| বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ ২০২০ | প্রিন্ট | 946 বার পঠিত
অবশেষে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এর আগে অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত কোম্পানির ম্যানেজমেন্টসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার দফায় দফায় জবানবন্দি নেয় অনুসন্ধানী টিম। শেষমেষ পুনঃবীমার নামে বিদেশে অর্থপাচার এবং প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে খরচের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এক্ষেত্রে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ বিভিন্ন আয় থেকে যেমনিভাবে ফাঁকি দেয়া হয়েছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের লভ্যাংশ থেকে। এছাড়াও সিইও মোহাম্মদী খানমের বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টিও তদন্তে প্রমাণিত হয়। তবে ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা গোপনের বিষয়টি সুরাহা পারেনি তদন্তকারী দল। এ জন্য সময়ের স্বল্পতাকে দায়ী করলেও জানা যায়, মূলত দক্ষ হিসাব বিশেষজ্ঞ না থাকায় তদন্তটি করতে ব্যর্থ হয় তারা। যা সংস্থাটির দুর্বলতাকেই প্রকট করে।
জানা যায়, প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, মানি লন্ডারিং, সিইও’র অর্থ আত্মসাৎ করাসহ মোট নয়টি বিষয়ে গত ৭ জুলাই ২০১৯ তারিখে আইডিআরএ’র কাছে লিখিত অভিযোগ দেন সাংবাদিক ও বিনিয়োগকারী মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান। এরপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে (যার স্মারক নং- ৫৩.০৩.০০০০.০০৯.২৭.০০৯.১৮.১২১) গত ২২ জুলাই ২০১৯ তারিখে যুগ্ম সচিব ছিদ্দিকুর রহমানকে আহ্বায়ক ও জুনিয়র অফিসার হামেদ বিন হাসানকে সদস্য করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।
অনুসন্ধান চলাকালে প্রাইমের সাবেক সিইও মোহাম্মদী খানম নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বরাবর চিঠি প্রেরণ করেন। যেখানে অভিযোগকারীকে হেয়প্রতিপন্ন করে তদন্ত কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা আমলে না নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস অনুসন্ধান চালিয়ে এবং অভিযোগকারী ও অভিযুক্তদের জবানবন্দি নিয়ে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে নিয়ম ভেঙে বিদেশে রি-ইন্স্যুরেন্স করার দালিলিক প্রমাণাদি পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। যা বীমা কর্পোরেশন আইন ২০১৯-এর ধারা ১৭-এর লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে কোম্পানি চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদ, সিইও মোহাম্মদী খানম ও পুনঃবীমা বিভাগের প্রধান সুজিত কুমার ভৌমিককে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে কমিটি। তাদের যোগসাজশেই আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি সংঘটিত হয়। এ বিষয়ে বীমা কর্পোরেশ আইন ২০১৯-এর ধারা ১৮ এবং বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ১৩০ ও ১৩৪ অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করতে সংস্থার কাছে সুপারিশ জানায় তদন্ত কমিটি। উল্লেখ্য, দেশের বাইরে রি-ইন্স্যুরেন্স করার এজেন্ট কমিশনের টাকা তৎকালীন সিইও মোহাম্মদী খানম নিজেই নিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিশ্বস্ত সূত্র।
অপরদিকে মুদ্রা পাচারের বিষয়টিও সত্য বলে প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়। যেখানে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট তথা চেয়ারম্যান, সিইও এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনুসন্ধানী টিমের প্রতিবেদন মতে, কোম্পানি ম্যানেজমেন্টের যোগসাজশে সিইও’র চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএমডি সৈয়দ মনিরুল হক তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে (নং- ১১৬১০১০২৬১৭০৬, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, গুলশান শাখা) কোম্পানির টাকা ট্রান্সফার করেন। গত ১৯ আগস্ট ২০১২ থেকে ৩০ জুন ২০১৭ পর্যন্ত এই হিসাব নম্বরে তিনি প্রায় ২ কোটি ৩৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৭০ টাকা লেনদেন করেছেন। যা অনৈতিক, বেআইনি এবং কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সার্কুলার নং- ৩২/২০১২-এর লঙ্ঘন বলে মত দেন অনুসন্ধান কমিটি। এই টাকা লেনদেনের বিষয়ে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন ম্যানেজমেন্ট জানতো বলে জানা যায়। তৎকালীন সিইও মোহাম্মদী খানমের এ সংক্রান্ত একটি গোপন চিঠিও তদন্ত কমিটির হাতে পড়ে। ফলে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট তথা চেয়ারম্যান, সিইও এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ১৩০ ও ১৩৪ মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে কমিটি।
এই অনিয়মের বাইরে সিইও মোহাম্মদী খানমের কোম্পানি তহবিল থেকে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় আইডিআরএ’র অনুসন্ধান কমিটি। এক্ষেত্রে কোনো লিখিত প্রমাণাদি না পেলেও জেরার মুখে বিষয়টি স্বীকার করে কোম্পানি সচিব এনামুল হক খান। এ থেকেই বোঝা যায়, অপকর্মে কতটা পারদর্শী প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজমেন্ট। অবশ্য গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজের সৌজন্যেই এগুলো সংঘটিত হয়েছে তা স্বীকার করতে হবে।
এসব বিষয় জানার পরও বোর্ড চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদ সিইও মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ফলে কোম্পানি টাকা হাতিয়ে সহজেই সটকে পড়ার সুযোগ পায় মোহাম্মদী খানম। তাছাড়া গত ২৭ ফেব্রæয়ারি ২০১৯ তারিখে পদত্যাগ করলেও এক্ষেত্রে তারিখ দেখানো হয়েছে ২৫ জুলাই ২০১৯। অর্থাৎ ৫ মাসে অতিরিক্ত ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেতন বেশি দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে মোহাম্মদী খানম মোট ৩৯ লাখ টাকা বেশি গ্রহণ করেছেন কোম্পানি তহবিল থেকে। অথচ ২৭ জুলাইয়ের পদত্যাগপত্রেও ২৫ ফেব্রæয়ারি ২০১৯ তারিখে পদত্যাগের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এক্ষেত্রে কোম্পানি চেয়ারম্যানের পরোক্ষ ইন্ধনে অ্যাডমিন প্রধান আমিন উদ্দীন উক্ত ২৭ ফেব্রæয়ারির পদত্যাগপত্রটি সরিয়ে ফেলেছেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা।
এদিকে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের আর্থিক অনিয়ম প্রকাশ হওয়ায় এবং লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করায় পরিচালনা পর্ষদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, আইডিআরএ’র তদন্তে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির এই সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির পেছনে চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদসহ ঊর্ধ্বতন ম্যানেজমেন্টের কতিপয় কর্মকর্তা জড়িত। তবে অপর একটি সূত্রে জানা যায়, চেয়ারম্যানের এতোসব অনিয়মের বিষয়ে জানার পরও তাকে সমর্থন জানাচ্ছে অপর দুই ক্লিন ইমেজধারী পরিচালক আলহাজ নজরুল ইসলাম ও এ জেড এম সাজ্জাদুর রহমান। সূত্র জানায়, উক্ত দুই পরিচালকের পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের কারণে কেউ তাদের বিরুদ্ধাচরণ করছেন না। আর তাদের মদদেই এতোসব অনিয়মের জালে নির্দ্বিধায় জড়াচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে গুঞ্জন উঠেছে, এসব অপকর্মে নিজের সম্পৃক্তটা গোপন করতে নির্ধারিত সময়ের আগেই মোহাম্মদী খানমের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বোর্ড চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদ। এছাড়া অপকর্মের দোসর সুজিত কুমার ভৌমিক ও সৈয়দ মনিরুল হকের বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয়াটিও সন্দেহজনক বলে মনে করছেন তারা। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, মোহাম্মদী খানমের পর এবার সুজিত কুমার ভৌমিকও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ইতিমধ্যেই তিনি প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষের কাছে তার পদত্যাগ জমা দিয়েছেন। তবে নিয়ম অনুযায়ী, বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব থেকে সরে যেতে পারেন না। ধারণা করা হচ্ছে, এক্ষেত্রে পরোক্ষ মদদ রয়েছে বোর্ড চেয়ারম্যানের।
এ বিষয়ে আব্দুল ওহাব নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, যেহেতু কোম্পানির এই অনিয়মে এখন পর্যন্ত বোর্ড অব ডিরেক্টরস কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, সেহেতু বোঝা যাচ্ছে চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় জাকিউল্লাহ শহীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে না তারা। তাই দ্রুত চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে প্রতিষ্ঠানটিকে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অন্য পরিচালকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
মিনহাজুল আবেদীন নামে অপর বিনিয়োগকারী বলেন, প্রতিষ্ঠানটির উন্নতির প্রধান অন্তরায় কোম্পানির চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদ, এমনটাই মনে করছি আমরা। ইতিপূর্বেও চেয়ারম্যানের নানা অনৈতিক ও অসামাজিক কার্যকলাপের বিষয়ে আমরা জেনেছি। তাই অবিলম্বে এই চেয়ারম্যানের অপসারণ চাই। অন্যথায় আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ এবং বিনিয়োগকারীদের অভিমত অনুযায়ী চেয়ারম্যানের অপসারণ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। অন্যথায় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন। এ বিষয়ে সকলকে ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ারও অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
Posted ৪:৪০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed