মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র পরিচালক : ক্ষমতা ও পারিশ্রমিকহীন কাগুজে বাঘ

মো. নূর-উল-আলম এসিএস   |   বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০   |   প্রিন্ট   |   364 বার পঠিত

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র পরিচালক : ক্ষমতা ও পারিশ্রমিকহীন কাগুজে বাঘ

সহজ ভাষায় বলতে হয় সংখ্যালঘু শেয়ারমালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই কোম্পানি আইন এবং কোম্পানি পরিচালনা সংক্রান্ত সকল বিধিবিধানের সূত্রপাত । এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচালক একটি যুগান্তকারী ধারণা। কিন্তু বাংলাদেশে স্বতন্ত্র পরিচালকবৃন্দ কতটুকু স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা তথা সংখ্যালঘু শেয়ারমালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারেন তা বিশদ বিশ্লষণের দাবি রাখে। আলোচ্য প্রবন্ধে বাংলাদেশে বিদ্যমান বিধিবিধানে বর্ণিত স্বতন্ত্র পরিচালকবৃন্দের যোগ্যতা, নির্বাচন প্রক্রিয়া, তাদের নিয়োগ এবং তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের আলোকে তাদের ক্ষমতার অনুশীলন তথা পরিচালনা পর্ষদে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালকবৃন্দের উপর অর্পিত ক্ষমতার যথাযথ অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ এবং তাদের কার্যকর নিরপেক্ষতা বৃদ্ধির উপায়সমূহ তুলে ধরা হলো ।

বাজার ব্যবস্থার বিবর্তনের সাথে সাথে মুলধনের প্রয়োজনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা এবং পরিচলন পদ্ধতির বিবর্তন ঘটেছে। বহুবিদ কারণে যৌথমুলধনী কোম্পানি ব্যবসায় সংগঠনের এ বিবর্তনের সর্বশেষ এবং জনপ্রিয়তম সংযোজন। সীমিত দায়, সহজে মালিকানা হস্তান্তরযোগ্যতা এবং চিরন্তন অস্তিত্বের অন্যতম প্রধান কারণগুলোর কয়েকটি মাত্র। এক্ষেত্রে অসংখ্য লোকের মালিকানা থাকলেও সবাই কোম্পানি পরিচালনার সুযোগ পান না। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাধারণ সভায় সকল শেয়ার মালিকের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সকল প্রতিনিধি তথা পরিচালক বা ডিরেক্টর তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত পর্ষদসভায় গৃহীত যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যৌথভাবে কোম্পানির সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন । তার আগেই তারা পরিচালনা পর্ষদ সভা পরিচালনার জন্য তাদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। পরিচালনা পর্ষদ সভা প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয় না; বিরতি দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। তাই দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য নিজেদের কাজের সুবিধার্থে পরিচালকবৃন্দ তাদের মধ্য থেকে এক জনকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা এমডি নির্বাচিত করেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়মিত অফিস করেন, বেতন পান এবং তার কাজের জন্য তাকে পরিচালনা পর্ষদের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। পরিচালকবৃন্দর মধ্য থেকে ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর’ পাওয়া না গেলে বাইরে থেকে যোগ্য কাউকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অনেক সময় পর্ষদ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে কোন কোন পরিচালক নিয়মিত অফিস করেন এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে বিবেচিত হন।

