বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিরাপত্তা হুমকিতে ‘নগদ’ গ্রাহকরা

আদম মালেক   |   বুধবার, ২৮ অক্টোবর ২০২০   |   প্রিন্ট   |   1636 বার পঠিত

নিরাপত্তা হুমকিতে ‘নগদ’ গ্রাহকরা

ডাক বিভাগের আশ্রয়ে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ‘নগদ’। কিন্তু ডাক বিভাগের ডাক শোনে না নগদ। নগদে র কর্তৃত্ব ব্যক্তিমালিকানাধীন ‘থার্ড ওয়েব টেকনোলোজি’র হাতে। তাই বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকিতে গ্রাহকরা।

জানা গেছে, নগদের মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে লোক নিয়োগ দিচ্ছে থার্ড ওয়েব টেকনোলোজি। সরকারের নিকট প্রতিষ্ঠানটির নেই কোনো জামানত। প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যক্রমের কোনো অডিট নেই। অর্জিত মুনাফার হিসাব জানে না ডাক বিভাগ। থার্ড ওয়েব টেকনোলোজি ইচ্ছেমাফিক কিছু লভ্যাংশ মাঝে মধ্যে ডাক বিভাগে দেয়। নগদের এজেন্ট কত তা সরকার তথা, ডাক বিভাগ জানার সুযোগ পায়নি। সার্ভার জেনারেটর রিপোর্টের একটি কপি ডাক বিভাগে প্রতিদিন জমা দেয়ার কথা থাকলেও নগদ কর্তৃপক্ষ দুই বছরে একটি স্টেটমেন্টও ডাক বিভাগে জমা দেয়নি। তাছাড়া নগদের ওপর ডাক বিভাগের পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া যেমন অস্বচ্ছ, তেমনি ডাক বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের ভ‚মিকাও রহস্যজনক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে পরিচালিত নগদের অপারেটর থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড নামে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। যৌথ মালিকানায় পরিচালিত এ ডিজিটাল পরিষেবা কার্যক্রমে ডাক বিভাগের (সরকারি) মালিকানা দেখানো হয়েছে ৫১ ভাগ। বাকি ৪৯ ভাগের দাবিদার থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজি লি.। তানভীর আহমেদ মিশুক ‘নগদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তবে নগদ আর্থিক সেবার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।

ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আর্থিক লেনদেনের অনুমোদন নেই থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজিস লিমিটেডের। কিন্তু সেবামূলক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডাক বিভাগের আর্থিক লেনদেনের এখতিয়ার রয়েছে। এ এখতিয়ার কাজে লাগিয়ে ডাক অধিদফতর ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস) প্রকল্প শুরু করে। কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতির কারণে নগদ কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডাক বিভাগের সঙ্গে নগদ পরিচালনাকারী থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজির লভ্যাংশের ভাগাভাগি হওয়ার কথা ৫১:৪৯ শতাংশ হারে। কিন্তু থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজি ডাক বিভাগের সঙ্গে তাদের লভ্যাংশের মোট পরিমাণই খোলাসা করেনি। নিজেদের ইচ্ছেয় নামমাত্র টাকা ডাক বিভাগকে দিচ্ছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর ডাক বিভাগকে থার্ড ওয়েভ ১ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার ৫৭৬ টাকার চেক হস্তান্তর করে। এর আগেও ডাক বিভাগকে নগদ কর্তৃপক্ষ কয়েক কোটি টাকার লভ্যাংশ দিয়েছে বলে শোনা যায়। কিন্তু কথিত লভ্যাংশের কোনো টাকাই সরকারি কোষাগারে জমা পড়েনি বলে জানা গেছে। নগদে র হিসাব-নিকাশেও রয়েছে অস্বচ্ছতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডাক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডাক বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করছে থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজিস লিমিটেড। নিজেদের নগদ লেনদেনের কোনো বৈধতা না থাকায় কৌশলে ডাক অধিদফতরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে নিয়েছে। ডাক বিভাগের আইনগত ভিত্তির ওপর ভর করে চলছে নগদের অবৈধ লেনদেন। আইনজ্ঞদের মতে, এটি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ অনুসারে সুস্পষ্টভাবে অবৈধ এবং অপরাধমূলক।

নগদের ৫১ শতাংশ মালিক ডাক অধিদফতর। অথচ ব্যক্তিমালিকানাধীন ৪৯ ভাগ মালিকানার থার্ড ওয়েব টেকনোলোজির হাতে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ। নগদের ব্যবস্থাপনা, আর্থিক বিষয়াদি, পরিচালনার শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লি.। সরকারি আর্থিক বিধান অনুযায়ী পাবলিক-পার্টনারশিপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ডিরেক্টরস হিসেবে সরকারের যুগ্ম-সচিব অথবা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে থাকেন। অথচ নগদের বোর্ড অব ডিরেক্টরসে সরকারের কোনো প্রতিনিধিত্বই নেই। ফলে ডাক বিভাগ তথা সরকারকে অন্ধকারে রেখে নগদ কর্তৃপক্ষ স্বনির্ধারণী হারে মুনাফার হিসাব এবং লভ্যাংশ বিলি-বণ্টন করছে।

অভিযোগ রয়েছে, ডাক বিভাগের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সুধাংশু শেখর ভদ্র (এএস ভদ্র) ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজির সঙ্গে অসম, অস্পষ্ট এবং অস্বচ্ছ এ চুক্তি সম্পাদন করেন। এ কারণে নগদ থেকে প্রাপ্য হিস্যা বুঝে নেয়ার বিষয়ে তাঁর বৈরাগ্য। সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করে রেখেছেন অস্বচ্ছতা।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস ডাক মহাপরিচালককে নগদের লেনদেনের বিষয়ে প্রতি মাসে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছিলেন। কিন্তু ডাকের মহাপরিচালক (বর্তমানে ছুটিতে) এসএস ভদ্র কোনো প্রতিবেদনই মন্ত্রণালয়কে দেননি। সার্ভার জেনারেটর রিপোর্টের একটি কপিও ডাক বিভাগে প্রতিদিন জমা দেয়ার কথা।
কিন্তু নগদ কর্তৃপক্ষ দুই বছরে একটি স্টেটমেন্টও ডাক বিভাগে জমা দেননি। এ বছর শুরুর দিকে ডাক মহাপরিচালকে চিঠি লেখে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে নগদ কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হয়, কিভাবে সরকার তার লভ্যাংশ পাচ্ছেÑ জানতে চাওয়া হয়। ডাক মহাপরিচালক ওই চিঠির কোনো জবাব দেননি। পরে নগদকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আওতায় এনে সাময়িক অনুমতি দেয়। সেক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড রক্ষার্থে নগদে লেনদেনের ঊর্ধ্বসীমা ৫০ হাজার থেকে নামিয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়।

নগদের আর্থিক লেনদেন, বিজনেস পলিসি, জনবল নিয়োগসহ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকছে থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজিস লিমিটেডের পরিচালিত নিজস্ব সার্ভারে। এ সার্ভারে প্রবেশের পাসওয়ার্ড নেই ৫১ শতাংশের মালিক ডাক বিভাগের হাতে। নগদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্মিত ‘ডাক ভবন’-এ। ডাক অধিদফতর থেকে ভাড়া নেয়া হয়েছে তিনটি ফ্লোর। মূলত গ্রাহককে বিভ্রান্ত করতেই বেসরকারি ডিজিটাল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে ডাক বিভাগকে এভাবে সংযুক্ত করে।

এদিকে ডাক বিভাগ জানে না নগদের কত এজেন্ট রয়েছে। ‘ডিজিটাল পোস্ট অফিস’ এবং ‘নগদ’ কার্যক্রম পরিচালনার ৮ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল রয়েছে। ডাক অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) হারুনুর রশীদ এ সেলের প্রধান। গতবছর ৬ নভেম্বর মনিটরিং সেলের সভায় উল্লেখ করা হয়, ডাক বিভাগের ৫১ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজিস লিমিটেড কর্তৃক নগদ পরিচালিত হলেও সেবাটি ডাক বিভাগের ডিজিটাল আর্থিক সেবা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু নগদের মাধ্যমে সকল লেনদেন ও লেনদেনকৃত সকল পাবলিক মানির পূর্ণাঙ্গ তদারকির সুযোগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডাক বিভাগের রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

ওই সভা থেকে জানা যায়, নগদের বিষয়ে ডাক বিভাগের একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল থাকলেও এর কোনো অফিস নেই। নেই জনবল এবং নথি ব্যবস্থাপনা। লজিস্টিক কোনো সাপোর্টও নেই। দেশের পাড়া-মহল্লা, গলির মুখে নগদের শত শত ডিলার এজেন্ট রয়েছে। কতগুলো এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা তার কিছুই জানেন না।

এদিকে মেসার্স থার্ড ওয়েভ টেকনোলোজিস লিমিটেডের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি গণমাধ্যমকে জানান, ‘প্রশ্নগুলো আমরা দেখেছি। এগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য ডাক বিভাগের কাছ থেকে আমাদের অনুমোদন নেই। সুতরাং এখানে আমাদের বক্তব্যের কোনো সুযোগ নেই।’

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৮ অক্টোবর ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রডের দাম বাড়ছে
(11192 বার পঠিত)

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।