওর মূখী হয় । উন্নয়নের প্রথম শর্ত হল-বিদ্যুত সংযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পুঁজি এবং দক্ষ জনশক্তির । জননেতা আব্দুল হামিদ এ কষ্টসাধ্য মহা যজ্ঞ আয়োজনের চেষ্টা করছেন । ‘মরার আগে আমি গাড়িতে চড়ে জন্মভূমি হতে ঢাকা যেতে চাই’ এমনই ইচ্ছা পূরণে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ শুরু করেন হাওর যোগাযোগে আরেক নতুন ধাপ ‘আভুরা সড়ক’ তৈরীর কাজ । এ ‘আভুরা সড়ক’কে কেন্দ্র করে হাওরাঞ্চলে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হবে বলে আমার ধারণা । ‘আভুরা সড়ক’ এর চারিদিকে গ্রাম সৃজন, মতস্য খামার, বিনোদন ও কর্মসংস্থানের মহা কর্ম যজ্ঞ শুরু হবে । আমার ব্যক্তিগত মত হল ‘আভুরা সড়ক’ আন্তঃগ্রাম (Inter village communication) না হয়ে অন্তঃগ্রাম (Internal village communication) হতে পারে । আন্তঃগ্রাম যোগাযোগ হবে ‘ডুবা সড়ক’র মাধ্যমে । মাহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে নদী পারাপারের/ঘাটের হয়রানী মূলক ‘টোল’ আদায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো খননের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাঁর কারণেই হাওরের সমস্যা ও সম্ভাবনা জাতীয়ভাবে গুরুত্ব পায়। আগামী দিনের ‘খাদ্য ভান্ডার’ হিসাবে হাওরকে গড়ে তুলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগ কর্তৃক শুরু করে হাওরে বিভিন্ন উন্নয়ন আর আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মযজ্ঞ । হাওর ভূমিপুত্র থিসাবে খ্যাত কৃষি প্রকৌশলী ড নিয়াজ পাশার করা আবেদনের প্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নির্দেশে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । হাওরের বিভিন্ন এলাকায় এর গবেষণা কেন্দ্র থাকবে । হাওর নিয়ে গবেষণার এটাই প্রথম কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠান । হাওরের অমিত সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন্মূখী কার্যক্রম বাস্থবায়নে সঠিক নির্দেশণা দেবে এ ইনস্টিটিউট । আব্দুল হামিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এগুলো হল দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়নের মৌলিক প্রতিষ্ঠান । হাওর মতস্য গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজও অনেক দূর এগিয়েছে । এখন দরকার বারি’র (BARI) একটি আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন । তিনি যখন বলেন, ‘আমার পিতা একজন কৃষক, আমার ছেলে একজন কৃষিবিদ, আর মাঝখানে আমি …’। এ কথার মাধ্যমে কৃষির প্রতি তাঁর মমত্ব বোধের পরিচয়ই বহণ করে।
‘আমার হাওরে বছর হয়- ছ’মাসে’, ‘কোন উন্নয়ন কাজ শুরু করতে করতে বর্ষা এসে যায় । বর্ষার ছ’মাসে কাজের অভাবে হাজার হাজার লোক দেশান্তির হচ্ছে । সারাদেশে জনসংখ্যা বাড়লেও হাওরে তা এ কারনে কমছে’ । শিকড়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত মানুষের পক্ষ্যেই এ উপলব্দি সম্ভব । চোখ বন্ধ করলে এখনো তিনি সোদা মাটির গন্ধ এবং আকাশের ঈশাণ কোণে মেঘ জমলে তিনি ‘আফালের আফালিং’এর শব্দ শুনিতে যে পান । তাঁর কর্মী বাহিনী এবং সংগঠকদের সাথে তাঁর আত্নীক বন্ধন, খোঁজ খবর নেন, সহযোগিতা করেন । তিনি আব্দুল হামিদ, আপাদ মস্তক রাজনীতিবিদ, খাটি ‘ভাইট্টা’ মানুষ । রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এ আক্ষেপ নিবারণে ‘হাওর ইপিজেড’ এবং ‘হাওর আইটী পার্ক’ স্থাপন জরুরি । ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং আয় বর্ধনশীল কাজে নিয়োজিত রাখাই অভিবাসি স্রোত রুখতে পারে । নদী খননকৃত মাটির টিবিতে ইপিজেড (EPZ), আইটি পার্ক বা ‘বিসিক শিল্প নগরী’ স্থাপন করা যেতে পারে । সে জন্য বিদ্যুত এবং সৌর বিদ্যুত উতপাদন প্লান্ট স্থাপন জরুরি । দেশে উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৯০% আহরিত হয় হাওরের চারিপার হতে। এ গ্যাস হাওরের বুক চিড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। জন্মভূমির উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ একজন আব্দুল হামিদের পক্ষ্যেই গ্যাস সংযোগ দাবী করে