অ্যাক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরা তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য বেতন-ভাতা প্রাপ্য হন। কিন্তু অন্যান্য পরিচালকবৃন্দ তথা নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরা শুধু পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকার জন্য ‘ফি’ প্রাপ্য হন। সাধারণভাবে এছাড়া পরিচালকবৃন্দ অন্যকোন প্রকাশ্য অথবা গোপন অর্থিক সুবিধা বা অফিস অব প্রফিট গ্রহন করতে পারেন না। এটি ছিল যৌথ মূলধনী কোম্পানি পরিচালনায় পারিতোষিক বিষয়ক প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু যেহেতু পরিচালকরা প্রত্যক্ষভাবে কোম্পানি পরিচালনায় বিভিন্ন আর্থিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেন তাদের পক্ষে সহজেই বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা গ্রহন করা অসম্ভব নয়। যা সংখ্যালগু শেয়ারমালিক তথা বিনিয়োগকারীর স্বার্থবিরোধী। উপরন্তু নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইউএসএ, ইউকে এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশসমূহে অনেক তালিকাভুক্ত পাবলিক কোম্পানিতে সংগঠিত বিভিন্ন আর্থিক কেলেংকরী প্রকাশ্যে আসার পর, কোম্পানিগুলোর পরিচালনগত ব্যাপক ত্রুটি জনগণে সামনে ধরা পড়ে । ফলে দাবি ওঠে ‘কর্পোরেট গভর্নেন্স’ বা কোম্পানি তথা প্রতিষ্ঠানিক সুশাসনের । তখন প্রথমবারের মতো পর্ষদ সভায় সংযোজিত হয় একধরনের নতুন পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক। যিনি একাধারে একজন নন-অ্যাক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং নন-শেয়ার হোল্ডিং ডিরেক্টর। এর একমাত্র কারণ ছিল নন-এক্সিকিউটিভ স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতা প্রদানের মধ্যদিয়ে ফাইন্যানশিয়াল রিপোর্টিং, অডিট এবং রেমুনারেশন কমিটিতে তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। যাতে কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থ তথা সকল বিনিয়োগকারী বিশেষকরে সংখ্যালগু শেয়ারমালিকদের স্বার্থে তারা সব ধরনের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট অথবা যে কোন ধরনের অনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় উন্নতদেশসমূহ ইতোমধ্যেই স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতায়নের জন্য নতুন নতুন চিন্তা এবং গবেষণার ফল পেতে শুরু করেছে। অথচ আমরা রয়ে গেছি সেই তিমিরেই; সংখ্যাগুরুদের দ্বারা পরিচালিত কোম্পানির যুগেই! বরং বর্তমানে আইনের মারপ্যাঁচে সংখ্যাগুরুরা আরো বেশী শক্তিশালী! কারণ,আমাদের দেশে স্বতন্ত্র পরিচালকরা পর্ষদ সভায় সংখ্যাগুরুদের ঈশারায় কাজ করেন যা প্রকারান্তে সংখ্যাগুরুদের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করেছে।বিষয়টি বিশদ বিশ্লেষনের দাবী রাখে ।

স্বতন্ত্র পরিচালক শব্দটির সাথে বাংলাদেশের পরিচয় ২০০৬ সালে যখন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (BSEC) পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কর্পোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (CGG) প্রণয়ন করে। এতে প্রথমবারের মতো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য কম্প্লাই বেসিসে পর্ষদসভার ১/১০ ভাগ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বিধান রাখা হয়। ২০১২ সালের রিভাইজড কর্পোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (CGG) এ সেটি ১/৫ ভাগ নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালে কর্পোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (CGG) প্রতিস্থাপিত করে কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড (CGC) প্রণয়ন করা হয়। সেটিতেও পর্ষদসভার ১/৫ ভাগ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বিধান রাখা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, স্বতন্ত্র পরিচালক ধারণাটি আমাদের দেশে দেড় দশকের বেশি পুরোনো। কিন্ত যে উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে সে লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হচ্ছে, সে প্রশ্ন এসেই যায়। স্বতন্ত্র পরিচালকরা আদৌ যথাযথভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে অবদান রাখতে পারছেন কিনা সেটিও ভাববার সময় এসেছে।

আমাদের এখানে যদিও তালিকাভুক্ত কোম্পানি গুলোর জন্য ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগের বিধান রয়েছে কিন্তু নিয়মের ফাঁক গলে তারা আবার সংখ্যাগুরুদের পছন্দেই নির্বাচিত হন। ফলে সংখ্যাগুরুদের সামনে তারা কখনোই সংখ্যালগু তথা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ করতে পারেন না। তাদের নাম সর্বস্ব ভূমিকার কারণে সংখ্যাগুরুরা বরং এখন আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং তাই পরিচালনা পর্ষদ হয়ে পড়ছে আরো বেশি একপেশে।২০১৮ সালে কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড (CGC) পর্যালোচনা করে দেখা যায় । কোডের ১(২) এবং ১(৩) নং শর্তে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংজ্ঞা, আনুপাতিক সংখ্যা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত যোগ্যতা-অযোগ্যতা, শিক্ষাগত যোগ্যতাবিষয়ক পূর্বশর্ত বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে ১০ বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা শর্ত হিসেবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ১(৩) (ঘ) শর্তে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে উরোক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার পূর্বশর্ত শিথিল যোগ্য বলে বর্ণিত হয়েছে ।

বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র প্রায় ছয়শত। ধরি তাদের আনুমানিক দু’শত সাবসিডিয়ারি কোম্পানির রয়েছে। তাহলে মোট আটশত কোম্পানিকে এ কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড (CGC) মেনে চলতে হয়। যদিও চাহিদাটি কোম্পানিপিছু তিন’জন অর্থাৎ আনুমানিক ২৪০০ জনের মত তবুও ফুল এম্প্লয়মেন্ট ধরে বিশে চার’জন অর্থাৎ আনুমানিক ৩২০০ স্বতন্ত্র পরিচালকের চাহিদার বিপরীতে অসংখ্য লোককে ‘কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড’-এ স্বতন্ত্র পরিচালক হবার যোগ্য বলে বর্ণিত হয়েছে । তালিকাটা যেকোন বিবেচনায়ই বেশ বড়; ১০ কোটি টাকার বেশী জমাকৃত মূলধন সম্পন্ন যে কোন কোম্পানির পরিচালক, তালিকাভুক্ত যে কোন কোম্পানির পরিচালক, জাতীয়-আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্সের যে কোন সদস্য, বণিক সমিতির যে কোন সদস্য, তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানির টপ ৫ এক্সিকিউটিভস ছিলেন এমন কেউ, ১০ কোটি টাকার বেশি জমাকৃত মূলধন সম্পন্ন যে কোন কোম্পানির টপ ৫ এক্সিকিউটিভ ছিলেন এমন কেউ, সরকারি বেতনকাঠামোয় ৫ম গ্রেডের উপর বেতন নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়,অর্থনীতি এবং আইন বিষয়ে স্নাতক যে কোন কর্মকর্তা, ব্যবসায়, অর্থনীতি এবং আইন বিষয়ের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের যে কোন আইনজীবী এবং বিশ্বের সকল সিএ, সিএমএ, সিএফএ, সিসিএ, সিপিএ, সিএমএ, সিএস এবং সমমানের যে কোন ডিগ্রীধারীদের ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ হিসেবে যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়ছে। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন বিশ্বের সকল প্রফেশনাল ডিগ্রীধারী । কারণ সিএ, সিএম এবং সিএস আমাদের দেশীয় পেশাদারী ডিগ্রী। অপরপক্ষে সিএফএ, সিসিএ এবং সিপিএ দেশের বাইরের ডিগ্রী। পৃথিবীসব দেশ দেশীয় ডিগ্রীকে প্রধান্য দেয় এবং প্রয়োজনে বাইরের ডিগ্রীগুলোর দেশীয় সংষ্করণ তৈরী করে দেশের টাকা দেশেই রাখার ব্যবস্থা করে । অথচ আমাদের পলিসিমেকারদের সেসব ভাবতে বয়েই গেছে! যদিও উপরোক্ত যে কোন যোগ্যতার পাশাপাশি ১০ বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা শর্ত হিসেবে বেধে দেওয়া হয়েছে তবুও যে কোন বিচারেই জোগানের সংখ্যাটা বিশাল যা স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের মূল লক্ষ্যকে নিশ্চতভাবে ব্যাহত করেছে। অধিকন্তু একজন স্বতন্ত্র পরিচালকের সর্বোচ্চ ৫টি তালিকা ভুক্ত কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার বিধান এ কোডের আরেকটি বড় দুর্বলতা। অপর একটি শর্তে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে উরোক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার পূর্বশর্ত শিথিলযোগ্য বলে বর্ণনা করায় স্বতন্ত্র পরিচালকের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার শর্তগুলোও গৌন হয়ে পড়েছে !

