বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সমৃদ্ধ রংধনুর অনন্য এক বাংলাদেশ

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ২০ মার্চ ২০২২   |   প্রিন্ট   |   224 বার পঠিত

বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সমৃদ্ধ রংধনুর অনন্য এক বাংলাদেশ

স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ^ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশার কথাই ছিল বেশি। বিশ^ব্যাংক বলেছিল, সবচেয়ে ভাল পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরীব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। অতি জনবহুল একটি দেশ (প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০) এবং জনসংখ্যা আরও বাড়ছে (বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি) এবং দেশটির মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশের কম) সেই সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইর্য়ক টাইমসের পররাষ্ট্র প্রতিনিধি ও পুলিৎজার জয়ী সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফার তার এক রিপোর্টে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উদ্দেশ্যে করে লিখেছেন ‘হোয়াট ক্যান বাইডেন প্ল্যান ডু ফর প্রোভার্টি? লুক টু বাংলাদেশ’। অর্থাৎ বাইডেন পরিকল্পনা দারিদ্র্যের জন্য কী করতে পারে? বাংলাদেশের দিকে তাকাও। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ আমরা অনেকের জন্যই উদাহরণ, যা বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডে জন্মগ্রহণকারী সকল মানুষের জন্য আনন্দের বার্তা।

মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গের কোভিড রেজিলিয়েন্স বা কোভিড সহনশীলতা সূচকে করোনা মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ৩০ নভেম্বর ২০২১ এই সূচক প্রকাশ করে। মার্কিন এই সংবাদ মাধ্যম বলছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতার ফলে সহনশীলতা সূচকে বাংলাদেশ গত জুলাইয়ে ৪৮ তম স্থান থেকে আগস্টে ৪৪ তম, সেপ্টেম্বরে ৩৯ তম, অক্টোবরে ৩৫ তম এবং নভেম্বরে ১৭ তম স্থানে উঠে এসেছে। সেখানে ২৬ তম স্থানে থাকা প্রতিবেশি ভারতের এই স্কোর ৬৩ দশমিক ৪ এবং ৩৯ তম স্থানে থাকা পাকিস্তানের ৫৭ দশমিক ৫। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। ব্যবসা বাণিজ্য সচল হচ্ছে। শিল্প উদ্যোক্তারা হাতে নিচ্ছেন নতুন নতুন প্রকল্প। আবার অনেকে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাচাঁমাল আমদানি বাড়ছে। ৪১১ বিলিয়ন ডলারের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বিপুলসংখ্যক পণ্য ও সেবার জন্য বাংলাদেশ এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, তুলনামূলক কম মজুরি, বিপুল কর্মক্ষম যুবশক্তি, স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হারের কারণে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশে^র অন্যতম প্রধান বিনিয়োগ আকর্ষণ। পোশাক শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালন করছে। তবে রপ্তানিক্ষেত্রে বহুমূখীকরণ করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি হলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। ভারত ও পাকিস্তানকে বাংলাদেশ পেছনে ফেলার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি বেশি হওয়া। ৯০ দশকে বাংলাদেশে নারীর উপস্থিতির হার ছিল ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে ভারতে নারীর উপস্থিতি ছিল ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ, এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পাকিস্তানে কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ছিল ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন হয়েছে ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা এই সুবিধা আরো দুই দশক পর্যন্ত পাব এরপর থেকে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নে এই সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি ঠিকই কিন্তু এর সঙ্গে বৈষম্য বাড়ছে। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। কিন্তু পরবর্তী উন্নয়ন ধাপে যেতে হলে সুশাসন, ব্যবসায় পরিবেশ উন্নতি, দুর্নীতিরোধ, সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়ানোসহ সরকারি সেবার মান বাড়াতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো বেশ কিছু বাধা দূর করে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে। তবে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়নের সীমিত উপকরণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা শ্রম আইন কার্যকরে শিথিলতা এবং দুর্নীতির মতো বিষয়ে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো এখনো বাধা। তাই বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশের সংশ্লিষ্ট পদ্ধতি আরো সহজ হতে হবে। যে কোনো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ তখনই আসে যখন তারা দেখতে পায় দেশের অভ্যন্তরীন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন। জিডিপি’র আনুপাতিক হারে আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ গত অর্থবছরে বেশ কিছুটা কমে গেছে। এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়েনি। গত ১০ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যে বাণিজ্য হতো এখন তা মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানির ৮৬ শতাংশ আসছে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব চুক্তি আরো বাড়াতে হবে। আমাদের আগে কয়েকটি সেক্টরে রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। আমাদের রপ্তানি নির্ভর প্রবৃদ্ধির দিকে যেতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অর্থনীতির পালা বদলের চিত্র সহজেই বোঝা যায় দেশটির অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ সব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, (১৯৭২-১৯৭৩) অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৬২৯ কোটি ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল খুবই কম মাত্র ৯৪ মার্কিন ডলার। সে সময় রিজার্ভ ছিল ১১০ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২২৬ কোটি ডলার, রাজস্ব আয় ছিল ২৮৫ কোটি টাকা আর দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। ১৯৭৬ সালে রেমিট্যান্স আসে ১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যায়, রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়েছে। ২০২০-২১ সালের হিসাবে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপি’র আকার ৪১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮ কোটি ডলারে আর রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে। গত ৫০ বছরে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন তার নিজস্ব রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঋণও প্রদান করছে। শুধু দেশেই নয় রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো শ্রীলংঙ্কাকেও ঋণ সহায়তা দিয়েছে। বটমলেস ‘বাস্কেট’ বলা সেই দেশেরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা সফরে এসে বলে গেছেন, বাঙালি জাতির মেধা পরিশ্রম আর একাগ্রতার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