রসিকতার ছলে বলা সম্ভব-‘ফুটো করে হলেও গ্যাস সংযোগ নেয়া হবে’। হাওর থেকে সারা দেশে নির্মাণ সামগ্রী পাথর, বালু, কয়লা, ধান ও মাছ সরবরাহ করা হয় । জাতীয় বাজেটে হাওরের যে অবদান, হাওর উন্নয়নে তার সিকি ভাগও বরাদ্দ ছিল না । এডভোকেট আব্দুল হামিদ হাওরকে তার যথাযথ প্রাপ্য অংশিধারিত্ব, মর্যাদা ও সম্মান আদায়ে সরব রয়েছেন । সারা দেশে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তাঁর নামটি উচ্চারিত হয় । তাঁর মাধ্যমেই দেশবাসি হাওরকে চিনেছেন । হাওরের সমস্যা এবং সম্ভাবণা ফোকাসে আসে। ২০১৪ মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর আতিয়ার রহমানের নের্তৃত্বে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক সমূহের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নিয়ে হাওরে ব্যাংকিং সম্মেলন করেছেন । বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প স্থাপন, মতস্য, কৃষি ঋন প্রবাহ বৃদ্ধি, দাদন থেকে কৃষককে বাচাঁনো তথা ব্যাংককে মানুষের দোড় গোরায় নিয়ে যাওয়াই এ সম্মিলনের উদ্দেশ্য ছিল । তিনি উন্নয়নমূখী সকল প্রতিষ্ঠান কে হাওর উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছেন । তাঁরই অংশ হিসাবে মিটামনে একটি সেনানীবাস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন সাহায্য, অনুদান, ভাতা, কাজের মাধ্যমে খাদ্য কর্মসূচী চালুর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা হয়েছে । সার্বিক উন্নয়নের ফলে হাওরে এখন ভিক্ষা নয়, ভিক্ষুকের অভাব পরিলক্ষিত হয় । শ্রমিকের অভাব পূরণে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতেই হবে । আর সে লক্ষ্যেই সরকার ২৫% ভূর্তকী মূল্যে ধান কাটা, রোপন যন্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। হাওর সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে । ‘ভাল বীজে ভাল ফসল’ এর জন্য হাওর এলাকায় কয়েকটি ‘বীজ উতপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ’ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির সুনজর কাম্য।
লেখা পড়া করতে আমরা যখন কিশোরগঞ্জে আসি, আমাদের ‘ভাইট্টা গাবর’ আর ভৈরব-আশুগঞ্জে গেলে ‘উত্তইরা ভুত’ বলে উপহাস করা হত। এমনই ভাবে হাওরবাসির মনে পুষে রাখা দুঃখের কথা প্রকাশ করেন ভাটির দরদী মানুষ, তাঁদের আপনজন এডভোকেট আব্দুল হামিদ । এ ক্ষেদ দূরীকরণে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় গড়ে তুলেন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । একটা সময় ছিল যখন মানুষ ‘ভাইট্টা’ হিসাবে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করত, এখন অন্যরাও ‘ভাইট্টা’ ‘সাইজ্জা’ যায় । এ অবস্থান তাঁর সৃষ্টি । স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন এবং এ শিক্ষাকে অবৈতনিক করে শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য অবারিত করে দেন । হাওরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পরে । আগে যেখানে গুটি কয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, তাঁর ছোঁয়ায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাব বিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে । অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বিশেষ করে নারী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে । সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাওরবাসি তাঁদের অবস্থান সুদৃঢ করেছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে । তাঁর নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলা সদরের কলেজকে সরকারিকরণ করেছেন, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে । সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা কে হাওরের ঢৈউ এর ভয়াবহ ভাঙ্গণ হতে রক্ষায় প্রতিরক্ষা দেয়াল এবং ভবন পাকা করে দিয়েছেন । মসজিদ, মন্দির উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন । ইটনা, অষ্টগ্রাম আর মিটামনে, প্রত্যেক উপজেলায় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একটি ছেলেদের এবং একটি মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ আবাসিক কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এখন সময়ের দাবী । স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুব্যবস্থাও দরকার । শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্য একটি ঘূর্ণায়মাণ শিক্ষা তহবিল গঠন করা যেতে পারে । শিক্ষার্থীরা এ ট্রাস্ট থেকে তাঁর প্রাপ্ত বৃত্তির সম পরিমাণ বা ততোর্ধ অর্থ কর্ম ক্ষেত্রে গিয়ে ট্রাস্টে ফেরত দিতে অঙ্গীকার বদ্ধ থাকবেন । কিশোরগঞ্জ শহরে ভাটিরসহ অন্য সব শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য কয়েকটি হোস্টেল নির্মাণ; বিশেষ করে ঐতিহাসিক ইসলামিয়া হোস্টলকে বহুতল বিল্ডিং বিশিষ্ট ছাত্রাবাসে রুপান্তর করার প্রস্তাব করছি । হোস্টেলটির নামকরণ মহামান্য রাষ্ট্রপতির নামে হতে পারে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং চাকুরি ক্ষেত্রে পাহাড়ীদের মত হাওরাঞ্চল শিক্ষার্থীর বিশেষ কোটা সমতা এবং ন্যায্যতার জন্যই দরকার । হাওরবাসির ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন মাহামান্য রাষ্ট্রপতি, ভালবেসেই কাজের মধ্যমে তিনি তার প্রতিদান দিতে চেষ্টা করছেন। তাঁর ধ্যান, ধারণা, চিন্তা ও চেতনায় সার্বক্ষণিক হাওরের উন্নয়ন ভাবনা ।
হাওরাঞ্চলের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে- বর্ষাকালে মৃত মানুষকে কবরস্ত বা দাহ করার মত শুকনো জায়গার অভাব । আমাদের গ্রাম-লাইম পাশায় ‘আগলা জায়গায়’ এমন একটি কবরস্থান ছিল, যা বর্ষার প্রচন্ড ঢৈঊ ভেঙে যেত । বাঁশ, চাইল্লা ঘাস দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা হত প্রতি বছর । ’৭০ সালের নির্বাচনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে । মিছিলের আগে আগে গলা ফাটিয়ে চোঙা ফুকিয়ে আমরা ক্ষুদে কর্মী বাহিনী শ্লোগান দিয়েছি, ‘রব-হামিদ’র নৌকা, গেছে গা, গেছে গা’; হামিদ ভাই এর সালাম নিন, নৌকা মার্কা ভোট দিন’ ইত্যাদি । নির্বাচনে ‘বাঘ মার্কা’ নিয়ে কে একজন দাঁড়িয়েছেন । তিনি গ্রামের মুরুব্বীদের প্রস্তাব দিলেন, কবরস্থানের ঢেউ প্রতিরক্ষা দেয়াল পাকা করা বাবদ ‘আড়াই হাজার টাকা’ দিবেন, ভোট তাঁকে দিতে হবে । কিন্ত এলাকার তরুণ ছাত্র সমাজ বেকে বসলো । ভোটের শেষে দেখা গেল ‘মুরুব্বী’ ছাড়া সব ভোট নৌকায় পরেছে । আমাদের হামিদ ভাই, দেশের সর্ব কণিষ্ঠ এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তিতে হামিদ সাহেব সেই কবরস্থান বার লক্ষ টাকা খরচ করে ‘প্রটেকশান ওয়াল’ নির্মাণ শেষ করেছেন । তেমনিভাবে তিনি হাওরবাসির শেষ ঠিকানা অনেক ‘কবরস্থান বা শ্মশান ঘাট’ পাকা করে একটি অতি প্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধান করেছেন । অন্য প্রার্থীদের মত হামিদ সাহেবকে টাকা খরচ করে নির্বাচন করতে হয় না । সব নির্বাচনী খরচ এলাকা ভিত্তিক জনগণই বহণ করে । এতে তাঁরা আনন্দ, সম্নাণীত এবং গৌরব বোধ করে । এভাবেই হাওরবাসি তাঁকে সাত বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছে।
হাওরবাসির প্রতি জনাব আব্দুল হামিদ আল্লাহর রহমত স্বরুপ । আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে বঞ্চিত হাওরবাসির কল্যাণে অনেক উন্নয়ন কাজ করিয়েছেন । স্বজাতি এবং জন্মভূমির প্রতি ভালবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় নজীর সৃষ্টি করলেন। আব্দুল হামিদের মত সরব, জনসম্পৃক্ত এবং জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি এর আগে বঙ্গভবনে আর আসে নাই। তাঁর সৃষ্ট কর্মের জন্য, তাঁর কর্মের মাধ্যমেই তিনি হাওরবাসির হৃদয়াকাশে ঝলমল করে উজ্জল থেকে উজ্জলতর হয়ে ধ্রুব তারার মত আলোক বর্তিকা হিসাবে চির ভাস্কর থাকবেন-ভাটির মাটির খাটি সন্তান আব্দুল হামিদ ।
ড নিয়াজ পাশাঃ কৃষি প্রকৌশলী ও হাওর ভূমিপুত্র । সাবেক ভিপি, ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ, বাকৃবি, ময়মনসিংহ; সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টার, ঢাকা ১২১৫ ।
Posted ১২:০৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed