শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিনিয়োগবান্ধব করপোরেট কর ও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড

পান্না কুমার রায় রজত   |   বুধবার, ৩০ জুন ২০২১   |   প্রিন্ট   |   558 বার পঠিত

বিনিয়োগবান্ধব করপোরেট কর ও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড

চীনা ভাষায় একটি প্রবাদে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘হাজার মাইলের ভ্রমণ শুরু হয় একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মাধ্যমেই’। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ১৯৭২-৭৩ সালে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা দিয়ে শুরু হওয়া আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট, যার আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পর ৫০তম বাজেট গত ৩ জুন ২০২১ মহান জাতীয় সংসদে পেশ হলো। অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ, মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে, যাদের বেতনের বাইরে বাড়তি আয় নেই, উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাদের বসবাস তারাই মধ্যবিত্ত। যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা সে-ই মধ্যবিত্ত। এটা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ, মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন-মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত। করোনার কারণে মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ নতুন দারিদ্র্যদের মধ্যে ঢুকে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট হয়েছে একটি শিল্প, ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট। বাজেট ব্যবসা সহায়ক হওয়ায় ব্যবসার পরিধি বাড়বে ও বেকার শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান হবে। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্ট্যারন্যাশানাল ফিন্যান্স করপোরেশরনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা বৈষম্য কমানোর তাগিদ দিচ্ছেন। কেননা একশ্রেণির হাতে প্রচুর অর্থ আরেক শ্রেণি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আমাদের এই শ্রেণিকে রক্ষা করতে হবে। তাদেরকে রক্ষা করতে না পারলে চাহিদা তৈরি হবে না। চাহিদা না বাড়লে বাজার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যন্ত, ঠিক সে সময়ে বাংলাদেশে সমগ্র প্রতিকূল প্রতিবেশ মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতি। অর্থনীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক যখন আবার মাথা তুলতে শুরু করেছিল, তখনই করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশকে আবার টলিয়ে দিয়ে গেছে।

দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখতে পাই। নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য করছাড় নতুন বিনিয়োগে কিছু সুবিধা, কর ও ভ্যাটে কিছু অব্যাহতি এবং স্থানীয় শিল্পে সুরক্ষা দিতে করছাড়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বহুমুখী উদ্যোগ বাজেটে আশান্বিত করেছে। প্রতি বছর আমাদের জিডিপির আকার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাজেটের আকারও বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। বাজেট পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের বড় ছাড় দেয়া হয়েছে, করপোরেট কর কমানো হয়েছে, কয়েকটি খাতে ভ্যাট কমানো হয়েছে, কিছু খাতে বাড়ানো হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ। শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। কিছু খাতে কমানো হয়েছে অগ্রিম কর। সব মিলিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে নেয়া হয়েছে বিশেষ কিছুু পদক্ষেপ।

কোনো প্রতিষ্ঠান বছর শেষে মুনাফার ওপর যে কর দেয়, সেটাই করপোরেট কর। বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচটি স্তরে করপোরেট কর আদায় করা হয়। সর্বোচ্চ কর ৪৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ। বাজেটে দুটি স্তরে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এর একটি হচ্ছে নন-লিস্টেড কোম্পানি, যা শেয়ারবাজারের অন্তর্ভুক্ত নয়, অন্যটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট করহার বর্তমানে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহার বর্তমানে ২৫ শতাংশ, তা চলতি বাজেটে কমিয়ে করা হয়েছে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে করপোরেট করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে একটি বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের পুনর্বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয় বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ৫০টি বাজেটে রেখার সোজা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়। করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যবসা-সহায়ক এবং শিল্পবান্ধব বাজেটের অংশ হিসেবেই এই করহার কমানো হয়েছে বলে আমি মনে করি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, করপোরেট কর কমানো হলে স্থানীয় দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ কমবে, উৎপাদন খরচ কম হলে মুনাফা বেশি থাকবে। ফলে মুনাফার কিছু অংশ পুনরায় বিনিয়োগের সুযোগ হবে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস দেশের ১৯০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। ১৪০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বার্ডেন অব গভর্নমেন্ট রেজুলেশন সূচকে ৬৯তম অ্যাফিশিয়েন্সি অব লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক সূচকে ৮৪। এই সূচকগুলো আরো ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। ১৯৮৪ সালের আয়কর আইনে করদাতা দুই ধরনের। ব্যক্তিশ্রেণি করদাতা এবং কোম্পানি করদাতা। সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যক্তিশ্রেণির চেয়ে কোম্পানির করদাতা কম হলেও এ খাত থেকেই কর বেশি আদায় হয়। মোট করদাতার মাত্র ২ শতাংশ কোম্পানি করদাতা। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির হিসাবে দেশে দেড় লাখের বেশি কোম্পানি থাকলেও নিয়মিত কর দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৩৫ হাজার। এখন পর্যন্ত একক খাত হিসেবে ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর আদায় হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড ইকোনোমিক রিসার্চ (সিবিইআর) অনুযায়ী, এশিয়ার ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের পরেই বাংলাদেশ। কোনো দেশের অর্থনীতি কত শক্তিশালী তা বিবেচনা করার জন্য ক্রয়ক্ষমতার সমতাকে (পিপিপি) ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসাবে বিশ্বের ৩১তম বড় অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ঋণ গ্রহীতার তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন উঠে এসেছে ঋণদাতা দেশের তালিকায়।

অধিক কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়াতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় কর প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার জন্য ব্যাপক করছাড়ের সুবিধা দেশের মেগা শিল্পের বিকাশ এবং আমদানি বিকল্প শিল্পোৎপাদনকে ত্বরান্বিত করার স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি সময় কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডে মানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারকে কোনো আয়কর প্রদান করতে হয় না। এরপর কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রযোজ্য হারে বার্ষিক মুনাফার ওপর কর দিতে হয়। এই করকে করপোরেট কর বলা হয়। দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থে এ সুবিধা প্রদান করা হয়। অর্থাৎ কর অবকাশ সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা। কর অবকাশ সুবিধা দেয়ার ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন এবং কর্মসংস্থান বাড়ে। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সাল থেকে কর অবকাশ সুবিধা চালু রয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে আদেশ (এসআরও) জারি করে প্রয়োজন মোতাবেক বিভিন্ন খাতে কর অবকাশ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এদেশে কর সুবিধা বেশি দেয়া হয়।

আবার দেশীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য আমদানিতে কর বাড়ানো হয়েছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক। কারণ দেশীয় উৎপাদককে অনেক সময় আমদানি পণ্যের প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়। সে ক্ষেত্রে শুল্ক-কর বাড়িয়ে দিয়ে দেশীয় খাতকে সুরক্ষা দিতে হয়। এই বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেছে। তাছাড়া কৃষি আধুনিককরণের লক্ষ্যে কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সবকিছুই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করবে। উন্নত দেশের স্বপ্ন এখন বাংলাদেশের।

সেই লক্ষ্য পূরণ করতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা অগ্রিম আয়কর সুবিধাসহ নানা পদক্ষেপ ইতিবাচক হয়েছে। কারণ বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে যেতে হলে এ মুহূর্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন দরকার। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সুশাসন, কার্যকর নগর ব্যবস্থাপনারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ৩০ জুন ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।