আদম মালেক | বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | প্রিন্ট | 749 বার পঠিত
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে চরম অসঙ্গতি। প্রতিবেদনে বিতরণকৃত ঋণের তুলনায় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছে সুদ আয়। এদিকে সুদ ব্যয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লংঘন করে বেড়েছে ৪গুণের অধিক। এজন্য তহবিল ব্যয়ও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে আমানতের প্রবৃদ্ধির তুলনায় সুদ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ৮গুণ। অস্বাভাবিক সুদ ব্যয়ে সন্দেহপোষণ করছেন বিনিয়োগকারীরা। তাছাড়া বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকটির বিনিয়োগকৃত অর্থও দীর্ঘদিন যাবৎ ফেরত আসছে না। এসব অর্থ আর কখনো ফেরত আসবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এমন গুরুতর অনিয়ম পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শওকত জামিলকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফারুক আহমেদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, আমি এখন ব্যস্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অডিট টিমের সঙ্গে মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলবো।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ইউনাইটের কমার্শিয়াল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এখানে যেমন অনেক অসত্য ও বিকৃত তথ্য এসেছে, তেমনি অনেক তথ্য গোপন করাও হয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তিন হাজার ৩৬২ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে, যার প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ। একই সময়ে ঋণ ও অগ্রিম বেড়েছে দুই হাজার ৮০৬ কোটি (প্রবৃদ্ধি-৯.৫২ শতাংশ) টাকা। আমানতের তুলনায় ৮৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ ঋণ প্রদান করেছে ব্যাংকটি। কিন্তু আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির চার হাজার ৯১ কোটি টাকা দেনা আছে বলে এক বিনিয়োগকারী বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণপূর্বক উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ঋণ ও অগ্রিমের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। একই সময়ে সুদ আয় বেড়েছে ৫৬৮ কোটি টাকা, যার প্রবৃদ্ধি ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অতিমাত্রায় সুদ আয় বৃদ্ধিতে বিস্মিত বিনিয়োগকারীরা। তাই তারা সুদ আয় বৃদ্ধির অন্তর্নিহিত কারণ জানতে চেয়েছেন।
প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিনিয়োগকারীরা বলেন, ২০১৯ সালে সুদ আয়ের প্রবৃদ্ধি ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কিন্তু এ সময় সুদ ব্যয় ৪৮৩ কোটি টাকা, যার প্রবৃদ্ধি ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এজন্য তহবিল খরচ ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সুদ আয়ের তুলনায় সুদ ব্যয় বৃদ্ধিতে ব্যাংকটির তহবিল ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
২০১৯ সালে স্থায়ী আমানত গেল বছরের তুলনায় বেড়েছে এক হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা যার প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। অথচ এ সময় স্থায়ী আমানতের সুদ ব্যায় ৬৫৮ কোটি টাকা থেকে ৪৮৩ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা যারা প্রবৃদ্ধি ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশ। স্থায়ী আমানত প্রবৃদ্ধির তুলনায় সুদ ব্যয়ের প্রায় ৮গুণ প্রবৃদ্ধিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা।
২০১৯ সালে চলতি কর ৪২ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২৭৮ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালের পরিচালন আয়ের ৩১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে উঠে ৩৩ দশমিক ৫৭ শতাংশে। কিন্তু ডেফার্ড ট্যাক্স ২০১৮ সালে যেখানে ১৭ দশমিক ৯০ কোটি টাকা যোগ হয়েছিল, সেখানে ২০১৯ সালে তা ৬২ কোটি টাকা বিয়োগ হয়েছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এমনকি অলৌকিক ঘটনা ঘটলো যে, ডেফার্ড ট্যাক্স ৭৯ কোটি ৯০ লাখ (১৭.৯০+৬২) টাকার ব্যবধান গড়ে দিলো, যা বিনিয়োগকারীদের মাঝে জিজ্ঞাসা তৈরি করে।
এদিকে ৭৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার ব্যবধানের কারণে চলতি কর ৪২ কোটি টাকা বাড়লেও মোট কর প্রভিশন ৩৮ কোটি টাকা কমেছে। ফলে নিট প্রোফিট বেড়েছে ৪০ কোটি টাকা। ইপিএস ২ টাকা ৪ পয়সা থেকে বেড়ে ২ টাকা ৩৯ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। এতে লাভ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখালেও তা নিয়ে স্বস্তিতে নেই বিনিয়োগকারীরা।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পাঁচটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে বিনিয়োগকৃত ৬০ কোটি টাকা আাদায় হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বিনিয়োগকারীরা। তাছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ৬৫ কোটি টাকা, ম্যারিডিয়ান ফাইন্যান্সে ২৫ কোটি টাকা ও বে-লিজিংয়ে বিনিয়োগকৃত ১০ কোটি টাকা ও ঝুঁকপূর্ণ বলে তারা মনে করছেন।
এদিকে ব্যাংকটিতে ক্রমেই বাড়ছে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ। ২০১৯ সালে অবলোপনকৃত ২১১ কোটি টাকাসহ মোট অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। আরো খেলাপি আছে এক হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। সর্বমোট তিন হাজার ২৪০ টাকার খেলাপিতে উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা। তছাড়া ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিনিময়ে ৫৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে অশ্রেণিকৃত করা হলেও ওই ঋণের মান উন্নয়ন হয়নি বলে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ই্উসিবির বার্ষিক প্রতিবেদনে নানা অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বিনিয়োগকৃত ঋণের তুলনায় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয় সুদ আয়। এদিকে সুদ ব্যয় আরো বেশি দেখিয়েছে। প্রতিবেদনে আমানত প্রবৃদ্ধির তুলনায় সুদ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮গুণ বেশি দেখানো হয়েছে, যা অস্বাভাবিক।
Posted ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy