ব্রি. জে. জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি (অব.) | ২৫ মার্চ ২০১৯ | ১:৪৪ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বিভিন্ন প্রতিক‚লতার মধ্যেও ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে আর্থ-সামাজিক এবং আঞ্চলিক কূটনীতি ও বিদেশ-নীতিতে যথেষ্ট ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। ফলশ্রুতিতে একদিকে পশ্চিমাদের নিয়ে ভারত এবং অন্যদিকে চীন (দুই বৃহৎ প্রতিবেশী) উভয়েই ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহ-সম্পর্কের সকল বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। নিজের স্বার্থে বাংলাদেশকে ঋণ/বিনিয়োগ গ্রহণের এই ধারাকে অধিকতর সমন্বিত এবং বেগবান করতে হবে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক বহুমুখী এবং দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা আমাদের দেশে বিনিয়োগ এবং ঋণ প্রদানে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই রচনায় সাধারণভাবে চীনের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগ ও ঋণের বিভিন্ন দিক দিয়ে আলোচনা করা হবে।
বর্তমানে চীনের সাথে বাংলাদেশের বিনিয়োগ আছে ৩৮০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এই অর্থের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতামূলক অবকাঠামো প্রকল্পে ২৪৬৫ কোটি এবং যৌথ উদ্যোগী খাতে ১৩৬০ কোটি ডলার। এছাড়া ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং সফরের সময় ২০০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ও শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে। অবকাঠামো ও উৎপাদন খাতে চীনা বিনিয়োগ আবার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক এবং বিদেশ-নীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেলসহ ছোট-বড় প্রজেক্ট এলাকা ছাড়াও ঢাকার উত্তরা, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, ডিওএইচএস এলাকাসমূহ ও অন্যান্য শিল্পাঞ্চলসহ পুরান ঢাকার বাজার এবং অন্যান্য স্থানের সরকারি ও বেসরকারি অফিসে চীনাদের উপস্থিতি/যাতায়াত চোখে পড়ে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পাশাপাশি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার জন্য চীনে যাচ্ছে। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও বিভিন্ন বৈদেশিক কারণে উভয় দেশের মানুষের জন্য যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দিনে এই ধারা আরও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে চীনা বিনোয়োগ দিয়ে মতামত প্রদান করতে হলে সঙ্গত কারণে অন্যান্য দেশে চীনা বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশ কর্তৃক বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহকে মাথায় রাখতে হবে। বিশ্ব ব্যবস্থা বিশেষ করে অর্থনৈতিক বলয়ে দেশসমূহ মূলত দুই মেরু/ব্যবস্থায় যথা গণতান্ত্রিত (ভারতসহ পশ্চিমাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব) মেরু এবং সমাজতান্ত্রিক বা সমগোত্রীয় (চীনের নেতৃত্বে রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ) মের তে প্রতিযোগিতামূলক ও সাংঘাতিকভাবে বিভক্ত। ফলশ্রুতিতে একটি দেশে এক ব্যবস্থার বিনিয়োগ বা স্বার্থরক্ষা হলে আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে প্রেক্ষাপটে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও এই ঝুঁকি থাকাই স্বাভাবিক। আমরা জানি যে, চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নতি ও অর্জন অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তারা বিনিয়োগ আর ব্যবস্যা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে পৌঁছে গেছে। ফলশ্রুতিতে এইসব দেশে ক্রমাগতভাবে পশ্চিমা বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বৈষয়িক স্বার্থ প্রতিযোগিতামূলক ঝুঁকিপূর্ণ ও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
