বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডলারের উত্তাপে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা

পান্না কুমার রায় রজত   |   সোমবার, ২৫ অক্টোবর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   651 বার পঠিত

ডলারের উত্তাপে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা

জ্বর ব্যাধি নহে, ব্যাধির লক্ষণ। কিন্তু জ্বর বাড়লে প্রকৃত চিকিৎসার পাশাপাশি উত্তাপ কমানোর জন্য ঔষধ দিতে হয়। ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাগত মূল্যহ্রাস বিষয়টি উদ্বিগ্নের কারণ। গত ২২ আগস্ট ৮৫ টাকা ১০ পয়সা হারে ডলার বিনিময় হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক এদিন ৮৭ টাকা ১০ পয়সা হারে ডলার বিক্রি করেছে এবং খোলাবাজারে ৮৭ টাকা ৮০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি হয়েছে।

ব্যাংকিং সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ডলারের দাম বরাবরই বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির হিসাব করলে দেখা যায় গত ২৫ বছরে ডলারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিতো। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এর পর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরাপুরি তা বাজারভিত্তিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে অনুসরণ করে আসছে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি।

চলতি বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০৫ মিলিয়ন ডলার কেনে। কিন্তু এক বছরেরও বেশি কম সময় পর টাকার অবমূল্যায়ন শুরু হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি আগস্ট মাস থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক বাজার স্থিতিশীল করতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থ বছরের ১ জুলাই থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ৭৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার আর ১ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলেও বাড়তি ডলার নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মূলধনের ১৫ শতাংশের সম পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে রাখতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই বাজারে ডলার বিক্রি করতে হবে। কোনো ব্যাংক নির্ধারিত সীমার বাইরে ডলার নিজেদের কাছে রাখলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ঠ ব্যাংককে জরিমান প্রদান করতে হয়। জরিমানা এড়িয়ে চলার জন্য ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই হস্তক্ষেপকে সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, ২০০০ সালে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের মূল্য ছিল ৫৪ টাকা। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ৭১ টাকা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যদিও ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট কার্যকর থাকলে তা করা যায় না। কিন্তু সেখানেও স্থির থাকেনি ডলারের দাম। বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম প্রায় ৮৭ টাকা। খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকার বেশি । গত ২৫ বছরের মূল্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৯৩ সালে ৪০ টাকায় পাওয়া যেত ১ ডলার ২০০৯ সালের শেষদিকে প্রতি ডলারের বিনিময় পাওয়া যেত ৬৯ টাকা।

২০২০ সালে দেশে করোনা মহামারী দেখা দেয়ার আগে ফেব্রুয়ারিতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সায় উঠেছিল, যা ছিল এযাবৎকালের ডলারের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান। ডলারের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইহার চাপ পড়ে উদ্যোক্তাদের ওপর। ব্যবসা কিংবা শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মেশিনারিজ পণ্য আমদানি করতে এলসি খুলতে হয়। এটা ক্ষেত্রবিশেষ ৯০ দিন, ১২০ দিন, ১৮০ দিন ও ৩৬০ দিন আগে ব্যাংক কোনো মেশিনারিজ ও পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয়ের হিসাব করে থাকে। কিন্তু আলোচ্য সময়ের মধ্যে কিংবা এরপরও ডলারের মূল্য বেড়ে গেলে তা গ্রাহকদের কাঁধে চাপে। এমনকি ঋণ পুরোপুরি শোধ না হওয়া পর্যন্ত ডলারের বাড়তি দাম গ্র্রাহককেই দিতে হয়। এত মোটব্যয় যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় তা গ্রাহক ব্যাংক থেকে নেয়নি। অথচ পরিশোধের সময় তাকে বাড়তি অর্থ দিতে হচ্ছে। তদুপরি একেক ব্যাংক একেক দরের বিষয়টিও মনিটরিং না করায় উদ্যোক্তা বিপাকে পড়েন। যার রেশ টানতে হয় ক্রেতা ও ভোক্তাকে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিল্পের কাচাঁমাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ সকল ধরনের পণ্যে আমদানি বাড়ছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও শিল্পকারখানার উৎপাদন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। এ প্রেক্ষাপটে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আর্থিকভাবে যথেষ্ঠ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত ভোক্তা সাধারণকেই বহন করতে হবে। একই সঙ্গে করোনা পরবর্তীতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আমরা জানি, দেশে আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি অক্ষুণ্ন রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিশেষ করে ডলারের মূল্য সবসময় গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে স্থিতিশীল রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে যথাযথ নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানি রফতানি বাণিজ্য বিষয়ক লেনদেনের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা রক্ষা করার জন্য ডলারের মূল্য সহনীয় ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিপাত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে দেশের রফতানি আয় প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ১০২ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমলেও যারা রফতানি করছেন সেটি তাদের জন্য এক ধরনের সুবিধা। বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে না পারলে এবং একই সাথে আমদানি ব্যয় কমাতে না পারলে ডলারের দামের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকানো বেশ কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ডলারের বিপরীতে টাকার প্রকৃত বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হয় একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো, পণ্য আমদানি-রফতানি বেশি, অর্থনীতির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে এমনসব দেশের রফতানি, আমদানি, মূল্যস্ফীতি, পণ্যমূল্য উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি তথ্য বিবেচনায় নিয়ে এই মূল্য বের করা হয়। এমন ১০ টি দেশের মুদ্রা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বাস্কেট তৈরি করেছে। এই মুদ্রা গুলো হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড স্টারলিং, কানাডিয়ান ডলার, মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ভারতের রুপি, চীনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরো, কোরিয়ান ইয়েন ও শ্রীলঙ্কার ডলার। এসব দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ স¤পন্ন হচ্ছে। এ কারণে মুদ্রাগুলোর সঙ্গে তুলনা করে প্রকৃত বিনিময় হার বের করা হচ্ছে। টাকা অবমূল্যায়িত হলে রফতানিকারকরা খুশি হয়। কারণ আগের তুলনায় বেশি আয় হয় তাদের। কিন্তু এই রফতানিকারকদের একটি অংশ যেখানে আমদানিকারক সেই দিক থেকে তারা আবার খুশি হতে পারে না। ডলারে আগের তুলনায় বেশি টাকা পাওয়া গেলে সাধারণত প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বেশি আসে দেশে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা তখন বেশি উৎসাহে টাকা পাঠায় দেশে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক টাকা দেশের বাহিরে চলে যায়। অর্থাৎ ওভার ইনভয়েসিং (আমদানির মূল্য বেশি দেখানো) ও আন্ডার ইনভয়েসিং(রফতানির মূল্য কম দেখানো) মাধ্যমে এসব অর্থ চলে যায়। অর্থাৎ মূলধনী যন্ত্রপাতি কিংবা পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানির আড়ালে চোখের সামনেই আইনী কাঠামোর মাধ্যমে চলে যায় দেশের টাকা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে মূল্য বেশি দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ চলে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়া নীতিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল, আমদানি, উৎপাদন বৃদ্ধি, আমদানি ও বিপণন খাতে নতুন ক্রেতা খোঁজা, এমনকি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষজ্ঞ আনয়ন এবং বিদেশে সেমিনার আয়োজনের নামেও অর্থ চলে যায়। দেশের বাইরে যখন টাকা চলে যায় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। যে টাকাটা দেশের বাইরে চলে যায় সেটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল চাহিদা অনুযায়ী যথার্থ কিনা, তাহলেই সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে এবং দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে।

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৬:১৩ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৫ অক্টোবর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।