কোয়ালিটির সাথে কম্প্রমাইজ করে গুণগত মানসম্পন্ন সেবা আশা কারাটা কতটা বোকামি তা বাংলাদেশে বিদ্যমান কোম্পানি গুলোর তথ্য বাতায়নে প্রদর্শিত স্বতন্ত্র পরিচালকদের পরিচিতি পড়লেই বুঝবেন। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অধিকাংশ তালিকাভুক্ত কোম্পানি শর্তপূরণ বা পরিপালন করে মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা কোন না কোনভাবে বিদ্যমান শেয়ার হোল্ডিং ডিরেক্টরদের পরিচিত অথবা তাদের পছন্দের লোক। তাই তারা সংখ্যাগুরুদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। ফলে তাদের দ্বারা সংখ্যালগু তথা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়া কখনোই সম্ভব হয় না। ফলে বলা চলে বাংলাদেশের নিরিক্ষে স্বতন্ত্র পরিচালক একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)-এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচালকদের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বতন্ত্র পরিচালকদের গড় বয়স ৬৪ বছর। ৫৮ শতাংশের স্নাতকত্তোর ডিগ্রী রয়েছে। বাকী ৪২ভাগের কথা বলা নেই । অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে তারা স্নাতক অথবা আরো কম শিক্ষিত। প্রতিবেদনটি থেকে আরো জানা যায়, কোম্পানি থেকে তাদের বার্ষিক গড় আয় মাত্র দেড় লক্ষ টাকা। মাসে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মাত্র! অথচ আমাদের প্রতিবেশী ভারতে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বছরে গড়ে তার চাইতে ৭ গুন বেশি আয় করেন। এত নিম্ন আয় তাদের পেশাদারী দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা এবং অবদানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উপরন্তু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দিয়েছে কিন্তু কোন দায় দেয়নি । তাই হয়নি তাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়ন । দেয়নি কোন পারিশ্রমিকও। অথচ অডিট কমিটির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালকে। অডিট কমিটির প্রধান হিসেবে তার কাজ কোম্পানির সকল প্রকার আর্থিক অনিয়ম এবং অসঙ্গতি উদ্ঘাটন করা এবং তদানুযায়ী পর্ষদ সভাকে অবহিত করা। পাশাপাশি বার্ষিক সাধারণ সভায় সকল শেয়ারহোল্ডারকেও বিষয়টি অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে। অধিকন্তু পর্যদ সভা বিষয়টি আমলে না নিলে কমিশনকে অবহিত করার বিধানও রাখা হয়েছে। এর অর্থ হলো ‘পরিচালনা পর্ষদ’-এ জ্ঞান এবং দক্ষতায় বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ‘পরিচালনা পর্ষদ’-এ স্বতন্ত্র পরিচালকের অন্তর্ভুক্তির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে যা র্কপোরেট সুশাসনের অন্যতম মূল উপাদান। অথচ তাদের উক্ত কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে যে সময় এবং শ্রম দিতে হবে তার জন্য কোন পারিশ্রমিকের কথা বিবেচনায়ই নেওয়া হয়নি। স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন যেন চ্যারিটি! ফলে বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হলো ক্ষমতা এবং পারিশ্রমিকহীন কাগুজে বাঘ ।

পরিশেষে বলা চলে পৃথিবীর সবদেশের মতো বিএসইসি’র ‘করপোরেট গভর্নেন্স কোড’-এ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্বতন্ত্র পরিচালকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলো যেন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারে তার জন্য যোগ্যতার শর্তবেধে দেওয়া হয়েছে। অথচ যোগ্যতার শর্তসমূহের ফাঁক গলে নিজেদের পছন্দের লোককে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অতএব বাংলাদেশের উচিত যতদ্রুত সম্ভব স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি পুল বা প্যানেল তৈরী করা। উপরন্তু যোগ্যতার শর্তসমূহের ফাঁক গলে দুর্বল চিত্তের কাউকে যাতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া না যায় সেজন্য ‘স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল’ তৈরীর কোন বিকল্পও নেই । ‘স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল’ গঠিত হলে বিএসইসি’র ‘করপোরেট গভর্নেন্স কোড’ আরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং কোম্পানিগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়বে। কারণ যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালকরাই পুঁজিবাজারে কর্পোরেট সুশাসনের মূলশক্তি। পাশাপাশি বিএসইসি’র উচিত স্বতন্ত্র পরিচালকসহ অন্যান্য পরিচালকরা যেন কোম্পানিগুলোতে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেন সে লক্ষ্যে ‘ইন্সটিটিউট অব ডিরেক্টরস’ প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবদান রাখতে সাহায্য করা ।

লেখক : সহযোগী সদস্য, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)
ইমেইল : csnoor.bd@gmail.com
সেল নং : +8801610-123223

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:০০ অপরাহ্ণ | বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।