আমাদের পাশ্র্ববর্তী দেশ যথা- মায়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানেও প্রচুর চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে। চীন পাকিস্তানে ব্যাপক বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক কাজ শুরু করেছে। চীনের কাছ থেকে নেয়া পাকিস্তানের ঋণের পরিমাণ ৯১.৮ বিলিয়ন ডলার (তার মধ্যে প্রথমদিকে গৃহীত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ) তারা শুধুমাত্র চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরেই (CPEC সমুদ্র ও ভূমিতে ইউরো-এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য) ৬২ বিলিয়ন ডলার বাজেটে বিভিন্ন প্রজেক্ট/অবকাঠামো হাতে নিয়েছে। উল্লেখ্য যে, চায়নার ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ব বেল্ট এবং রোড প্রকল্পের (The Belt and Road Initive-BRI) আওতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। যার মধ্যে গোয়াদের (Gwader) পোর্ট, ক্যারোট বিদ্যুৎ স্টেশন (১.৪২ বিলিয়ন ডলার), লাহোর-মাটিয়ারি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন (২ বিলিয়ন ডলার ৬৬০ KV HVDC), করাচি সার্কুলার রেললাইন (জাপানি কোম্পানির পর চায়না গ্রহণ করেছে প্রায় ২.০৭ বিলিয়ন ডলার) এবং কারাকুরাম হাইওয়ে (১৩০০ কি.মি. রাস্তা, যা বর্তমানে চায়না-পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান একমাত্র স্থলপথে যোগাযোগের মাধ্যম), ইত্যাদি অন্যতম পাঁচটি প্রকল্প যা CPEC-এর দ্বিতীয় পর্যায়ে (৫৭ বিলিয়ন ডলার) গ্রহণ করা হবে। শুরুতে ৪৬ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলন ধরা হলেও ২০১৭ সাল নাগাদ বৃদ্ধি পেয়ে এই পরিকল্পনা ৬২ বিলিয়ন ডলারে উন্নত হয়েছে। তার মধ্যে যানবাহন ব্যবস্থার আধুনিককরণে ১১ বিলিয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩৩ বিলিয়ন এবং পাইপলাইন নেটওয়ার্কে ২.৫০ বিলিয়ন ধরা হয়েছে। পরিকল্পনা মোতাবেক এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২.৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থান এবং শতকরা ২ থেকে ২.৫ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হবে। কিন্তু নিজস্ব এবং অন্যান্য দেশে চীনা বিনিয়োগের অভিজ্ঞতার আলোকে পাকিস্তান সরকার সম্প্রতি এই পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন এবং পুনর্বিন্যাস করে উৎপাদনমুখী প্রজেক্ট এবং ঋণশর্ত পরিবর্তনের ওপর জোর দিচ্ছে। তারা কিছু কিছু প্রজেক্ট বাতিলও করার পক্ষে। তবে বাস্তবায়তা হলো যে চীনের মতামত ব্যতীত পাকিস্তান কোনোভাবেই চীনের এই ঋণের ধারা থেকে বের হতে পারবে না।
সম্প্রতি চায়না বিনিয়োগ ও অনুদানের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে। তারা জাফনায় ৪০ হাজার বাড়ি (৩০০ মিলিয়ন ডলার); মধ্যাংশের উচুঁ ভ‚মিতে রাবার, চা ও নারকেল চাষে (৩০-৪০ মিলিয়ন ডলার); হাম্বানটোটা (Hambantota) উন্নয়ন এলাকায় (১ বিলিয়ন ডলার); কলম্বো পোর্ট সিটি প্রজেক্ট (১.৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০ বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে); Norochcholia কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প (১.৩৫ বিলিয়ন ডলার) ইত্যাদি প্রকল্পে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে, যা শ্রীলংকার দীর্ঘদিন থেকে চলমান ভারতীয় সামরিকসহ বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। উল্লেখ্য যে, ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ২০১৬ সালে চীনকে হাম্বানটোটা বন্দরকে ৮০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি (৯৯ বছর) লিজ দিতে বাধ্য হয়েছে। যা শ্রীলংকার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ভারতসহ অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। ফলশ্রুতিতে শ্রীলংকার নতুন সরকার চাইনিজ বিনিয়োগ ও অনুদানপ্রাপ্ত কিছু প্রজেক্ট বাস্তবায়নে দ্বিধান্বিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অনিচ্ছা সত্তে¡ও শ্রীলংকাকেও চীনা ঋণের বোঝা বহন করতে হবে।
নেপালে ভারতের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাসহ সকল ক্ষেত্রে প্রবল উপস্থিতির বিপরীতে চায়না আর্থ-সামাজিক ও বিনিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার শুরু করে। তারা ইতিমধ্যে জলবিদ্যুৎ, সিমেন্ট কারখানা, বিমানবন্দর, রেল ব্যবস্থাসহ সামগ্রিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে। ২০১৭ সালে দুই দেশে BRI চুক্তি সম্পাদন করে ইতিমধ্যে প্রায় ৩৯৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। ২০১৭ সালে চাইনিজ বিনিয়োগকারীগণ শুধুমাত্র পর্যটনসংক্রান্ত প্রজেক্টে ৮.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা হিমালয়ের মধ্য দিয়ে সরাসরি সংযোগ ব্যবস্থা রাস্তা (ট্যানেলসহ) তৈরিও করেছে। চাইনিজ বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে একদিকে ভারতীয় প্রভাব ও ব্যবসা-বাণিজ্য হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে গৃহীত বড় বড় প্রজেক্টের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থনৈতিক, অসচ্ছলতার কারণ বলে তারা ২.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থগিতও করেছে।
আমাদের অন্যতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের ওপর চাইনিজ প্রভাব দীর্ঘদিনের। মিয়ানমার BRI-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যা ২১ শতকের সামুদ্রিক সিল্করোড এবং সিল্করোড অর্থনৈতিক বেল্টের পরিপূরক বটে। সম্প্রতি চায়না বিনিয়োগ ও অনুদানের মাধ্যমে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক কর্মকণ্ড ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছে। ২০১৪ সালে তারা ২০ বিলিয়ন ডলারের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম হলো ১০ বিলিয়ন ডলারের কিয়া কিউয়ে (Kyauk Kyu) বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বঙ্গোপসাগরে কিয়া কিউয়ে সমুদ্রবন্দর ৭.৩ বিলিয়ন এবং শিলু পার্ক ২.৩ বিলিয়নের, মূলত পোশাক ও তেল শোধনাগার) যার ফলে লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রস্তাবিত চায়না-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরে ভৌতকাঠামো নির্মাণের অনেকগুলো প্রজেক্ট (Kwanlon ব্রিজসহ Chinshwehaw এবং Lashio শান প্রদেশের মধ্যে সড়ক ও রেলপথ, Chinshwehaw কে আন্তর্জাতিক সীমান্তসংযোগ ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ, দুই দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত কৃষি সহযোগিতা, Lashio এবং Lincang-এ পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি) প্রস্তাবনা প্রদান করে। চাইনিজ বিনিয়োগের ফলাফল নিয়ে মিয়ানমারেও যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। তারাও ইতিমধ্যে ৩.৯ বিলিয়ন ডলারের মিতসোনে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থগিত করেছে। কিন্তু চাইনিজদের চাহিদা মোতাবেক উক্ত প্রকল্পে ইতিমধ্যে খরচকৃত ৮০০ মিলিয়ন ডলার তাদের শোধ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তির সম্পূর্ণ টাকাই সরঞ্জাম কেনার খরচ দেখানোর ফলে মিয়ানমার কোনো টাকাই পায়নি। এসব কিন্তু চাইনিজ ঋণের আরেকটি দিক, যা সংশ্লিষ্ট দেশকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
ব্যাপক বিনিয়োগের উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বরে চাইনিজ প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপ ভ্রমণ করেন এবং মালে BRI-তে (একুশ শতকের Maritime সিল্করোড-MSR) সম্মতি প্রদান করে। তারা ইতিমধ্যে মালে, হুলুমালে ও বিমানবন্দরের দ্বীপত্রয় ব্রিজ ও রাস্তার মাধ্যমে (প্রায় ৮ কিলোমিটার) সংযোগ করে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ হাতে দিয়েছে। মালে থেকে প্রায় ৪৩৭ কি.মি. দূরবর্তী গাদহু (Gaduho – 1.850 X 0.580KM) দ্বীপের জনসাধারকে (২৯১০ জনকে) স্থানান্তরিত করে রাস্তাসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাদের মধ্যে বিমানবন্দর উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, স্বাস্থ্যখাতের সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করার সমঝোতা হয়েছে। মূলত অধিকতর চাইনিজ বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য ২০১৫ সালে জুলাই মাসে একটি বিল পাস করা হয় যে, যদি কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ৭০ শতাংশ জমি রিক্লেম করতে চায়, তবে তাদেরকে ঐ জমি দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেয়া হবে। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে মালদ্বীপের বৈদেশিক ঋণের ৭০ শতাংশই চায়না প্রদান করেছে। যার সুদ প্রদানের জন্য দেশের বার্ষিক বাজেটের এক-চতুর্থাংশ অর্থ খরচ করতে হবে। ভারতসহ পশ্চিম দেশসমূহের পাশাপাশি চাইনিজ ঋণ নিয়ে সে দেশে ইতিমধ্যে প্রচণ্ড বিরোধিতা শুরু হয়েছে।
উল্লিখিত ৬টি দেশ (বাংলাদেশসহ) ছাড়াও ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, (২০১৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশকে ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে) ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশসমূহে চাইনিজ বিনিয়োগ/ঋণ আছে। পাশাপাশি উগান্ডা, মোজাম্বিক, কেনিয়া. সুদান, জাম্বিয়া, কঙ্গো, মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, জিবুতি, জামাইকা, ক্যামেরুন, মালি ইত্যাদিসহ অধিকাংশ আফ্রিকান দেশেও (২০০০ সালে Forum on China-Africa cooperation-FOCAC করা হয়। ২০১৫ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলারের পর ২০১৮ সালে পুনরায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের; ১৫ বিলিয়ন ডলার অনুদান, সুদবিহীন ও স্বল্পসুদের ঋণ ২০ বিলিয়ন ডলার, ১০ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন ও ৫ বিলিয়ন ডলার আফ্রিকান সামগ্রী ক্রয়ের জন্যে ঋণ প্রদানের ঘোষণা করা হয়েছে) অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রদান করেছে। আবার প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট দ্বীপ যথা- পাপুয়া নিউগিনি (২০০ কোটি ডলার-দেশটির মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশ), টোঙ্গা (১ কোটি ১৫ লক্ষ ডলার- বার্ষিক জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ), ভানুয়াতু (মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি চীনা ঋণ), নাউরুং, তুভালু ইত্যাদি ছোট অর্থনীতির দেশগুলো সহজশর্তে ঋণ নিয়ে একদিকে তা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে তাইওয়ানের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নসহ বিভিন্ন বিষয়ে চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশ (ব্রাজিল-৫৪.৫৬ বিলিয়ন ডলার, পেরু- ১৯.৯৫ বিলিয়ন ডলার, আর্জেন্টিনিয়া-১১.১৪ বিলিয়ন ডলার, ইকুয়েডর-৭.৭২ বিলিয়ন ডলার ও ভেনেজুয়েলা), উত্তর আমেরিকার দেশ, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্র (শুধুমাত্র ২০১৬ সালে ৬৫টি চুক্তির আওতায় ৫১.১৯ বিলিয়ন ডলার), যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও চাইনিজ বিনিয়োগ ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের সকল দেশেই কম-বেশি চীনা বিনিয়োগ (অনুদান কিংবা ঋণ) হয়েছে। উল্লেখ্য যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীনেও পশ্চিমা দেশের বিনিয়োগ আছে।
চাইনিজ বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের অস্বস্তি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। অনেকের মধ্যে মিয়ানমার, শ্রীলংকা কিংবা আফ্রিকার দেশসমূহকে তারা যে শর্ত এবং যে ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, তা এসব দেশকে শুধুমাত্র আর্থ-সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই ফেলবে না, বরং অনেকের নিরাপত্তাসহ সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে। ঋণ শোধ করতে না পেরে তারা ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়বে। সে প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্লেষক বাই চাইনিজ ঋণকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকাণ্ডের সাথে তুলনা করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আফ্রিকার জিবুতিকে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জিবুতির ঋণের পরিমাণ ১.১ বিলিয়ন ডলার, যা পরিশোধের স্বপ্নও তারা দেখতে পারে না। ২০১৭ সালে আগস্টে চীন এ দেশে প্রথম বিদেশী সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। তদ্রুপভাবে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপকে ও চীনের সামরিক উপস্থিতি (মাঝে মাঝে) মেনে না নিতে হচ্ছে। পাকিস্তানেরও চীনা সামরিক উপস্থিতি মেনে না নেওয়ার বিকল্প দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। তারপরও সম্প্রতি পাকিস্তান ১৪ বিলিয়ন ডলারের Diamer-Bhasha বাঁধ প্রকল্প স্থগিত করেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়াও প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের চাইনিজ বিভিন্ন প্রকল্প স্থগিত/বাতিল করেছে। বাস্তবতা হলো যে, চীন শুধু বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক শক্তিই নয়, বরং তা দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। তারা বিভিন্ন দেশে প্রদত্ত অনুদান কিংবা বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও সার্বিকভাবে দেশের স্বার্থরক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক। বিদেশী সম্পদ বিনিয়োগ করে আরব দেশগুলোসহ অন্যান্য দুর্বল দেশের মতো ঝুঁকিতে তারা কেন থাকবে? উল্লেখ্য যে, পশ্চিমাদেশগুলো কিছু হলেই আরব দেশের বিনিয়োগ ফ্রিজ করে দেয়। অতএব সংশ্লিষ্ট দেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন কোন খাতে কি শর্তে কতটুকু চাইনিজ কিংবা অন্যদেশের বিনিয়োগ/ঋণ গ্রহণ করবে।