গত ২২ নভেম্বর ২০২১ সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত একটি জাতীয় সংলাপে বিশ^ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ এবং ভূটান) মাসেই মিয়াং টেমবন বলেন, একটা দেশের উন্নয়নে কম বেশি ওঠানামা থাকবেই এবং এটি প্রত্যেকটি পরিবারের মতো ব্যক্তি জীবনের মতো। সেখানে উত্থান-পতন থাকবেই। তবে আমাদের এগুলোকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সম্প্রতি আমার ছেলেকে আমি কিছু ছবি পাঠিয়েছিলাম সেগুলো আমিসহ গুলশানের ছবি। আমার ছেলে গুলশানের ছবি গুলো দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করল-মা তুমি কী এখন নিউইয়র্কে আছো? প্রকৃতপক্ষে গুলশানের অবকাঠামো দেখে আমার ছেলের কাছে সেটি নিউইয়র্ক মনে হয়েছে। বিশ^ব্যাংক এর কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং তার ছেলে এই বহিঃপ্রকাশ আসলে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফসল। উন্নয়ন এখন বিভাগীয় শহর থেকে জেলা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে, যা আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতা ও রুচির পরিচায়ক। বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টাডের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ২০২২ সাল থেকে ২০২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে দেশের জিডিপি’র পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা) তাদের হিসাবে ২০২৬ অর্থবছর নাগাদ মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ‘প্যারোকিয়াল প্রোসেস’ শিরোনামের দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক নিবন্ধে বলা হয়, এক সময়ে যাকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হতো সেই বাংলাদেশ এখন ব্রিক-ব্র্যান্ডধারী প্রতিবেশি ভারতের চেয়ে ভাল করছে। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে এই দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের ৮০ শতাংশই বিদেশি সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে মেটানো হতো। বর্তমানে সেই দেশের বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ে বিদেশি ঋণ ও সাহায্যের পরিমাণ অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। রাজস্ব আয়ের যে উদ্ধৃত্ত অংশ থাকে তা বিনিয়োগ করা হচ্ছে উন্নয়ন বাজেটে। এখন উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ আসছে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। বাকি ৭০ শতাংশই নিজস্ব অর্থ থেকে যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এক সময় বৈদেশিক অর্থায়ন না পেলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলেও সেটি বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন নিজেদের অর্থে বৈদেশিক ঋণ ছাড়াই প্রকল্প নেয়ার সক্ষমতা অর্জন হয়েছে। যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর মতো ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি দর্শন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশকে আরো অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২০ মার্চ ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।