চাইনিজ বিনিয়োগ/ঋণ গ্রহণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের সুবিধা হলো আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত কারণে চীনের পাশাপাশি ভারতসহ অন্যান্য দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ভারত ইতিমধ্যে তিন দফায় মোট ছয় শত কোটি ডলার ঋণ করে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, অটোমোবাইলস, সিরামিক, কেমিক্যাল, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং, জেম ও জুয়েলারি, আইসিটি, হাসপাতাল (স্বাস্থ্যসেবা) ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি, ওষুধ প্রস্তুত এবং পোশাকসহ প্রায় ১৩টি খাতে পুনঃক্রয় (Buy Back / Re-Export) নীতিতে বড় ধরনের ভারতীয় বিনিয়োগ আশা করে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে এই ধরনের বিনিয়োগ আছে। হিরো হোন্ডা, টাটা, সিইএটি (CEAT) ইত্যাদি ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশেও ছোট ছোট বিনিয়োগ করেছে, যা ভবিষ্যতে আরো বড় আকারে হতে পারে। ভারত তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চাইনিজ ও ভারতীয় বিনিয়োগ/ঋণের সমন্বয় ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশের ভারসাম্য এবং দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক ও জাইকাসহ অন্যান্য দেশ ও সংস্থার বিনিয়োগকেও উৎসাহিত ও ব্যবহার করতে হবে। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ পশ্চিমা দেশের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে সৌদিআরবের সাথে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের একটা সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। সম্প্রতি (মার্চ, ২০১৯) দুইজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা সৌদি প্রতিনিধিদল প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করেছে। বাংলাদেশের এইসব সম্ভাবনারও পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো যে, বাংলাদেশ কোন কোন খাতে কতটুকু ঋণ ও বিনিয়োগ গ্রহণ করবে? সরকারি পর্যায়ে বর্তমানে গৃহীত ঋণের অধিকাংশই অবকাঠামো খাতে নেয়া হয়েছে। এসব ভৌতকাঠামো নির্মাণের পর যদি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক সুবিধা না আসে (যা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার) তবে আমাদেরও শ্রীলংকা, জিবুতি কিংবা পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো অবস্থায় পড়তে হবে। বিদেশী বিনিয়োগ/ঋণ গ্রহণের সময় মনে রাখতে হবে যে, আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি হলেও তা এখনো মাত্র দুইটা সেক্টরের (বৈদেশিক কর্ম-মানবসম্পদ ও পোশাকশিল্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টর) ওপর নির্ভরশীল। সেজন্য অবকাঠামো উন্নয়নে যতটুকু দরকার তা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে গ্রহণপূর্বক কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীল খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈদেশিক ঋণও বিনিয়োগ গ্রহণ করতে হবে। গ্রহণযোগ্য শর্তে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপগুলোর স্থায়িত্ব প্রদান ও উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করে গৃহীত ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
চীনা ঋণ গ্রহণের সময় আর্থ-সামাজিক উন্নতি বনাম ঋণের ফাঁদে পড়ায় ঝুঁকিসহ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ রাখার মধ্যে কার্যকরী সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। ঋণের শর্ত এবং প্রকল্পগুলো আমাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ধারণ করতে হবে। গৃহীত ঋণের পরিমাণ অবশ্যই আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে মধ্যে হতে হবে।
লেখক: উপদেষ্টা, ব্যাংক বীমা অর্থনীতি
বাংলাদেশ সময়: ১:৪৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৫ মার্চ ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed